হযরত যুবাইর ইবনুল আওয়াম (রা)

নাঙ্গা তলোয়ার হাতে ভীড় ঠেলে এগিয়ে আসছে এক কিশোর। অসম্ভব উত্তেজনা তার চোখে মুখে। রাসূল (সা)-এর কাছাকাছি আসতেই তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘যুবাইর! এ সব কি? যুবাইর নামের কিশোরটি উত্তর দিলেন, ‘ইয়া রাসূলুল্লাহ! আমি জানতে পেরেছি যে, আপনাকে মুশরিকরা গ্রেফতার করেছে। তাই আমি তার প্রতিশোধ নিতে আগমন করেছি’। যুবাইরের কথা শুনে নবী (সা) খুশি হলেন এবং তার জন্য দোয়া করলেন। জানা যায় যুবাইরের এই তলোয়ারই মুশরিকদের বিরুদ্ধে কোষ মুক্ত প্রথম তলোয়ার।

নাম যুবাইর, ডাকনাম আবূ আবদুল্লাহ আর উপাধি ছিলো হাওয়ারীয়ে রাসূলুল্লাহ (সা)। আব্বার নাম ‘আওয়াম’ এবং মায়ের নাম সাফিয়া বিনতে আবদুল মুত্তালিব। যুবাইর (রা)-এর মা সাফিয়া ছিলেন নবী (সা)-এর আপন ফুফু। অর্থাৎ যুবাইর ছিলেন নবী (সা) এর ফুফাত ভাই। হযরত খাদিজা (রা) ছিলে হযরত যুবাইর (রা)-এর ফুফু। অপর দিকে হযরত আয়েশা (রা)-এর সহোদরা প্রথম খলীফা হযরত আবূ বকর সিদ্দিকের কন্যা আসমাকে বিয়ে করায় যুবাইর ও রাসূল (সা)-এর মধ্যে ছিল নানা আত্মীয়তার বন্ধন।

যুবইর (লা) জন্মগ্রহণ করেন হিজরতের আটাশ বছর পূর্বে। তাঁর বাল্যকাল সম্বন্ধে কিছুই জানা যায়না। তবে এটুকু জানা যায় যে, তাকে বীর পুরুষ, আত্মসংযমী, আত্মপ্রত্যয়ী হিসাবে গড়ে তোলার জন্য তাঁর মা সাফিয়ার প্রচেষ্টার কোন অন্ত ছিলো না। এমন কি তাঁর চাচা নওফেল বিন খুওয়াইলিদ ভীষণভাবে ক্ষেপে গিয়ে সাফিয়াকে বললেন, ‘এভাবে মারতে মারতে ছেলেটাকে তুমি মেরেই ফেলবে’। এরপর তিনি বানূ হাশিমের লোকদের ডেকে বললেন, ‘তোমরা সাফিয়াকে বুঝাওনা কেনো?’ এর উত্তরে সাফিয়া বললেন, ‘যারা বলে আমি তাকে দেখতে পারিনা, তারা মিথ্যা বলে। আমি তাকে একজন্য মারধোর করি যাতে সে বুদ্ধিমান হয় এবং পরবর্তী জীবন শত্রু সৈন্য পরাজিত করে গণিমতের মাল লাভে সক্ষম হয়’।

 

আনন্দের কথা হলো অল্প বয়স থেকেই যুবাইর সত্যি সত্যিই পাহলোয়ান হয়ে উঠেছিলেন। অন্তত একটা ঘটনায় এর প্রমাণ মেলে, একদিন মক্কার এক বলিষ্ঠ দেহের যুবকের সাথে তার মোকাবিলা হয়। এক পর্যায়ে যুবাইর তাকে এইছা মার দিলেন যে, যুবকটির একটি হাতই ভেঙে গেলো। যুবকটির এহেদ দুরবস্থা দেখে লোকেরা বিচারের জন্য তাকে নিয়ে যুবাইরের মায়ের নিকট এলো। কিন্তু আশ্চর্য! যুবাইরের মা সাফিয়া এ ঘটনায় তো মর্মাহত হলেনই না, উল্টো তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমরা যুবাইরেকে কেমন দেখলে –সাহসী না ভীরু?’

