হরিপুরের হরেক কান্ড– দশম তম পর্ব-শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়

গল্পের একাদশ তম অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন।

জগা বলল, আজ্ঞে না। ওখানে গিয়ে হবেটা কী? শূলপাণি পাগল মানুষ, কুকুর-বেড়াল নিয়ে থাকত, তার বাড়িতে হানা দিয়ে হবে কোন লবডঙ্কা ?

তা বটে। কিন্তু শূলপাণি যে নিয্যস পাগল একথাটা আমার প্রত্যয় হয় না। আমার বরাবরই মনে হয়েছে শূলপাণি একজন সাজা পাগল।

পাগলু অবাক হয়ে বলে, বটে ! তাহলে তো আপনি আমাদের চেয়ে অনেক বেশি খবর রাখেন।

খবর তুমিও বড় কম রাখো না।

পাগলু একটু তেড়িয়া হয়ে বলে, তার মানে?

মানে আমার চেয়েও তোমাদের আরও বেশি খবর রাখার কথা। তোমাদের দুজনেরই শূলপাণির বাড়িতে রীতিমতো যাতায়াত ছিল। আমার স্বচক্ষে দেখা। অস্বীকার করে লাভ নেই।

জগা আর পাগলু ফের একটু মুখ তাকাতাকি করে নেয়। তারপর পাগলু গলাটা একটু নামিয়ে বলে, সে ঠিক কথা, আমরা ভাবতুম সে মস্ত ম্যাজিসিয়ান, কোন বিপদে কখন কোন কাজে লাগে কে জানে। তাই ম্যাজিক শিখতে কিছুদিন যেতুম বটে।

শূলপাণি তোমাদের কী ম্যাজিক শেখাতো?

জগা রেগে উঠে বলল, কিছু না মশাই, কিছু না। আমরা গেলেই সে অংবং করে কী সব বলত, মুখ ভাঙাতো, অঙ্গভঙ্গি করত, দু-চারবার ঠ্যাঙা নিয়ে তাড়াও করেছে।

বটে, এ তো খুব অন্যায় কথা!

অন্যায় বলে অন্যায় ! তাকে খুশি করার জন্য ধারকর্জ করে বনমালীর তেলেভাজা, আসগরের চপ, গোবিন্দপুরের দৈ কতবার ভেট নিয়ে গেছি। তা উনি সেসব বেশ জুৎ করেই খেতেন, কিন্তু শেখানোর বেলায় লবডঙ্কা।

কিন্তু বাপু, কথাটা হল সে যে ম্যাজিক জানে একথাটা তোমাদের বলল কে?

জগা মাথা চুলকে বলল, অনেকেই বলাবলি করত, ওরকম ধারা খ্যাপাটে মানুষেরা কিছু না কিছু গুপ্তবিদ্যে জানেই মশাই, হাটে-বাজারে লোকে বলাবলি করত শূলপাণি নাকি রাত-বিরেতে পাখির মতো আকাশে উড়ে বেড়ায়, তার বাড়িতে নাকি জিন-পরি-ভূতপ্রেত নিত্যি আসা-যাওয়া করে।

তুমি নিজে কি কিছু দেখেছে?

মাথা নেড়ে জগা বলে, না মশাই, আমাদের যে কিছু দেখাত না। আমরা গেলেই পাগল সাজত।

আচ্ছা, একটা কথা।

বলুন।

রাত আটটার সময় শূলপাণি যে অট্টহাসিটা হাসত সেটা কখনও শুনেছো ?

শুনব না? রোজ শুনতুম। গাঁশুদ্ধ লোকও শুনত।

যে সময়ে সে হাসত সে সময়ে কখনও তার কাছে ছিলে?

যে আজ্ঞে |

কি রকম ভাবে হাসত একটু বলবে?

আজ্ঞে সে বড় বিদঘুটে হাসি। শুনে পিলে চমকে যেত। প্রথম দিন ওই হাসি শুনে তো আমার মূৰ্ছা যাওয়ার জোগাড়।

কেন হাসত তা জানো?

আজ্ঞে না ।

কখনও জিজ্ঞেস করেছিলে?

