হরিপুরের হরেক কান্ড–ষষ্ঠ পর্ব- শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়

গল্পের সপ্তম অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন।

শেষরাতে বৃষ্টি থেমে দুর্যোগ কেটে গেল। সকালবেলায় কুয়াশায় মাখা একটু রোদও উঠল। এই সাতসকালে প্রাতঃভ্রমণে বেরিয়েছে মদন হালদার আর সুজন বোস। দুজনেরই বয়স সত্তরের ওপরে।

মদন বলল, এবার গাঁয়ে একটা অনাসৃষ্টি না হয়েই যায় না। সুজন সায়েন্স জানা লোক। বিলেতে আমেরিকায় বিজ্ঞানী হিসেবে অনেকদিন চাকরি করে এসেছে। শেষ জীবনে একটু শাস্তিতে নিরিবিলি জীবন কাটাতে হরিপুরের পৈতৃক ভিটেয় ফিরে আসা। তবে একা থাকতে হয়, ছেলেমেয়েরা সব বিদেশে পাকাপাকিভাবে থেকে গেছে। স্ত্রীও এই অজ পাড়াগাঁয়ে আসতে রাজি নয়। একগুয়ে সুজন একাই আছে। মদনের কথাটা শুনে ভু কুঁচকে বলল, কেন বলো তো !

শূলপাণির কথাই বলছি। কাল রাত আটটায় তার হাসি শোনা গেল না। গাঁ শুদ্ধ লোক গিয়ে জড়ো হল তার বাড়িতে। কিন্তু সব ভোঁ ভাঁ, শূলপাণি হাপিস ।

হ্যাঁ, ঘটনার কথা শুনেছি। কিন্তু তার সঙ্গে হরিপুরের অনাসৃষ্টির সম্পকটা কী?

কি জানি ভাই, মনে হয় এসব অলক্ষুণে কাণ্ড। হরিপুর শান্ত জায়গা, এখানে এরকম অদ্ভুত ঘটনা ঘটে না।

সুজন একটু হেসে বলল, তোমাদের সাবালক হতে আরও কতদিন লাগবে সে কথাই ভাবছি। শূলপাণি হাসেনি বলে সবাই নানা রকম আশঙ্কা করছে কেন তাও বুঝতে পারছি না। ও তো একটা পাগল। পাগলের কাণ্ডর কি কোনও লজিক্যাল ব্যাখ্যা হয় ? সোজা কথা হল, শূলপাণি কোথাও চলে গেছে।

তা হতে পারে। কিন্তু তুমি কি শূলপাণিকে ভাল করে চিনতে?

খুব চিনতাম। আমি সায়েন্টিস্ট বলে সে প্রায়ই আমার কাছে আসত আর নানা উদ্ভট জিনিস জানতে চাইত।

কিরকম? পাখির মতো আকাশে ওড়া যায় কি না, কোনও জিনিস শূন্যে কী করে ভাসিয়ে রাখা যায়, একজন মানুষের মুণ্ডু আর একজনের ধড়ের সঙ্গে জুড়ে দিলে কি হয় এইসব আবোল তাবোল। আমি বেশি পাত্তা দিইনি।

কিন্তু রাত আটটার সময় শূলপাণি অট্টহাসি হাসত কেন তা ভেবে দেখেছো?

কন্ডিশন রিফ্লেক্স কাকে বলে জানো তো?

হ্যাঁ, পাবলভের থিয়োরি। আমার মনে হয় এটাও ওরকম কিছু। এ ছাড়া অন্য কোনও কারণ নেই।

তুমি বৈজ্ঞানিক মানুষ, বিশ্বাস করবে না জানি। কিন্তু শূলপাণির কিছু অদ্ভুত ক্ষমতাও ছিল।

কিরকম ক্ষমতা ?