মাত্র ষোল বছর বয়সেই যুবাইর (রা) ইসলাম গ্রহণ করেন। যতদূর জানা যায় তিনি প্রথম পর্যায়ের ইসলাম গ্রহণকারীদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন।

ইসলাম গ্রহণের পর পরই অন্যান্যদের মতো তাঁর ওপরও অত্যাচার নির্যাতন নেমে আসে। তাঁর চাচা তাঁকে ইসলাম থেকে ফিরানোর জোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হলে ক্ষেপে গিয়ে তাঁর ওপর নির্যাতন শুরু করেন। কখনো হোগলায় পেঁচিয়ে দড়ি বেধে নাকে ধোঁয়া দিতো। ফলে তার জীবন ওষ্ঠাগত হয়ে উঠতো। তবুও তিনি ইসলাম ত্যাগ করেননি, বরং তিনি বলতেন, যতো কিছুই করুননা কেন আমি আবার কাফির হতে পারিনা’। কাফিরদের অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে প্রথমে তিনি হাফশায় হিজরত করেন। পরে হাফশা থেকে ফিরে এসে শুনেন রাসূল (সা) মদীনায় হিজরত করেছেন। অতএব তিনিও মদীনায় হিজরত করেন।

রাসূল (সা) অন্যান্যদেরকে যেমন ভ্রাতৃত্ব বন্ধনে আবদ্ধ করেছিলেন, তেমনি মক্কায় থাকা কালে যুবাইর (রা) ও তালহা (রা)-এর মধ্যে ভ্রাতৃত্ব স্থাপন করিয়ে দেন। পরে যুবাইর (রা) যখন হিজরত করে মদীনায় আসেন তখন রাসূল (সা) আবার সালামা ইবন সালামা আনসারীর সাথে তাঁর ভ্রাতৃত্ব সম্পর্ক স্থাপন করিয়ে দেন। এই সালামা (রা) ছিলেন আকাবার বায়াত গ্রহণকারীদের অন্যতম ও মদীনার একজন সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিত্ব।

দুঃসাহসী একজন মর্দে মুজাহিদ ছিলেন হযরত যুবাইর (রা)।

 

বদর যুদ্ধে তিনি অসীম সাহসিকতার পরিচয় দেন। শত্রু পক্ষের কাছে যুবাইর নামটাই ছিল মারাত্মক ত্রাস সৃষ্টিকারী। তিনি যে সব যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন সে সব ক্ষেত্রে শত্রুদের প্রতিরক্ষা ব্যুহ ভেঙ্গে তছনছ করে দিয়েছেন। বদর যুদ্ধে দিন এক মুশরিক যোদ্ধা উঁচু টিলার উপর উঠে দ্বন্দ্ব যুদ্ধের জন্য আহবান জানালে জুবাইর দেরি না করে তাকে মুহুর্তে জাপ্টে ধরেন এবং দুজনেই গড়াতে গড়াতে নীচে আসতে থাকেন। এ দৃশ্য দেখে রাসূল (সা) বলেন, ‘এদের মধ্যে যে প্রথম মাটিতে পড়বে, সে নিহত হবে’। রাসূল (সা)-এর ভবিষ্যদ্বানী সত্যে পরিণত হলো, মুশরিকটি প্রথমে মাটিতে পড়ে –যুবাইর দেরি না করে তরবারির এক আঘাতে তাকে হত্যা করে।

এই একই যুদ্ধে সর্বাঙ্গে বর্মাচ্ছাদিত উবাইদা ইবন সাঈদের সাথে তাঁর মোকাবিলা হয়। উবাইদার শুধু দু’টি চোখই খোলা ছিল। যুবাইর অত্যন্ত দক্ষতার সাথে চোখ তাক করে তীর ছুড়লেন, তীর চোখ ভেদ করে মাথার পেছন দিয়ে বেরিয়ে গেলো। যুবাইর অনেক কষ্টে উবাইদের লাশের উপর বসে তীরটি বের করতে সক্ষম হন। তবে তীরটি বেঁকে গিয়েছিলো। এই ঘটনাটি এতো গুরুত্বপূর্ণ চিলো যে স্মৃতিচিহ্ন হিসাবে রাসূল (সা) নিজে তীরটি সংরক্ষণ করেন। রাসূল (সা)-এর ওফাতের পর তৃতীয় খলীফা হযরত ওসমান (রা) পর্যন্ত তীরটি তাঁদের নিকট ছিল। পরে হযরত ওসমান (রা) শাহাদাত বরণ করলে হযরত যুবাইর (রা) তীরটি নিজ দায়িত্বে নিয়ে নেন এবং শাহাদাত বরণ করা পর্যন্ত তা সংরক্ষণ করেন। বদর যুদ্ধে তিনি এতো বীর বিক্রমে লড়েছিলেন এবং তরবারি চালিয়ে ছিলেন যে, তাঁর তরবারির ধার পড়ে গিয়েছিলো। তিনি এতো মারাত্মকভাবে আহত হয়েছিলেন যে, তার শরীরে অসংখ্য ক্ষতের সৃষ্টি হয়। একটি ক্ষত তো চিরদিতের মতো স্থায়ী হয়ে যায়। এ ব্যাপারে তাঁর ছেলে উরওয়া (রা) বলেন, ‘আমরা সেই গর্তে আঙ্গুল ঢুকিয়ে খেলা করতাম’।

