হযরত হুদ (আঃ)
হযরত নূহ (আঃ) এর যুগ থেকে হযরত ইব্রাহিম (আঃ) এর যুগের পূর্ব পর্যন্ত মোট দু হাজার দুশ বছরের মধ্যে আল্লাহ্ তায়ালার পক্ষ হতে দুনিয়াতে মাত্র দুজন নবীর আগমন ঘটেছিল- একজন হযরত হুদ (আঃ) ও অপর জন হযরত ছালেহ (আঃ) ।
হযরত নূহ (আঃ)-এর বংশধরদের মধ্যে আদ নামক এক শক্তিশালী ক্ষমতাবান বাদশা সে যুগে দ্বিতীয় আর কেউ ছিল না। এ বাদশাহর সন্তান সন্ততি ও বংশধররা সর্বদিক দিয়ে শক্তিমান ও প্রতাপশালী ছিল। এ বাদশাহ আদের নামানুসারে এ সম্পদায়ের লোকেরা কওমে আদ বা আদবংশীয় লোক নামে খ্যাত। এদের মধ্যে অনেকের দেহের উচ্চতা ছিল চারশ গজ। এদের মধ্যম শ্রেণীর লোকদের উচ্চতাও ছিল দুশ গজ। এদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা বেটে ছিল যারা তাদের দেহের উচ্চতা ছিল সত্তর গজ। এরা সকলে অত্যন্ত সাহসী ও শক্তিশালী ছিল। আর এ সাহস ও শক্তিমত্তার গৌরবে তারা আল্লাহ্ ও তার নবীকে ভুলে গিয়েছিল। এরা কোনরূপ সৎকর্মের তোয়াক্কা তো করতই না বরং ইবলিসের কু-পরামর্শে দেবদেবীসমুহকে উপাস্য মনে করে তাদের প্রতিমা তৈরি করে তার উপাসনা করত।
আদ সস্প্রদায়ের মধ্যে যখন এ অবস্থা প্রবল আকার ধারন করল, তখন তাদেরকে হিদায়েতের জন্য আল্লাহ্ তায়ালা কওমে আদ সস্প্রদায়ের মধ্যে হতেই হুদ (আঃ) কে নবীরুপে প্রেরণ করলেন।
আল্লাহ্ তায়ালা বললেন, আদ জাতির প্রতি তাদেরই ভাই হুদকে আমি নবীরূপে প্রেরণ করেছিলাম। সে বলল, হে আমার কওম! তোমার এক আল্লাহ্র ইবাদাত কর, তিনি ছাড়া তোমাদের আর কোন ইলাহ নেই। তোমরা এক আল্লাহ্র ইবাদাত কর, তিনি ছাড়া তোমাদের আর কোন ইলাহ নেই। তোমরা এখন কেবল মিথ্যার উপরে আছ। (সূরা হুদঃ আয়াত ৫০)
পবিত্র কোরআনে আল্লাহ্ তায়ালা এর পরবর্তী ঘটনা উল্লেখ করেছেন-
আদ সম্প্রদায় রাসূলদের মিথ্যা জেনেছে। যখন তাদের ভাই হুদ তাদেরকে বলল, তোমরা কি আল্লাহকে ভয় কর না? আমি তোমাদের জন্য বিশ্বস্ত রাসূল। সুতরাং তোমরা আল্লাহ্কে ভয় কর এবং আমার আনুগত্য কর (সূরা শুআরা আয়াত ১২৩-১২৬)
এভাবে হুদ (আঃ) আদ সম্প্রদায়কে আল্লাহ্র পথে ডাকতে লাগলেন। তিনি তাদেরকে লক্ষ্য করে বলতেন
আর স্মরণ কর যখন নুহ-এর সম্প্রদায়ের পরে তিনি তোমাদেরকেই সরদারী (নেতৃত্ব) দান করেছেন ও যথেষ্ট শক্তি সামর্থ দিয়েছেন। অতএব তোমরা আল্লাহ্ তায়ালাকে স্মরণ কর। তোমাদের কল্যাণ হবে।
হযরত হুদ (আঃ) এর এ আহ্বানের জবাবে আদ সম্প্রদায় যা বলত পবিত্র কোরআনের ভাষায় তা এ রূপ
বলল, হে হুদ! তুমি কোন উজ্জ্বল দলিল পত্র নিয়ে আসনি। আমরা শুধু মাত্র তোমার কথায়ই আমাদের দেবতাদের ছেড়ে দিতে পারি না এবং তোমার কোথায় বিশ্বাসও আনতেও পারি না।
হযরত হুদ (আঃ) দীর্ঘদিন ধরে তাদেরকে হিদায়েতের পথে আনার জন্য প্রাণপ্রণ প্রচেষ্টা চালাতেন। কিন্তু তাতে মাত্র সত্তরজন লোককে তিনি কোনরূপ হিদায়েত করাতে সক্ষম হলেন। আর যারা হিদায়েত পেল তারাও কাফেরদের ভয়ে গোপনে আল্লাহ্র ইবাদত করত, প্রকাশ্য ইবাদত করতে সাহস পেত না।
