হরিপুরের হরেক কান্ড–নবম পর্ব- পর্ব-শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়

গল্পের দশম তম অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন

গোপেশ্বরকে দেখে অবাক হওয়ার কিছু ছিল না। হরিপুরে আজ হাটবার, আর হাটবারে কে না হাটে আসে। তবে জগা আর পাগলু একটু ঘাবড়ে গেছে, যদি গোপেশ্বর তাদের কথাবার্তা শুনে থাকে! খুন-খারাপ নিয়ে কথাবার্তা তো ভাল নয়।

গোপেশ্বরের মুখ দেখে তার মনের ভাব বুঝবার উপায় নেই। ভারি অমায়িক মুখে মিষ্টি একটু হাসি। মোলায়েম গলায় বলল, “তা ভায়াদের যে মুখ বড় শুকনো দেখছি! এ তো ভাল কথা নয়। মায়াবদ্ধ জীব তো মনের ঘানিতে ঘুরবেই। বেঁচে থাকা মানেই পাকে-পাকে জড়িয়ে পড়া। তা কথাটা হচ্ছিল কী নিয়ে?”

জগার মুখে বাক্য সরল না। পাগলু গলা খাঁকারি দিয়ে বলল, “এই দ্রব্যগুণ নিয়েই কথা হচ্ছিল আজ্ঞে।       “দ্রব্যগুণ ! বলো কী হে? দ্রব্যগুণ নিয়ে তো মাথায় ঘামায় রামহরি কবিরাজ।”

পাগলু জিভ কেটে মাথা চুলকে বলল, “আজ্ঞে মুখ্যুসুখ্য মানুষ, কী বলতে কী বলে ফেলি! দ্রব্যগুণ বলতে জিনিসপত্রের দামের কথাই হচ্ছিল আজ্ঞে। কুমড়োর দাম কী চড়াটাই চড়েছে বলুন ত ! মুলো বলুন, শাকপাতা বলুন, কোনটা গরিবের নাগালে আছে বলতে পারেন?”

“তা বটে। তা হলে দ্রব্যগুণ নিয়েই কথা হচ্ছিল তোমাদের?”

“যে আজ্ঞে ।”

“আমার বয়স হয়েছে। কানেও ভাল শুনি না। তবে যেন ঝোপের আড়াল থেকে মনে হল, কারা যেন খুন-খারাপ নিয়ে কথা কইছে।”

পাগলু একগাল হেসে বলল, “খুনই তো, খুন ছাড়া একে আর কী বলা যায়? এই জগা বলছিল, ‘পাগলুদাদা, জিনিসপত্রের যা গলাকাটা দাম দেখছি এতে গরিবেরা সব খুন হয়ে যাবে।”

“বটে ! তা ঠিক কথাই তো !”

“আজ্ঞে, নিয্যস কথা। তা আপনি কিছু কইবেন?”

“গোপেশ্বর মিষ্টি হাসিটি বজায় রেখেই বলল, “সেইজন্যেই তো হাটময় খুঁজে বেড়াচ্ছি তোমাদের হে। এসো, এই গাছতলায় জুত করে বসি। কথা আছে ”

“জগা খুবই ভয় পেয়েছে। বসতে গিয়ে সে দেখল তার হাতে-পায়ে খিল ধরে কেমন শক্ত হয়ে গেছে। হাঁটু ভাঁজ হতে চাইছে না। সে বলল, “আপনারা কথা বলুন, আমি একটা কচু দর করে এসেছি, দেখি গিয়ে সেটা আবার কেউ নিয়ে গেল নাকি৷”

গোপেশ্বর মিষ্টি গলায় বলল, “কচুর জন্য ভাবন কী হে? আমার বাড়ির পেছনেই মেলা হয়েছে। দাম দিতে হবে না, অমনি দিয়ে দেবখন তোমাকে একটা, আর কথাটাও তোমার সঙ্গেই কিনা।”

জগা বলল, “আজ আমার সঙ্গে অনেকেরই কথা আছে দেখছি।”

গোপেশ্বর মাথা নেড়ে বলে, “যা বলেছ, মানুষ নিজের গুণেই বড় হয় কিনা! আর বড় হওয়ার ওইটেই রাজলক্ষণ। তখন সবাই তাকে খোঁজে, একটু আগেই তো দেখছিলাম যেন একজন লম্বা দশাসই চেহারার লোক খালধারে দাঁড়িয়ে তোমার কাঁধে হাত রেখে কথা কইছিল!”

জগার হাত-পায়ের খিল খুলে গেল লহমায়। সে অবশ হয়ে ধপ করে বসে পড়ল মাটিতে। মুখে বলল, “কই না তো!”

“আমার চোখের দোষও হতে পারে। বয়স তো বড় কম হল না হে। চোখ-কানের আর দোষ কী? মনে হল যেন মথুরাপুরের দিনুকেই দেখলুম। না হলেই মঙ্গল, কারণ দিনু তো খুব একটা ভাল লোক নয়।”

জগা কাহিল গলায় বলে, “দিনু কে মশাই ?”