বদর যুদ্ধে তিনি হলুদ পাগড়ী পরা অবস্থায় ছিলেন। তাঁর এ পোশাকে দেখে রাসূল (সা) বলেন, ‘আজ ফেরেশতাগণ এ রংয়ের পোশাক পরে এসেছেন।

উহুদ যুদ্ধে মুসলমানদের বিপাকের সময় রাসূল (সা) কে কেন্দ্র করে যে জানবাজ সাহাবীরা প্রতিরো ব্যুহ তৈরী করেছিলেন, হযরত যুবাইর (রা) ছিলেন তাদের অন্যতম।

খন্দকের যুদ্ধে যুজাইর (রা)-এর উপর দায়িত্ব পড়ে যেদিককার প্রতিরক্ষার সে দিকে মহিলারা অবস্থান করছিলেন। মদীনার ইয়াহুদি গোত্র বানূ কুরাইজা এ যুদ্ধে মুসলমানদের সাথে সম্পাদিত চুক্তি ভঙ্গ করে। বিষয়টি পরিস্কার ভাবে জানার জন্য রাসূল (সা) কোন একজনকে পাঠাতে চাইলেন। এ জন্য তিনি তিরবার জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমাদের মধ্যে এমন কেউ কি আছে য তাদের সংবাদ সংগ্রহ করতে পারে?’ তিনবারই যুবাইর (রা) উত্তর দেন, ‘আমি’। নবী (সা) তাঁর এহেন উত্তরে খুশী হয়ে বলেন, ‘প্রত্যেক নবীরই থাকে হাওয়ারী। আমার হাওয়ারী যুবাইর’।

 

আসলে বানূ কুরাইযা গোত্রের সংবাদ সংগ্রহ করা ছিলো খুবই বিপজ্জনক ব্যাপার। এ জন্য রাসূল (সা) যুবাইরের বীরত্বে অভিভূত হয়ে বলেন, ‘আমার বাপ মা তোমার নামে উৎসর্গ হোক’।

পরিখা’র যুদ্ধেল পর বানূ কুরাইজার যুদ্ধ ও বাইয়াতে রিদওয়ানেও তিনি অংশগ্রহণ করেন। খাইবার যুদ্ধের সময় তিনি প্রচণ্ড সাহসিকতার পরিচয় দেন। এই যুদ্ধের ইয়াহুদী নেতা মুরাহহিব নিহত হয়। ফলে তার ভাই ইয়াসির ভয়ানক চটে গিয়ে যুদ্ধের ময়দানে চলে এসে দ্বন্দ্ব আহবান জানালো। ইয়াসিরের মোবাকিলায় যুবাইর (রা) গিয়ে দাঁড়ান। কিন্তু ইয়াসিরের শরীর এতই তাগড়া ছিলো যে যুবাইর(রা)-এর মা সাফিয়া ভড়কে গিয়ে বলেন, ‘ইয়া রাসূলুল্লাহ (সা)! আমার সন্তান আজ শহীদ হয়ে যাবে। উত্তরে রাসূল (সা) বললেন, ‘না, না যুবাইর শহীদ হবে না; বরং যুবাইর ইয়াসিরকে হত্যা করবে’। ফলে তাইই হলো। কিছুক্ষণ যুদ্ধের পর যুবাইর ইয়াসিরকে তলোয়ারের এক কোপে দুখণ্ড করে ফেললেন।

মানবিক দুর্বলতার কারণে প্রখ্যাত সাহাবা হাতিব বিন আবী বালতায়া (রা) মক্কা অভিযানের সমস্ত খবর জানিয়ে কুরাইশদের নিকট গোপনে এক মহিলাকে চিঠিসহ পাঠান। অহীর মাধ্যমে রাসূল (সা)-এর খবর জানতে পারেন এব মহিলাকে গ্রেফতার করার জন্য একটি ক্ষুদ্র দল পাঠান। হযরত যুবাইর (রা) ছিলেন এ দলের অন্যতম সদস্য।

