হযরত রাবেয়া বসরী (রঃ)- পর্ব ৯
হযরত রাবেয়া বসরী (রঃ)- পর্ব ৮ পড়তে এখানে ক্লিক করুন
এক লোক মথায় পট্টি বেঁধে হযরত রাবেয়া (রঃ) এর দরবারে এসে হাজির। মাথায় পট্টি কেন জিজ্ঞেস করলে সে জানাল, মাথায় দারুণ যন্ত্রণা। তিনি বললেন, তোমার বয়স কত? সে বললো ত্রিশ। তখন আবার প্রশ্ন, এতকাল কি সুস্থ ছিলেন না অসুস্থ ছিলে? উত্তরে সে জানাল, এতদিন সুস্থই ছিল। তখন রাবেয়া (রঃ) বললেন, তবে এতদিন ঐ সুস্থতার জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে কোন চিহ্ন মাথায় রাখলে না কেন? আর যে একটু কষ্ট পেলে অমনি কষ্টের চিহ্ন মাথায় ধারণ করলে?
একদিন তিনি এক লোককে চার দেরহাম দিয়ে একখানি কম্বল কিনে আনতে বললেন। কম্বলখানা কেমন হবে-সাদা না কালো, তা সে জানতে চাইল। সঙ্গে সঙ্গে তিনি তার কাছে থেকে দেরহাম ফিরিয়ে নিলেন। কম্বল কেনার কাজ নেই। কেনার আগেই যে জিনিসের সাদা-কালোর প্রশ্ন ওঠে, কেনার পর না জানি আরও কত সমস্যা দেখা দেবে। ওসব পার্থিব ঝামেলায় জড়িয়ে না পড়াই ভালো।
কোন এক বাসন্তী বেলায় হযরত রাবেয়া (রঃ)-এর পরিচারিকা ঘরে ধ্যানমগ্না তাপসীকে বলল, বাইরে বেরিয়ে এসে আল্লাহর সৃষ্টির সৌন্দর্য উপভোগ করুন। তিনি বললেন, তার চেয়ে ঘরে এসে সৃষ্টার নিদর্শন প্রত্যক্ষ কর। জেনে রাখো, সৃষ্টার স্বরূপ দর্শন আমার লক্ষ্য। সৃষ্টির সৌন্দর্য দেখে কি হবে?
১১। একবার ইফতার ছাড়াই একটানা সাতদিন রোজা রাখলেন তিনি। আর বিনিদ্র রজনী যাপন করলেন আল্লাহর এবাদতে ডুবে গিয়ে। অষ্টম দিনে তিনি কাতর হয়ে পড়লেন। তাঁর প্রবৃত্তি তাড়া দেয়, আপনি এভাবে আর কত আমাদের কষ্ট দেবেন? ইত্যবসরে এক পেয়ালা ভর্তি খাবার নিয়ে এক লোক এসে হাজির। ঘরে তখন আলো জ্বালা হয়নি। আঁধারের একটা বিড়াল এসে খাবারটা খেয়ে ফেলল। তখন হযরত রাবেয়া (রঃ) লোকটিকে বললেন, তুমি এক পেয়ালা পানি নিয়ে এস। পানি আনা হলে, যেই তিনি পানি পান করতে যাবেন, হাত ফসকে পেয়ালাটা পড়ে ভেঙে গেল। আর তখন হযরত রাবেয়া (রঃ) আহা বলে এমন এক চীৎকার করে উঠলেন যে, সারা ঘর কেঁপে উঠল। তাঁর মর্মস্পর্শী আবেদন উচ্চারিত হল আল্লাহর উদ্দেশ্যে। প্রভু গো! আপনি অবলা দাসীর প্রতি এ কোন আচরণ শুরু করলেন? সঙ্গে সঙ্গে ধবনিত হয় আকাশবাণীঃ তুমি চাইলে তোমাকে অঢেল পার্থিব প্রাচুর্য দান করতে পারি। কিন্তু সেক্ষেত্রে তোমার হৃদয় থেকে আমার প্রেম-বেদনা তুলে নেব। কেননা, পার্থিব প্রাচুর্য ও আমার প্রেম-যাতনা একই হৃদয়ে সমবেত হতে পারে না। আকাশবাণী শোনামাত্র তাঁর মন থেকে পার্থিব মোহ মুছে গেল। দূর হয়ে গেল ক্ষুৎপিপাসা। এরপর থেকে অবস্থা এমন হল যে, প্রতি ওয়াক্তের নামাজকে তিনি জীবনের শেষ নামাজ বলে মনে করতে থাকলেন। পাছে আল্লাহর সঙ্গে আত্নিক বন্ধন ছিন্ন হয়, এজন্য তিনি মনে মনে প্রতি মুহূর্তে প্রার্থনা করতেন, প্রভু আমার! পৃথিবীর কোন সম্পদ বা প্রাচুর্য যেন আপনার নিকট থেকে আমাকে বিচ্ছিন্ন না করে।
আল্লাহর প্রতি তাঁর স্বকাতর প্রার্থনার ভঙ্গি ও কান্না এমন ছিল যে, মনে হত তিনি প্রচন্ড অসুখে ভুগছেন। এজন্য কেউ কেউ কখনও কখনও তাঁকে জিজ্ঞেস করতেন, আপাতদৃষ্টিতে আপনাকে রোগী বলে মনে হয় না। তবুও আপনি অমন করে কাঁদেন কেন?
তিনি উত্তর দিতেন, বাইরে আমার কোন অসুখ নেই ঠিকই। কিন্তু অন্তরে রয়েছে গভীরতম অসুখ। যার কোন ওষুধ প্রভুর সঙ্গে মিলন। যতদিন সে মিলন না হয়, ততদিন এই কাকুতি-মিনতি, কান্নাকাটি বন্ধ হবে না।
কয়েকজন ধর্মনিষ্ঠ ব্যক্তিকে তিনি জিজ্ঞেস করেন, কে কোন উদ্দেশ্যে আল্লাহর এবাদত-বন্দেগী করেন। কেউ বললেন, জাহান্নামে যাতে যেতে না হয়, তার জন্যই এই এবাদত। কেউ বললেন, জান্নাতের সুখ উপভোগ করার জন্যই আল্লাহর এই উপাসনা। তাঁরা এবার তাঁর উদ্দেশ্য জানতে চাইলেন। তিনি বললেন, জান্নাত লাভ কিংবা জাহান্নামের শাস্তি হতে মুক্তির জন্য তাঁর এবাদত করতে হত। তাঁর নির্দেশ পালন ও সুন্তুষ্টি লাভের জন্যই তিনি এবাদত করেন জান্নাতের লোভে কিংবা জাহান্নামের ভয়ে নয়। বলাবাহুল্য, তাঁর যুক্তিপূর্ণ কথায় ধর্মভীরু লোকগুলো লজ্জিত হলেন।
সূত্রঃ তাযকিরাতুল আউলিয়া