গোপেশ্বর মাথা মৃদু-মৃদু ডাইনে-বাঁয়ে নেড়ে বলে, “না না, ভুলই হয়েছে বলে ধরে নাও, দিনুর তো এখানে হাজির হওয়ার কথা নয়। তার নামে চৌদ্দটা খুনের মামলা ঝুলেছে। কয়েদ আছে আজ প্রায় সাত মাস। ফাঁসি তার হবেই। সে এখানে আসবে কী করে?”

জগা হাঁ হয়ে গেল। “দিনু? দিনু মানে যদি দিনু হালদার হয়ে থাকে, তা হলে যে সর্বনাশ! মথুরাপুরের দিনুর নামে পুলিশ দারোগারও কম্প ওঠে।”

পাগলু একটু ক্ষীণ গলায় বলল, “আর যদি ভুল না দেখে থাকেন? যদি লোকটা দিনুই হয়ে থাকে?”

গোপেশ্বর একটু গম্ভীর হয়ে বলে, “তা হলে বড় ভয়ের কথা হে ভায়া বড়ই ভয়ের কথা। দিনু যদি কাউকে ধরে তবে তার রক্ষে নেই। কিন্তু সে তো এখন হাজতে—চোখের ভুলই হবে ।”

জগা কচুমাচু হয়ে বলে, “আমার কিন্তু দোষ নেই মশাই। আমি হাটে কচুর দর করছিলুম। এমন সময়ে ঘটোৎকচের মতো লোকটা এসে আমাকে ধরল। আমি দিনু হালদারকে কস্মিনকালেও চিনি না।”

গোপেশ্বর জিভ দিয়ে একটা চুকচুক শব্দ করে বলল, “আহা, দোষটা তোমাকে দিচ্ছে কে? হাটে হাজারো লোক আসে, কে ভাল কে মন্দ তা চেনা কি চাট্টিখানি কথা? তবে লোকটা তোমাকে বলছিল কী?”

মাথা নেড়ে জগা বলল, “সে আমার ঠিক স্মরণ হচ্ছে না।”

“তা হলে তো বড়ই দুঃখের কথা ভায়া। স্মরণ না হলে যে অনেক সময়ে ব্যাপার কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। কুশল প্রশ্নই করছিল নাকি ষণ্ডাটা?”

আজ্ঞে তাও হতে পারে। খিদের চোটে তখন আমার মাথাটা ভাল কাজ করছিল না কিনা। কী সব যেন বলছিল।”

গলাটা যেন আরও মেজে ঘষে, আরও মোলায়েম করে গোপেশ্বর বলল, “কথাটা কী জান ? একটা কানাঘুষো যেন শুনছিলাম দুদিন আগে। কুসুমপুরে এক যজমান বাড়িতেই যেন শুনছিলুম, পাঁচজন বলাবলি করছে, দিনু হালদার গরাদ ভেঙে পালিয়েছে। তখন কথাটা বিশ্বাস হয়নি।”

পাগলু বলল, “আরও একটু খোলসা করে বলুন বাবাজি।”

গোপেশ্বর নিমীলিতনয়নে কিছুক্ষণ দুয়ের দিকে চেয়ে থেকে বলল, “পাপে পৃথিবীটা একেবারে ভরাভর্তি হয়ে গেল হে।”

“আক্তে যা বলেছেন, পাপ ছাড়া আর আছেটাই বা কী ? তা দিনু হালদারের বৃত্তান্তটা কী বাবাজি?”

“যে মুখে হরিকথা কই, সেই মুখে এসব কথা কইতে বড় ঘেন্না হয় হে।”

“আজ্ঞে তা তো বটেই।”

“দিনুর তিনকুলে থাকার মধ্যে আছে এক মামা। দাসপুকুরে বাড়ি। একসময়ে অবস্থা ভালই ছিল। এখনও নেই-নেই করে ধরে তো প্রায় লাখ বিশেক টাকার সোনাদানা আছে। ওয়ারিশ আছে মেলাই। হরিপদ দাসের নিজের ছেলেপুলে নেই, স্ত্রীও গত হয়েছে কয়েক বছর। মরলে সম্পত্তি পাওয়ার কথা তার ভাইপোদের। কিন্তু মুশকিল হল, হরিপদর অত সোনাদানা কোথায় আছে তার হদিস কেউ জানে না।”

জগার চোখ দুটো একটু জ্বলজ্বল করে উঠল। সে তাড়াতাড়ি বলে উঠল, “লুকিয়ে রেখেছে নকি?”

“চারদিকে চোর ডাকাতের যা উপদ্রব, না লুকিয়ে উপায়ই বা কী বলো!”