হিজরী আট সনে মক্কা বিজয় সম্পন্ন হয়। মক্কা বিজয় কালে দশহাজার সৈন্য রাসূল (সা)-এর সঙ্গী হয়। তিনি এই দশহাজার সৈন্য নানা ছোট বড় দলে ভাগ করেন। সব থেকে ক্ষুদ্র এবং শেষ দলটির সাথীহন রাসূল (সা) নিজে। আর এ দলের সেনাপতিত্ব করার সৌভাগ্য অর্জন করেন যুবাইর (রা)। মক্কায় প্রবেশের পর শান্তি স্থাপিত হলে হযরত মিকদাদ ও যুবাইর (রা) ঘোড়ায় ছড়ে রাসূল (সা)-এর কাছে উপস্থিত হলেন। রাসূল (সা) উঠে দাঁড়িয়ে নিজ হাতে উভয়ের মুখমণ্ডল ধূলোবালি ঝেড়ে দিলেন।

মক্কা বিজয়ের পর মদীনা ফেরার পথে হুনাইনের যুদ্ধে সংঘঠিত হয়। এ যুদ্ধে যুবাইর (রা) অত্যন্ত সাহসিকতার পরিচয় দেন। তিনি একাকী কাফেরদের একটি গোপন ঘাটির নিকট পৌঁছে যান। তাঁকে দেখে এক ব্যক্তি সঙ্গীদেরকে বললো, ‘আমাদের প্রভু লাভ এবং ওযযার কসম! ঘোড়ার আরোহী এই লম্বা ব্যক্তি নিশ্চয় যুবাইর। সাবধান! প্রস্তুত হও এবং সকলে প্রস্তুত থাকো। কারণ যুবাইরের আক্রমন অত্যন্ত মারাত্মক’। লোকটির বক্তব্য শেষ হতে না হতেই মুশরিকরা আকস্মিকভাবে যুবাইরকে ঘিরে ফেললো। কিন্তু যুবাইর (রা) অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তার সাথে শত্রুব্যূহ ভেদ করলেন, এমনকি একাই সেই ঘাটির মুশরিকদের পরাজিত করে ঘাটি দখল করেন।

 

হযরত ওমর (রা)-এর খিলাফত কালে ইয়ারমুকের যুদ্ধে যুবাইর(রা) দুঃসাহসিক ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। যুদ্ধ ভয়াবহ রূপ নিলে মুসলিম সৈন্যরা তাঁর নেতৃত্বে রোমান বাহিনীর মধ্যভাগে প্রচণ্ড আক্রমণ চালায়। হযরত যুবাইর (রা) অত্যণ্ত ক্ষীপ্রতার সাথে আক্রমণ পরিচালনা করেন এবং রোমান বাহিনীর প্রতিরোধ ব্যূহভেদ করে অপর প্রান্তে পৌঁছে যান। কিন্তু তাঁর সংগীরা তাঁকে অনুসরণ করতে ব্যর্থ হয়। এ অবস্থা দেখে তিনি পুনরায় রোমান বাহিনীর ব্যূহ ভেদ করে নিজ বাহিনীর কাছে ফিরে আসেন। কিন্তু আসার সময় মারাত্মকভাবে আহত হন। এ সময় তিনি ঘাড়ে দারুণ আঘাত পেয়েছিলেন। তাঁর ছেলে উরওয়া বলেন, ‘বদরের পর এটা ছিল দ্বিতীয় যখম, যার মধ্যে আঙ্গুল ঢুকিয়ে ছেলে বেলায় আমরা খেলতাম’। খুশির কথা হলো তাঁর এ দুঃসাহসিক আক্রমণের কারণেই রোমান বাহিনীর ছত্রভঙ্গ ও পরাজিত হয়।