তা করেছিলুম। প্রথম দিন যখন সন্ধের মুখে তাঁর কাছে যাই তখন খানকতক গরম গরম জিবেগজা নিয়ে গিয়েছিলুম। তা উনি জিবেগজা খেতে খেতে বিড়বিড় করে কী যেন বলছিলেন। চোখ দুটো আধবোজা, একটু একটু দুলছেন বসে বসে। আমি হাতজোড় করে সামনেই বসে আছি। হঠাৎ যেন ভূমিকম্পের মতো কী একটা হয়ে গেল। বললে বিশ্বাস করবেন না। ঠিক যেন নাভি থেকে শব্দটা ওঁর গলায় উঠে এল। এমন দমকা লহর তোলা হাসি জীবনে শুনিনি বাবা। ভিরমি খেয়েছিলাম মনে আছে। তারপর চেতন হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, বাবাজী, এটা কী হল ?

তা উনি কী বললেন ?

বলাটলার ধার ধারতেন নাকি? শুধু একবার কটমট করে তাকালেন।

কেন হাসত তা ঠাহর করেছে কখনও?

মাথা নেড়ে জগা বলল, আজ্ঞে না !

তোমরা কি জানো যে শূলপাণি একেবারে ঘড়ি ধরে ঠিক রাত আটটার সময়ে হাসিটা হাসত, কখনও এক চুল এদিক-সেদিক হত না? পাগলু বলল, আজ্ঞে সেরকমই শুনেছি। কিন্তু আমাদের তো আর ঘড়ি নেই যে মিলিয়ে দেখব।

গলাটা আরও এক পর্দা নামিয়ে গোপেশ্বর বলল, আরও একটা কথা ভায়ারা। শূলপাণির বাড়ি থেকে নাকি লাল নীল সবুজ ধোঁয়া বেরোতো তোমরা দেখেছো নাকি?

দুজনেই মাথা নেড়ে বলল, আজ্ঞে না।

আচ্ছা, ধোঁয়া নয় না-ই দেখলে, আর কিছু দেখনি? চোখে লাগে এমন কিছু?

জগা ফস করে বলে ওঠে, অনেকক্ষণ ধরে বকাচ্ছেন মশাই। আমাদের তো সময়ের একটা দাম আছে।

গোপেশ্বর ভারি অমায়িক হেসে বলে, তা আছে ভায়ারা, তা অবশ্যই আছে। একটু আগেই যেন দেখলুম। আমাদের জগা ভায়া দিনুর কাছ থেকে কড়কড়ে দুশো টাকা পে ! তা সেটাও কি ওই সময়েরই দাম নাকি?

জগা একটু দমে গেল। বলল, ঠিক আছে, যা জিজ্ঞেস করার করুন, তবে সময় বেশি নেবেন না। বেলা চড়ছে, আমাদের বিষয়কর্ম পড়ে আছে কিনা।

জানি বাপু, তুমি বড্ড কাজের লোক। তা বলি কখনও শূলপাণির কাছে কাউকে যাতায়াত করতে দেখনি?

তা দেখব না কেন? শূলপাণি বাবাজীর কাছে সবাই যেত। এমন কি গোঁসাই, আপনিও যেতেন। কতদিন দেখেছি আপনি আর জটেশ্বরদাদা মুড়িসুড়ি দিয়ে গভীর রাতের দিকে বাবাজীর ডেরায় গিয়ে সেঁধোচ্ছেন।

আহা, আমরা গাঁয়ের লোক, তার ভালমন্দের খোঁজ নিতে যেতুম আর কি ! আমাদের কথা হচ্ছে না। বাইরের কেউ আসত? অচেনা মানুষজন?

তাও আসত। তবে কার কথা জানতে চান সেইটে খোলসা করে বলুন।

ইয়ে ধরে যদি বলি একজন খুব বেঁটেখাটো লোক?