জগা বলল, “তা বটে।”

গোপেশ্বর বলল, “হরিপদ দাসের বিরাট বাড়ি, খুবই পুরনো। সেই বাড়ির একতলায় হরিপদ দাস একখানা মস্ত ঘরে থাকে। লোকের বিশ্বাস, ওই ঘরেই সোনাদানা সব আছে। কিন্তু হরিপদ কস্মিনকালেও সেই ঘরে কাউকে ঢুকতে দেয় না। নিজেও ঘরের বাইরে বড় একটা আসে না। তার সাত-আটটা শিকারি কুকুর আর গোটা দশেক হলো বেড়াল আছে। আর আছে বাহাদুর নামে একজন পুরনো বিশ্বাসী কাজের লোক। তারাই বাড়ি পাহারা দেয়। কাকপক্ষীও ঢুকতে পারে না।”

জগা ফস করে বলল, “হরিপদবাবুর বয়সটা কিরকম হল বলতে পারেন?”

“তা পারি। চুরানব্বই পুরে এই পঁচানব্বই না। তবে বুড়ো বলে জরাজীর্ণ ভেবো না। হরিপদ দাস এখনও বেশ সক্ষম মানুষ। দাঁত পড়েনি, চুলও পাকেনি। শোনা যায়, এখনও নাকি সকালে মুগুর ভাঁজেন। হেসেখেলে একশো পেরোবেন। আর সেইজন্যই দিনু কিন্তু বড় উতলা হয়ে পড়েছে।”

পাগলু বলল, “কারণটা কী ?”

“মামা মরলেও তার কোনও আশা নেই। কারণ আইনত সে সম্পত্তি পায় না। সে ফিকির করছে মামাকে যদি দুনিয়া থেকে সরাতে পারে তা হলে সোনাদান গাপ করা সহজ হয়। বলে রাখি ভায়ারা, দিনু বড় পাপী লোক।”

পাগলু বলে ওঠে, “যে আজ্ঞে, সে আর বলতে।”

“আর একথাটাও জেনে রাখো, হরিপদ দাসও বিশেষ ভাল লোক নয়। সুদখোর মানুষ, চিরকাল গরিবকে ঠকিয়ে টাকা করেছে। কত বিধবার শেষ সম্বল যে ঠকিয়ে নিয়েছে তার লেখাজোখা নেই। দিনুর উপযুক্ত মামাই বটে। একেবারে শঠে শঠ্যাং । আমি বলি কী, দিনু যদি তার মামাকে মারতেই চায় তো মারুক। কিন্তু তোমরা ওর মধ্যে থেকে না।”

জগা বলে উঠল, “আজ্ঞে না। কখনওই না।”

“শোনো বাপু, দিনুর বৃত্তান্ত বলতে আমার আসা নয়। আমার আরও কিছু কথা আছে।”

পাগলু বলে, “কী কথা বাবাজি ?”

“কথা শূলপাণিকে নিয়ে।”

গোপেশ্বরের মুখে শূলপাণির নাম শুনে জগা আর পাগলু একটু মুখ তাকাতাকি করে নিল। তারপর পাগলু খুব অমায়িক গলায় বলল, “আজ্ঞে কথাটা কী?”

গোপেশ্বর ততোধিক অমায়িক মোলয়েম গলায় বলল, “আহা, পাগল মানুষটাকে যে কে গুম করে ফেলল! তোমরা জানো নাকি কিছু ভায়ারা?”

দুজনেই সমস্বরে বলে ওঠে, কিছু না। কিছু না।

গোপেশ্বর মৃদু হেসে বলল, জ্ঞানের চেয়ে অজ্ঞানতাই কখনও সখনও ভাল বলে মনে হয়. যত না জানা যায় ততই বিপদের ভয় কম, কে আর ঝঞ্ঝাটে জড়াতে চায় বলো!

দুজনেই বলল, ঠিক কথা। তবু জিজ্ঞেস করছি কেন বলো? তোমরা দুটি তো সব বাড়িতেই রাতবিরেতে হানা দাও। অনেক সময়ে আড়ি পেতে ভেতরকার গুহ্য কথাও শুনে ফেল। অনেকের হাঁড়ির খবর তোমাদের একেবারে নখদর্পণে । তাই না?

জগা লজ্জিত হয়ে ঘাড়টাড় চুলকে বলে, না না, কী যে বলেন। সামান্য মানুষ আমরা।

গোপেশ্বর মাথা নেড়ে বলে, আহা, অত বিনয় করতে হবে না। তোমরা যে কাজের লোক তা আমি ভালই জানি।

যে আজ্ঞে। শোনো ভায়ারা, শূলপাণি হঠাৎ যেন গায়েব হয়ে গেল সেই কথাটা আমার জানা দরকার।

পাগলু মাথা নেড়ে বলে, আজ্ঞে আমরা কাজটা করিনি। ছোটোখাটো চুরি-ছ্যাচড়ামি করে থাকি বটে, কিন্তু গুম বা খুনটুন আমাদের লাইনের ব্যাপার নয়।

কাজটা যে তোমরা করেছে এমন কথা আমি স্বপ্নেও ভাবিনি। বলছি কি, শূলপাণির ঘরে কখনও হানাটানা দিয়েছে?

গল্পের দশম তম অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন

সম্পর্কিত পোস্ট

দুঃখিত!