মিসরের ফুসতাত কিল্লা জয়ের সময় ঘটলো এক চমকপ্রদ ঘটনা। হযরত আমর ইবনুল আসের (রা)-এর নেতৃত্বে মুসলিম বাহিনীর ফুসতাত কিল্লা সাত মাস অবরোধ করে রেখেও দখল আনতে পারছিলো না। শেষ মেষ হযরত ওমর (রা) দশহাজার সৈন্য ও চারহাজার সেনা অফিসারকে আমর (রা)-এর সাহায্যের জন্য পাঠালেন। তিনি লিখে পাঠালেন এ অফিসারার এক এক জন একহাজার সৈন্যের সমান। হযরত যুবাইর (রা) ছিলেন এ সৌভাগ্যবানদের মধ্যে একজন। দীর্ঘ অবরোধের পরেও যখন কিল্লা জয়ের লক্ষণ দেখা যাচ্ছিলো না, তখন একদিন যুবাইর (রা) বললেন, ‘আজ আমি মুসলমানদের জন্য আমার জীবন কুরবান করবো’। যেই বলা সেই কাজ। যুবাইর (রা) উন্মুক্ত তলোয়ার হাতে মই লাগিয়ে কিল্লায় উঠে গেলেন। আর কিল্লায় চড়েই নারায়ে-তকবীর ধ্বনি দিতে শুরু করলেন, সাথে সাথে নীচে থেকে মুসলিম সৈন্যরা আল্লাহু আকবর ধ্বনিতে আকাশ বাতাস মুখরিত করে তুললো। এহেন ঘটনায় খৃষ্টানরা হতভম্ব হয়ে গেল এবং সন্ত্রস্তভাবে ছুটাছুটি শুরু করলো। এ সুযোগ যুবাইর (রা) কিল্লার দরোজা খুলে দিলেন –সংগে সংগে মুসলিম বাহিনী কিল্লায় প্রবেশ করলো।

দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওমর (রা) মৃত্যু শয্যায় যে ছয় জনের ভেতর খলীফা নির্বাচন করার জন্য বলে যান হযরত যুবাইর (রা) তাঁদের একজন।

হযরত ওসমান (রা)-এর বাড়ি বিদ্রোহীরা ঘিরে ফেললে তাঁর ও তাঁর পরিবারের নিরাপত্তার জন্য যুবাইর (রা) স্বীয় পুত্র হযরত আবদুল্লাহকে (রা) নিয়োগ করেন। হযরত আলী (রা)-এর খিলাফত কালে হযরত ওসমানের শাহাদাতের ঘটনা নিয়ে ভুল বুঝাবুঝির সৃষ্টি হয়। হযরত তালহা ও যুবাইর (রা) মক্কায় গিয়ে হযরত আয়েশা (রা)-এর সাথে মিলিত হন। তারা উদ্ভুত পরিস্থিতি নিয়ে দীর্গ আলোচনা করেন এবং মদীনায় না গিয়ে বসরার দিকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। প্রচুর লোক তাঁদের সঙ্গী হন। এদিকে হযরত আলী (রা) এ সংবাদে তাঁদের প্রতিরোধের উদ্দেশ্যে রওনা হন এবং বসরার নিকটবর্তী ‘যীকার’ নাকম স্তানে দুই বাহিনী মুখোমুখি অবস্থান নেয়। সময়টা ছিল হিজরী ৩৫ সনের ১০ই জমাদিউল উখরা।

ইতিহাসে এ যুদ্ধকেই জংগে জামাল বা উটের যুদ্ধ বলে।

 

উভয় দল সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিলো। এ জন্য শান্তি স্থাপনের উদ্দেশ্যে উভয় পক্ষের মধ্যে আলাপ আলোচনা হয়ে শান্তি স্থাপনের কাছাকাচি পৌঁছলে, উভয় পক্ষে ঘাপটি মেরে থাকা মুনাফিকরা তাতে বাঁধ সাধলো এবং যুদ্ধ বাঁধিয়ে দিলো। এক পর্যায়ে হযরত আলী (রা) একাকী যুদ্ধক্ষেত্রের মাঝখানে এসে যুবাইর (রা) কে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘হে আবূ আবদুল্লাহ! সেই দিনের কথা তোমার মনে আছে কি? আমরা উভয়ে পরস্পরের হাতে হাত রেখে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর সম্মুখ দিয়ে যাচ্ছিলাম। রাসূল (সা) বলেছিলেন, ‘হে যুবাইর! তুমি একদিন আলীর বিরুদ্ধে না হক যুদ্ধ করবে’।

উত্তরে একদিন আলীর বিরুদ্ধে না হক যুদ্ধ করবে’।

উত্তরে হযরত যুবাইর (রা) বললেন, ‘হ্যাঁ তিনি বলেছিলেন। যদিও আমি তা স্মরণ রাখতে পারিনি। তবে এখন আমার মনে পড়ছে’।

