গল্পের চর্তুদশ অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন
রামহরি আসলে সাহসী মানুষ, বন্ধ ঘরের ভেতর থেকে কথার আওয়াজ পেয়ে প্রথমটায় ভয় খেলেও সামলে গেলেন। তারপর জানালার বন্ধ পাল্লায় গিয়ে কান পাতলেন, ঝড়-বৃষ্টির শব্দে প্রথমটায় কিছু শুনতে পেলেন না। কিন্তু প্রাণপণ মনঃসংযোগ করে থাকার ফলে একটু বাদে শুনতে পেলেন, কে যেন কাকে বলছে, “হাঁ হাঁ বাবু ও বাত তো ঠিক আছে, কসুর হই গিছে বাবু। হামি সমঝলাম কি বহোত দিন বাদে ইস তরফ যখন এসেই গেছি তখন বুড়ি মায়ের সঙ্গে একটু বাতচিত করিয়ে যাই। উসি লিয়ে—”
অন্য গলাটা বাঘা গর্জন করে উঠল, “চোপ বেয়াদব, ফের মিছে কথা হচ্ছে! বুড়িমাকে তুই চিনতিস ? তুই তো ঢুকেছিলি চুরি করতে! ”
অন্য গলাটিতে বিনয় ঝরে পড়ল, “নেই মালিক চোরি ওরি হামার কাম নেই। হামি তো মুলকমে চাষবাস করে খাই।”
“চোর যদি না হোস তবে ওই সিদটা কেটেছে কে ?”
কই চোর টােরের কাম হোবে হুজৌর। শিয়াল ভি হোতে পারে। হামি উসব কাজ জানি না মালিক ”।
“না তুমি ভাজা মাছটি উলটে খেতে জানো না তা বুঝেছি। কিন্তু তোর হাতে যে মাটির দাগ লেগে আছে, পায়ের কাছে যে সিঁদকাটি পড়ে আছে এগুলো কোথেকে এল?”
“উরে বাপ ! এটা কি সিঁদকাটুয়া আছে নাকি বাবু ? এইরকম চিজ তো হামি কখুন দেখি নাই! হুজুর মালুম হয়েছে কি কোনই চোর চোট্টা-বদমাশ জরুর ঘুসিয়ে কোথা ছিপকে বৈসে আছে। ঢুঁড়লে উসকো মিলে যাবে।”
“হ্যাঁ, তুমি বড় সাধুপুরুষ। এখন বল তোকে যদি মেরে পুঁতে ফেলি তাহলে কেমন হয়?”
“খুব খারাপ হোবে মালিক, হামি ভালা আদমি আছে।”
“তুই ওই সিঁদ দিয়ে ঢুকেছিস। নইলে তোর গায়ে অত কাদামাটি লেগে আছে কেন?”
“ওই বাত ঠিক আছে মালিক। বহোত দিন বাদ ইদিকে আসলাম তো ভাবলাম কি বুড়িমার সঙ্গে একটু মুলাকাত করে যাই। দরওয়াজা বন্ধ দেখে বুড়ি মা বুড়ি-মা বোলকে চিল্লমিল্লি কোরে দেখলাম কোই আওয়াজ নেই। তখুন কোঠিকে পিছে এসে দেখলাম ই গোর্তটা আছে। তখুন ভাবলাম কি বুড়িমার জরুর কোই তকলিফ হোচ্ছে। উস লিয়ে গোর্তোর ভেতর দিয়ে ঢুকে আসলাম। ”
মোটা গলার লোকটা হাঃ হাঃ করে অট্টহাসি হেসে বলল, “বটে ! তোর মনটা দেখছি ভারি নরম। এখন বল তো, বুড়িমাকে তুই চিনতিস ?”
“হাঁ হাঁ, জরুর। বুড়ি মা বহুৎ ভাল আদমি ছিলেন।”
“তোর সঙ্গে কী করে আলাপ হল ?”