জগা আর পাগলু ফের মুখ তাকাতাকি করে নেয়। জগা বলল, তা নানা সাইজেরই আসত। বেঁটে, লম্বা, মোটা, রোগা, কালো, ধলা।

আমি একজন বিশেষ বেঁটে লোকের কথা বলছি।

পাগলু বলল, বড্ড খিদে পেয়ে গেল যে গোঁসাই ! এই অবস্থায় তো কথা চলে না।

গোপেশ্বর গম্ভীর হয়ে বলে, তাই বুঝি? বলি কথাটা ভাঙবার জন্য ঘুষ চাও নাকি? ঠিক আছে, দিনুর কাছ থেকে যে টাকা খেয়েছো সেটা নগেন দারোগার কানে তুলে দেবোখন। নগেন দারোগা রিটায়ার করলে কী হয় এখনও পাপীতাপীর যম।

পাগলু খিক করে একটু হেসে বলল, সে আপনার ইচ্ছে হলে বলুন গে। আর ইদিকে আমরাও কথাটা একটু দিনুর কাছে নিবেদন করে দেবোখন যে, আপনি আমাদের ভয়টয় দেখাচ্ছেন।

গোপেশ্বর গম্ভীর হয়ে বলল, প্যাচ কষছে ভায়ারা?

তা আপনি কষলে আমাদেরও কষতে হয়।

গোপেশ্বর ফের মোলায়েম হয়ে বলে, দারোগাবাবুকে বলে দেবো বলেছিলাম, তা সে কথাটা ধোরো না। আসলে কী জানো, খবর পেয়েছি। একটা বেঁটেমতো লোক শূলপাণির কাছে খুব যাতায়াত করত। শূলপাণির গুম হওয়ার পেছনে তার হাত থাকতে পারে।

জগা বলল, গুমটুম বাজে কথা। শূলপাণি বাবাজীর আর এখানে পোষাচ্ছিল না, তিনি হিমালয়ে গিয়ে সাধু হয়েছেন বলেই লোকের বিশ্বাস।

গোপেশ্বর খানিকক্ষণ চিন্তিতভাবে বসে থেকে হঠাৎ বলল, জিলিপি খাবে নাকি ভায়ারা? তা এই নাও পাঁচটি টাকা। আমি গরিব মানুষ, এর বেশি পেরে উঠব না। এতে কি হবে?

জগা ঘাড় হেলিয়ে বলল, হয়ে যাবে কোনওরকমে, কী বলো পাগলুদাদা ?

পাগলু বিরক্ত হয়ে বলল, তোর বড্ড ছোটো নজর রে জগা। আহা বেষ্টম মানুষ, যা দিচ্ছেন নিয়েই নাও।

পাগলু অনিচ্ছুক হাতে টাকাটা নিয়ে ট্যাকে গুজে বলল, বেঁটে লোকটাকে আপনার কিসের দরকার?

বেঁটে বলে তাকে অবহেলা কোরো না ভায়ারা। তার নামে একটা তল্লাট কাঁপে। ছোটোখাটা মানুষ হলে কি হয়, সে হল অ্যাটম বোম। তার নাম হল নিতাই পাল। চেনো

একগাল হেসে পাগলু বলল, নিতাই পালকে চিনব না! তবে তিনি যে এত ভয়ঙ্কর লোক তা জানা ছিল না।অনেক কিছুই তোমাদের জানা নেই ভায়া।

তা নিতাই আসত?

প্রায়ই আসতেন। কী সব গুজগুজ ফুসফুস কথাও হত দুজনের মধ্যে।

বটে !

আজ্ঞে । সাতগাঁ না কোথায় যেন বাড়ি।

সাতগাঁয়েই।

আপনি কি তাকে চেনেন গোঁসাই?

চিনি মানে ওই আর কি। মুখ চেনা বলতে পারো। কথাটা হল, নিতাই পালকে একটু ফিট না করলেই নয়। তাকে চেপে ধরলে শূলপাণির খবর পাওয়া যাবে। আর শূলপাণির খবর পেলে সরলাবুড়ির গুপ্তধনেরও হদিস মিলবে।

জগা হেসে উঠে বলল, গোঁসাই গুপ্তধনের স্বপ্ন দেখছেন। ওসব বাজে কথা। সরলাবুড়ির বাড়ি আমরা অতিপতি করে খুঁজে দেখেছি। গুপ্তধন নেই।

আলবাৎ আছে। অন্তত দু ঘড়া মোহর।

 

গল্পের একাদশ তম অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন।

 

 

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

দুঃখিত!