হযরত আলী (রা) আর কিছু না বলেই সেখান থেকে চলে গেলেন কিন্তু সত্যের সৈনিক যুবাইর (রা)-এর মধ্যে বিপ্লব ঘটে গেলো। তিনি দ্রুত হযরত আয়েশা (রা)-এর নিকট হাজির হয়ে বললেন, ‘আমি ভুল বুঝাবুঝির ওপর ছিলাম। হযরত আলী (রা)_ আমাকে রাসূল (সা)-এর কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন’। আয়েশা (রা) বললেন, ‘এখন আপনার উদ্দেশ্য কি?’ যুবাইর (রা) উত্তরে বললেন, ‘এখন আমি এ সব ঝগড়া থেকে বিরত থাকতে চাই’।

উপস্থিত যুবাইর (রা)-এর পুত্র আবদুল্লাহ (রা) প্রশ্ন করলেন, ‘তা হলে আপনি আমাদেরকে উভয় সমস্যার মধ্যে ফেলে আলী (রা)-এর ভয়ে পালাচ্ছেন’।

উত্তরে যুবাইর (রা) বললেন, ‘আমি কসম করেছি, আলীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবো না’। আবদুল্লাহ ইবনে যুবাইর (রা) বললেন, ‘কসমের কাফফারা দেওয়াও তো অসম্ভব কিছু নয়’। এই বলে তিনি স্বীয় গোলাম মাকগুলকে আযাদ করে দিলেন।

যুবাইর (রা) বললেন, ‘বাবা! হযরত আলী (রা)-এর ভয়ে নয়, বরং আমার মনই একাক করতে চাচ্ছে না। এরপর হযরত আলী রাসূল (সা)-এর এমন এক কথা মনে করিয় দিয়েছেন। যার ফলে আমার আগ্রহ উদ্দীপনা নিস্তেজ হয়ে গোছে। নিঃসন্দেহে আমি অন্যায় পথে ছিলাম। আসো, তুমিও আমার সাধে যুদ্ধ বিরতি মেনে চলো’।

হযরত আবদুল্লাহ (সা) অস্বীকার করলে তিনি বসরার দিকে রওয়ানা দিলেন। এ সময় আহনাফ বিন কায়েসের কথামত আমার বিন জারমুজ যুবাইর (রা)-এর পিছু নেয় এবং বসরা থেকে কিছু দূরেই সশস্ত্র অবস্থায় তার সংগে মিলিত হয়। জারমুজ যুবাইর (রা)-এর কাছে এসে বললো, ‘আবূ আবদুল্লাহ। জাতিকে আপনি কি অবস্থায় ছেড়ে এলেন?’ যুবাইর (রা) বললেন, ‘তারা একে অপরের গলায় ছুরি চালাচ্ছে’। পুনরায় ইবনে জারমুজ বললেন, ‘আপনি এখন কোথায় যাচ্ছেন?’ উত্তরে তিনি বললেন, ‘আমার ভুল আমি বুঝতে পেরেছি। তাই এ ঝগড়া থেকে দূরে যেতে চাই’। ইবনে জারমুজ বললো, ‘চলুন সেদিকে আমিও যাবো’। দু’জন এক সংগে চললেন। জোহরের সময় হলে যুবাইর (রা) থামলেন। সে সময়ে ইবন জারমুজ তাঁর সাথে সালাত আদায়ের ইরাদা পেশ করলে যুবাইর (রা) বললেন, ‘আমি তোমাকে আশ্রয় দান করছি। তুমি কি আমার সাথে সেই ব্যবহার করবে?’ ইবন জারমুজ বললো, ‘অবশ্যই’।

 

এরপর উভয়ে সালাতে দাঁড়ালেন। সেজদারত হওয়ার সাথেসাথে বিশ্বাসঘাতক বেঈমান ইবন জারমুজ আশারায়ে মোবাশশারার অন্যতম সদস্য নবী হাওয়ারী হযরত যুবাইর (রা)-এর  মাতা তলোয়ারের এক আঘাতে দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। ইন্নালিল্লাহি ওয়াইন্না ইলাইহি রাজিউন।