এমনিভাবে তারা হুদ (আঃ)-এর আহ্বানে সাড়া না দিয়ে তার বিরোধিতার এত বেড়ে গেল যে, শেষ পর্যন্ত তারা তাকে উন্মাদ বলতেও দ্বিধাবোধ করল না। তারা বলতে লাগল, হে হুদ! তুমি আমাদের উপাস্য দেবতাগুলোকে যখন গালিগালাজ করতে লাগলে আর এদের পূজা করা হতে ফিরে থাকার জন্য বলতে লাগলে তখন থেকেই তোমার মস্তিস্কে বিকৃতি এসেছে। সকল দেবদেবীর প্রতিমার বদদোয়ায় তুমি উন্মাদ হয়ে গিয়াছ।
তাদের এ ঔদ্বত্য মূলক আচরণ এমন পর্যায়ে পৌছাল যে, হযরত হুদ (আঃ)-এর কথার প্রতি কর্ণপাত করতে তাদের মধ্যে আর কেউ রাজী নয় এবং তার উপদেশ ও নসিহত মনোযোগ দিয়া শুনতেও প্রস্তুত নয়। তখন তিনি তাদেরকে বলেন, আমি আল্লাহ্কে এবং তোমাদের সকলকে সাক্ষী রেখে ঘোষণা করছি যে, তোমাদের প্রতিমাগুলো না কারো বিন্দু পরিমাণ উপকার করতে পারে না, আর না অপকার করতে পারে। না আছে সামান্যতম শক্তি আর না আছে সামর্থ। অতঃপর তোমাদের ও তোমাদের মূর্তিগুলোর প্রতি আমার ঘোষণা-আমার কোন প্রকার ক্ষতি করার সামান্যতম শক্তিও এদের থাকলে এরা যেন আমার ক্ষতি সাধন করে। আমি আল্লাহর অনুগ্রহে সম্পূর্ণ সুস্থ। আমার মস্তিস্ক সম্পূর্ণ সুস্থ। আমার বিবেকের মধ্যে কোন ত্রুটি নেই। আমি শুধু আল্লাহ্র উপরই ভরসা করেও থাকি। সমস্ত সৃষ্টির নিয়ন্ত্রণভার তারই কুদরতি হাতে। তিনিই জীবন মৃত্যুর একমাত্র মালিক। তিনি আমাকে সাহায্য করবেন সর্বপ্রকার অনিষ্টতা হতে।
হযরত হুদ (আঃ)-এর এ ঘোষনাতেও তারা তার প্রতি ঔদ্বত্যমূলক আচরণ হতে বিরত হয়নি। শেষ পর্যন্ত হযরত হুদ (আঃ)-পরিস্কারভাবে ঘোষণা করে দিলেন যে, যদি আদ সম্প্রদায় এ পন্থা পরিত্যাগ না করে আর হকের বিরোধিতা করে এবং হক থেকে বিমুখ হয়ে থাকার নীতিতে আটল থাকে তবে ধ্বংস অনিবার্য। সে দিন বেশি দূরে নয়, যে সময়ে আল্লাহপাক তাদেরকে ধ্বংস করে ছাড়বেন। আর তিনি তাদের বদলে অন্য জাতিকে এ দুনিয়াতে বসবাসের সুযোগ দান করবেন। আর এ আদ সম্প্রদায় আল্লাহ্ পাককে তার ইচ্ছা হতে বিরত রাখতে পারবে না বা তার সামান্য পরিমাণ ক্ষতি সাধনও করতে পারবে না। তিনি সবই করতে পারেন। তিনিই সকলের রক্ষক। সমগ্র সৃষ্টি তার নিয়ন্ত্রণে।
তিনি আরো বললেনঃ হে আমার কওম! নূহ (আঃ)-এর সম্প্রদায়ের অবস্থার প্রতি লক্ষ্য করে শিক্ষা গ্রহণ কর। খুব সতর্কতা ও হুশিয়ারির সাথে পথ চল। আল্লাহ্ পাকের হুকুমের প্রতি মাথা নত কর। অন্যথায় তোমাদের পরিণতি হবে ভয়াবহ। সে সময় অতি নিকটে যখন তোমাদের গর্ব ও অহংকার ধুলায় মিশে যাবে। তখন শত আফসোস করেও কোন ফল হবে না।
কিন্তু তার উপদেশ,আল্লাহর প্রতি আহব্বান ও ভয় প্রদর্শন কোনটাই তাদের উপর কোন প্রভাব ফেলতে পারেনি। বরং তাদের ঔদ্বাত্য ও অহংকার উত্তোরত্তর বেড়েই চলল। ঠাট্টা, বিদ্রুপ, উপহাস দিন দিন বাড়তে লাগল। আযাব আনার জন্য বারবার বলতে লাগল। অবশেষে হযরত হুদ (আঃ) বলেন, আযাবের প্রতি যখন তোমাদের এতই আগ্রহ তা হলে শুনে রাখ, আল্লাহ্র আযাব তোমাদের থেকে খুব বেশি দূরে নয় বরং শীর্ঘই তোমরা অবলোকন করবে। আর তখন তোমাদের কিছু করার থাকবে না।