সে খালি হাত মুঠো করে অনেক জিনিস মুঠো থেকে বের করতে পারত।

সুজন হেসে বলল, ও তো রাস্তার বাজিকররাও দেখাতে পারে। এমন কি আমিও পারি। হাতসাফাই ছাড়া কিছু নয়।

একদিন সে আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল, আমি কিসের গন্ধ ভালবাসি। আমি বললাম, কস্তুরী। কী করল জানো? আমার ডান কজিতে স্রেফ ডান হাতের বুড়ো আঙুলটা ঘষে দিল অমনি ভুরভুর করে কস্তুরীর গন্ধ বেরোতে লাগল।

ভায়া হে, । একটু প্র্যাকটিস করলেই পারা যায়। শূলপাণি সম্পর্কে তোমরাই একটা রহস্যের ঘেরাটাপে গড়ে তুলেছে। গাঁয়ে-গঞ্জে এরকম হামেশাই হয়।

তুমি কি বলতে চাও লোকটা বুজরুক?

তাও নয়। বুজরুকের অন্যকে ঠকানোর মতলব থাকে। শূলপাণির সে মতলব ছিল না। তবে সে যে পাগল তাতে সন্দেহ নেই। একবার আমার কাছে কতগুলো জিনিস দেখাতে এনেছিল।

কি জিনিস ?

কয়েকটা কড়ি আর তামার পয়সা।

বলো কী? কাল তার ঘরে একটা কাঠের বাক্সে নাকি পাওয়া গিয়েছিল জিনিসগুলো। কিন্তু সেগুলো কে বা কারা সরিয়ে ফেলেছে। .

সুজন এবার একটু চিন্তিত হয়ে বলল, সরিয়ে ফেলেছে?

হ্যাঁ হে, দারোগাবাবুর নাকের ডগায় ঘটনা। তা তোমার জিনিসগুলো দেখে কী মনে হয়েছিল?

মাথা নেড়ে সুজন বলে, কিছুই নয়। সাধারণ তামার পয়সা, সাধারণ কড়ি। কোনও গুপ্তধন নয় ।

আর কিছু হতে পারে কি?

কোনও সংকেত? তা আমি জানি না। মোট সাতটা কড়ি, আর সাতটা পয়সা ছিল। সংকেত হলেও তা ভেদ করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তবে পয়সাগুলো বহু পুরনো। কোনও কালেকটারকে বেচলে কিছু টাকা পাওয়া গেলেও যেতে পারে। তার বেশি কিছু নয়।

তোমার বাড়িতে তো একটা ল্যাবরেটরি আছে!

তা আছে। তবে গাঁ-গঞ্জে তো আর আধুনিক ল্যাব করা সম্ভব নয়। এ গাঁয়ে এখনও ইলেকট্রিকই আসেনি। সুতরাং ল্যাব বলতে যা বোঝায় তা নয়। ছোটােখাটাে জিনিস বা এক্সপেরিমেন্ট হতে পারে। কিন্তু কেন বলো তো? ঐ কড়ি আর পয়সা ল্যাবরেটরিতে একটু পরীক্ষা করে দেখলে পারতে। সুজন হাঃ হাঃ করে হেসে বলল, আমি ওরকম কাজ করতে যাবো কেন বলো তো? কড়ি আর পয়সার মধ্যে কী এমন থাকতে পারে?

না-ই যদি থাকবে তাহলে তা চুরি যাবে কেন? চিন্তিত সুজন বলে, সেটা একটা ভাবার মতো কথা। ওই সামান্য জিনিস নিয়ে কারও কোনও লাভ নেই। অন্তত কমন সেন্স সেই কথাই বলে। তবে সংকেত হলে আমার কিছু বলার নেই।

সাতটা পয়সা এবং সাতটা কড়ি-ব্যাপারটা বেশ রহস্যময় মনে হয় না?

রহস্য মনে করতে চাইলে করতে পারো। বাধাটা দিচ্ছে

গল্পের সপ্তম অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন।

সম্পর্কিত পোস্ট

দুঃখিত!