যুবাইর (রা) কে শহীদ করার পর নরাধম ইবন জারমুজ তার তলোয়ার লৌহবর্ম ইত্যাদি নিয়ে আলী (রা)-এর দরবারে হাজির হয়ে গর্বের সাথে তার কৃতকার্জের বর্ণনা দিলো। হযরত আলী (রা) সেদিকে কর্ণপাত না করে যুবাইর (রা) তলোয়ারের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আহ! এই সেই তলোয়ার যা দিয়ে যুবাইর (রা) রাসূলুল্লাহ (সা)-এর ওপর থেকে বহুবার মুসীবতের পাহাড় হটিয়ে গিয়েছেন। হে জারমুজ! আমি তোমাকে সুসংবাদ দিচ্ছি যে, জাহান্নাম তোমার জন্য অপেক্ষা করছে’। হযরত যুবাইর (রা)-এর শাহাদাতের সনটি ছিল হিজরী ৩৬। শাহাদাতের পর তাঁর লাশ ‘আসা সিবা’ উপত্যকায় দাফন করা হয়।

হযরত যুবাইর (রা) ছিলেন দ্বীনের ব্যাপারে অত্যণ্ত সাবধানী একজন সাহাবী। তিনি রাসূল (সা)-এর হাওয়ারী ও সার্বক্ষণিক সংগী হওয়া সত্ত্বেও খুব কম সংক্যক হাদীস বর্ণনা করেছেন। এ ব্যাপারে হযরত আবদুল্লাহ (রা) জানতে চাইলে তিনি ছেলেকে উত্তর দেন, ‘বেটা অন্যদের থেকে রাসূলের (সা) সাহচর্য ও বন্ধুত্ব আমার কোন অংশে কম ছিলো না। যেদিন ইসলাম কবুল করেছি, সেদিন থেকে রাসূলের (সা) সাহচর্য থেকে বিচ্ছিন্ন হয়নি। কিন্তু তাঁর এ সতর্কবাণীটি আমাকে দারুণভাবে সাবধান করেছে, ‘যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে আমার প্রতি মিথ্যা আরোপ করবে, সে যেন জাহান্নামে তার আবাস ঠিক করে নেয়’।

যুবাইর (রা) বিপদ আপদ বালা মুছীবনতে থোড়ায় কেয়ার করতেন, এমনকি মৃত্যু ভয়েও তিনি কখনো ভীত হতেন না। এ ব্যাপারে তিনি তাঁর জীবনে প্রচুর উদাহরণ রেখে গেছেন। ইসকান্দারিয়া অবরোধের সময় সিঁড়ি লাগিয়ে তিনি কিল্লার ভেতর ঢুকতে চাইলে সঙ্গীরা বললেন, ভেতরে মারাত্মক প্লেগ’। জবাবে এ অকুতোভয় সৈনিক বললেন, ‘আমরা তো যখন ও প্লেগের জন্যই এসেছি। সুতরাং মৃত্যু ভয় কেন? এরপর তিনি নির্ভয়ে কিল্লায় প্রবেশ করলেন।

উহুদের যুদ্ধে তাঁর মামা হযরত হামজা (রা) শহীদ হন। এ সংবাদে তাঁর মা সাফিয়া ভাইয়ের লাশ দাফনের জন্য দু’টুকরো কাপড় পাঠান। কিন্তু মামার পাশেই তিনি একজন আনসারী ব্যক্তির লাশ দেখতে পেলেন। একটি লাশের জন্য দু’প্রস্থ কাপড় অথচ অন্যটি কাপড় বিহীন এটা তাঁর কাছে দৃষ্টিকটু মনে হলো ‘তাই তিনি কাপড় দু’টি লটারীর মাধ্যমে ভাগ করলেন, যাতে পক্ষপাতিত্ব না হয়। আসলে কাপড় দু’টি ছোড় বড় ছিলো –এজন্য এ সাবধানতা। এবার নিশ্চয় বুঝতে পারছো ইসলামী শাসনের প্রতি তিনি কেমন অনুগত ছিলেন।

দানশীলতা, উদারতা, আমনতদারী, পরোপকারীতা ইত্যাদি গুণে যুবাইর (রা) ছিলেন গুণান্বিত। যুবাইর (রা) ছিলেন অসম্ভব একজন ধনী ব্যক্তি। তার কাছে এক হাজার গোলাম ছিলো। তারা প্রতিদিন প্রচুর আয় করতো। এ আয়াতের এক পয়সাও তিনি নিজের জন্য বয় করতেন না, সম্পূর্ণ অর্থই দনা করে দিতেন। তিনি এতই ধনী ব্যক্তি ছিলেন যে মৃত্যুকালে তাঁর নিকট পাঁচ কোটি দুইলক্ষ দিরহামের স্থাব সম্পত্তি ছিলো। এছাড়া বিভিন্ন স্থানে তাঁর অনেকগুলি বাড়িঘরও ছিলো। অবশ্য তিনি বেশ ঋণীও ছিলেনে। এ ঋণ ছিল আমানতকারীদের। তিনি আমানতকারীদের বলতেন, এ মাল আমি আমানত রাখছিনা, বরং ঋণ নিচ্ছি। এভঅবে ঋণ হলে শোধ দেয়ার তাগিদ জন্মাবে’।