“হামি বুড়িমার কাজ-কাম কুছ কোরে দিতাম। লাকড়ি কেটে দিতাম, পানি তুলে দিতাম, বাতচিত ভি হোতো।”
“কী বাতচিত হত ?”
“কোই খাস বাত নেই, বুড়ি মা পুছ করতেন, বেটা রামপ্রসাদ, তোহার মতো আইসা আচ্ছা লেড়কার ইতনা মুসিববত কাছে? আশমানে ভগবান যদি থাকেন তো তেরা ভি একদিন ডাল গলেগা। হ্যাঁ হ্যাঁ, কুছু হোবে তোর রামপ্রসাদ । এই বুড়িমার আশীৰ্বাদ তোহার ভালা হি কোরবে ।”
“বটে ! বুড়ি মা তোকে আশীর্বাদ করত। আর তার জন্যই তুই বুড়িমার ঘরে সিদ কাটলি ?”
“ছিঃ ছিঃ হুজুর, সিঁদ তো আর কোই কাটিয়েছে, হামি তো শুধু ঘুসেছি।”
“কেন ঘুসেছিস সত্যি করে বল। নইলে এই যে ভোজালি দেখছিস এটা তোর পেটে ঢুকে যাবে।”
“রাম রাম বাবুজি, উসব ভোজালি-উজালি খুব খারাপ জিনিস আছে। রামপ্রসাদ ছোটমোটা আদমি আছে, ছুছুন্দর মারিয়ে হাতমে গোন্ধো কাহে করবেন?”
হাত গন্ধ করতে আমার আপত্তি নেই। এখন খোলসা করে বল তো, কী খুঁজতে এখানে ঢুকেছিলি?”
“হনুমানজিকি কিরিয়া হুজুর, মতলব কুছু খারাপ ছিল না। বুড়িমার আশীৰ্বাদ লিব বলে একবার এসেছি। কাম কাজ কুছু খারাপ যাচ্ছে।”
“চোপ ব্যাটা ! ফের মিথ্যে কথা !”
পটাং করে একটা থাপ্পড়ের শব্দ শুনে বাইরে রামহরি চমকে উঠলেন, থাপ্পড়টার যেন বাজের মতোই আওয়াজ হল।
“মর গয়া বাপ রে! ”
“এবার বল ব্যাটা। নইলে—”
“আচ্ছা, আচ্ছা, বলছি মালিক, ইতনা জোর বাপটা নেই খায় হুজুর ”
“এবার বলবি? না ফের একটা বসাতে হবে?”
“নেহি হুজুর, আউর নেহি, আমি ঘুসেছিলাম একটা জিনিস একটু ঢুঁড়তে ”
“কী জিনিস ?”
“কোই খাস জিনিস না আছে বাবুজি। একটা বাক্স।”
“বাক্স ! তাতে কী আছে ?”
“সে হামি জানি না। তবে বাক্সটা বুড়ি মা চোরাই করিয়ে লিয়ে এসেছিলেন।”
“চুরি করে? কে বলল তোকে?”
“যৌন চুরি করিয়েছিল উসি আদমি বোলা মালিক ”
“সে কে?”
“নাম বললে আপনি চিনবেন?”
“বলেই দ্যাখ না।”
“একটার নাম ছিল ফটিক আর দুসরার নাম ছিল ফিচকে।
“ফটিক আর ফিচকে? কই এরকম নামে তো কাউকে চিনি না।”
দেখে চিনবেন মালিক, দোনো চোর ছিল।”
মিছে কথা বলছিস না তো ?”
“সীতা ময়িকি কিরিয়া, মালিক, ঝুট কিঁউ বোলবে?”
“বাক্সে কী ছিল?”
“কিসকো মালুম ? কোই খাস চিজ হোতে পারে। ওই দেখনেকে নিয়ে এসেছিলাম তো এসে দেখি আপনি ঘোরের মধ্যে বসিয়ে আছেন। রাম রাম বাবুজি, হামি তাহলে এখুন আসি ?”