 

ঋণের ব্যাপারে তিনি ছেলেকে অছিয়ত কলে বলেন, ‘বাবা! ঋণের প্রতি আমার মন সর্বদা চিন্তিত। তাই আমার মাল বিক্রয় করে সর্বপ্রথমক আমার ঋণ পরিশোদ করো। অতঃপর যা অবশিষ্ট থাকে তার থেকে এক তৃতীয়াংশ শুধু তোমার সন্তানের জন্য অসিয়ত করছি। তবে যদি মাল দিয়ে সম্পূর্ণ কাজ সমাধা না হয়, তাহলে আমার মাওলার কাছে চেয়ে নিও’। আবদুল্লাহ (রা) জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনার মাওলা কে? উত্তরে তিনি বললেন, ‘আমার মাওলা সেই প্রভু রাব্বুল আলামীন, যিনি আমাকে কোন রকম মুসীবতের সময়ই সাহায্য করেছেন’।

তিনি অত্যন্ত দায়িত্ববান লোক ছিলেন। অত্যধিক ব্যস্ততা সত্ত্বেও তিনি পরিবার পরিজনের প্রতি যথেষ্ট যত্মবান ছিলেন। বিশেষ করে তিনি পুত্র আবদুল্লাহর (রা) বাচ্চাদেরকে খুবই মহব্বত করতেন। তিনি নিজের ছেলেদের শিক্ষা দিক্ষার ব্যাপারেও খুবই সজাগ মানুষ ছিলেন। আবদুল্লাহর (রা) বয়স যখন মাত্র দশবছর তখন তিনি তাঁকে যুদ্ধের বাস্তবতা থেকে শিক্ষা গ্রহণেল জন্য দর্শক হিসাবে ইয়ারমুকের যুদ্ধে নিয়ে যান।

ধনী হওয়া সত্ত্বেও তিনি খাওয়া দাওয়া ও পোশাক পরিচ্ছদের ক্ষেত্রে সাদাসিধা ছিলেন। তবে যুদ্ধের সময় তিনি রেশমী পোশাক পরতেন। রাসূল (সা) তাঁকে বিশেষভাবে এ অনুমতি দিয়েছিলেন। আর তিনি কারুকার্য খচিত যুদ্ধাস্ত্র পছন্দ করতেন। তাঁর তলোয়ারের বাটটি ছিল রৌপ্য নির্মিত।

হযরত যুবাইর (রা) ছিলেন একজন দক্ষ ব্যবসায়ী। আনন্দের কথা হলো তিনি জীবনে যে ব্যবসায়ে হাত দিয়েছেন, সব তাতেই তিনি প্রচুর পরিমাণে লাভবান হয়েছেন।

বহু যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করার কারণে তাঁর দেহ ছিলো ক্ষত বিক্ষত। এ ব্যাপারে আলী ইবনে খালিদ বলেন, ‘আমাদের কাছে মুসেল থেকে একটি লোক এসেছিলেন, তিনি বর্ণনা করেন, ‘আমি যুবাইর (রা)-এর সফরসঙ্গী ছিলাম। সফরের এক পর্যায়ে আমি তাঁর দেহে এমন সবআঘাতের চিহ্ন দেখতে পেলাম যা অন্য কারো দেহে আর কখনো দেখিনি’।

ব্যক্তি হিসাবে হযরত তালহা (রা) ও হযরত যুবাইর (লা) কেমন ছিলেন তা হযরত মুয়াবিয়া (রা) হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা) কে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, ‘আল্লাহ তাদের দু’জনের ওপর রহমত বর্ষণ করুন। আল্লাহর কসম, তাঁরা দু’জনই ছিলেন অত্যন্ত সংযমী, পুণ্যবান, সৎকর্মশীল, আত্মসমর্পণকারী, পুত পবিত্র, পবিত্রতা অর্জনকারী ও শাহাদাত বরণকারী’।

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

সম্পর্কিত পোস্ট

দুঃখিত!