ফের সেই হাঃ হাঃ অট্টহাসি। তারপর গর্জন আমাকে “বোকা ঠাওয়ালি নাকি রে রামপ্রসাদ? এত সহজে ছাড়া পাবি ভেবেছিস? আগে কথা ওগরা, ওই বাক্সে কী ছিল বল, নইলে-”
“হাঁ হাঁ পরেসান কেন হোবেন হুজুর? ফিন ঝাপটা মারলে হামি তো মরিয়ে যাবে।”
“তাহলে ভালয় ভালয় বলে ফ্যাল
“হুজুর কসুর মাফ করিয়ে দিবেন, ফটিক হামাকে বলেছিল কি বাক্সের মধ্যে কুছ তামাক পয়সা আর কড়ি ছিল। কুছ খাস চিজ নেহি। বুড়ি মা উন দো চোরকো দেশে রুপিয়া বকশিশ দিয়েছিল। স্রিফ কড়ি আর পয়সাকা লিয়ে বুড়ি মা কেন দো শো রুপেয়া বকশিশ দিয়েছিল ওহি পুছনেকে লিয়ে হামি এসেছিলাম।”
“সেটা তো আমারও জানা দরকার। সাতটা পয়সা আর সাতটা কড়ির জন্য সরলা পিসি এত উতলা হয়েছিল কেন। তুই কিছু জানিস না ?”
“নাহি মালিক, রামপ্রসাদ বুরবাক আদমি আছে।”
“কেমন বুরবাক তা বুঝতেই পারছি। তা বাক্সটা সরাল কে তা জানিস ?”
“নেহি মালিক, হামি তো মুলুকে চালিয়ে গিয়েছিলাম।”
“কত দিন আগে?”
“চার-পাঁচ বরস হোবে, গুস্তাকি মাফ করবেন বাবুজি, বাক্সটা কুথায়?”
“কোথায় তা জানলে কি আর বসে আছিরে ব্যাটা? তন্নতন্ন করে খুঁজে কোথাও পাইনি। যে সরিয়েছে তাকে হাতের কাছে পেলে ধড় আর মুণ্ডু আলাদা করতাম।”
“হজুর একটা বাত বলব?”
“বল ”
“রাত হোয়ে আসছে। আধিয়ারি মে হামি কুছু ভাল দেখতে পাই না। আমাকে আভি ছোড়িয়ে দিন। বরখা ভি হোচ্ছে। ভুখ ভি লাগা হ্যায়।”
“বটে! পালাতে চাস ? দাঁড়া, আমার একটা স্যাঙাৎ এখনই এসে পড়বে। সে এলে তোর বিচার হবে। তারপর ভেবে দেখব তোকে ছাড়া যায় কি না।”
রামহরি একটু ভূ কুঁচকে ভাবলেন, সরলা পিসির বন্ধ ঘরে যে নাটকটা হচ্ছে তার কুশীলবকে একটু স্বচক্ষে না দেখলে তিনি স্বস্তি পাচ্ছেন না। কিন্তু কুট করে ঢুকবার পথ নেই। আর ঢুকলেও যে বিপদ হবে না তাকে বলতে পারে? ঠিক এই সময়ে রামহরির হঠাৎ মনে হল, তার পেছনে কেউ দাঁড়িয়ে আছে, একবার ঘাড় ঘোরালেন রামহরি, কিন্তু ঘুটঘুটি অন্ধকারে কিছু ঠাহর হল না। বৃষ্টির তোড় আর বাতাসের জোর দুই-ই বাড়ছে। রামহরি অস্বস্তি বোধ করতে লাগলেন, দু-একবার বিদ্যুৎ চমকাল বটে, কিন্তু সে আলোতে কাউকে দেখা গেল না।
গল্পের চর্তুদশ অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন।
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।