হযরত মূসা (আঃ)-এর মোজেযা

হযরত মূসা (আ)-এর মোজেযাসমূহ

“অতপর আমি মূসা ও তার ভাই হারুনকে আমার নিদর্শনসমূহ ও অকাট্য প্রমাণসহ ফেরাউন ও তাঁর দলবলের কাছে পাঠালাম”।–(সূরা আল-মুমিনূনঃ ৪৫-৪৬)

‘নিদর্শনসমূহের’ পর ‘অকাট্য প্রমাণ’ এর উল্লেখের তাৎপর্য এ হতে পারে যে, এসব নিদর্শন তাঁদের সাথে থাকাই দু’জনের নবুয়াতের অকাট্য প্রমাণ ছিল। আবার এও হতে পারে যে, মিসরে তিনি লাঠি ছাড়া আর যেসব মোজেযা দেখিয়েছেন সেগুলো হল নিদর্শন আর অকাট্য প্রমাণ অর্থ তার লাঠি। কেননা লাঠির মাধ্যমে যেসব মোজেযা প্রকাশ পেয়েছে তা তাঁদের উভয়ের রসূল হওয়া সম্পর্কে আর কোনো সন্দেহের অবকাশ থাকতে দেয়নি।

“তারা যখন নিজেদের যাদুর উপকরণ নিক্ষেপ করল তখন তারা দর্শকদের চোখে যাদু করল এবং মনে ত্রাসের সঞ্চার করল। এভাবে এক সাংগাতিক রকমের যাদু দেখাল। আমি মূসাহে ইংগিত করলাম, তোমার লাঠি নিক্ষেপ কর। লাঠি নিক্ষেপ করতেই তা তাদের মিথ্যা যাদুর মায়াজালকে গ্রাস করতে লাগলো?”(সূরা আরাফঃ ১১৬-১১৭)

হযরত মূসার লাঠি

এরূপ ধারণা করা ঠিক নয় যে, হযরত মূসার লাঠি যাদুকরদের সেই লাঠি ও দড়িগুলোকে গিলে খেয়ে ফেলেছিল যা অজগর সাপের মত দেখাচ্ছিল। কুরআনের বক্তব্য শুধু এইযে, মূসার লাঠি সা প হয়ে যাদুকরদের ধোঁকাপূর্ণ মায়া মরীচিকা গ্রাস করে ফেলল। আয়াতের মর্ম স্পষ্টতঃ এ রকম মনে হয় যে, মূসার সাপ যেদিকে যেদিকে গেছে, সেখাণ থেকে যাদুর প্রভাব নষ্ট হয়ে গেছে। যাদুর প্রভাবে যাদুকরদের লাঠি ও দড়ি সাপের মত ফণা তুলছিল বলে দেখা যাচ্ছিল। কিন্তু মূসার সাপ এক চক্কর ঘুরে আসতেই সকল লাঠি লাঠির রূপ এবং সকল দড়ি দড়ির রূপ ধারণ করল।

ফেরাউন গোষ্ঠীর ওপর বিভিন্ন সতর্কতামূলক আযাব

“আমি ফেরাউনের লোকজনকে কয়েক বছর পর্যন্ত দুর্ভিক্ষ ও ফসলহানিতে আক্রান্ত করেছিলাম যাতে করে তাদের সন্বিৎ ফিরে আসে। কিন্তু তাদের এমন দশা হয়েছিল যে, ভাল অবস্থা হলে বলত, আমরা এর যোগ্য। আর খারাপ কিছু ঘটলে মূসা ও তার সাথীদেরকে তাদের জন্যে দুর্ভাগ্যজনক মনে করত। আসলে তাদের দুর্ভাগ্য আল্লাহর কাছেই ছিল। তবে তাদের অধিকাংশেরই তা জানা ছিল না। তারা মূসাকে বলল, তুমি আমাদেরকে যাদু প্রভাবিত করার জন্যে যে নিদর্শনই নিয়ে আস না কেন আমরা তোমার কথা শুনব না। শেষ পর্যন্ত আমি তাদের ওপর ঝড়-ঝঞ্ঝা প্রভাবিত করলাম, পঙ্গপাল ছড়িয়ে দিলাম উই পোকা ও ব্যাঙ পাঠিয়ে দিলাম এবং রক্তবৃষ্টি বর্ষণ করলাম। এসব নিদর্শন আলাদা আলাদাভাবে দেখালাম। কিন্তু তারা দাম্ভিকতার পথে এগিয়েই যেতে লাগল। আসলে তারা ছিল ভীষণ অপরাধী জাতি”।–(সূরা আল আ’রাফঃ ১৩০-১৩৩)

যে জিনিস কিছুতেই যাদুর ফল হতে পারে না বলে ফেরাউনের সভাসদগণের নিশ্চিতরূপে জানা ছিল, তাকেও যাদু বলে আখ্যায়িত করে তারা হঠকারিতা ও বাকচাতুরি প্রদর্শন করেছে। সারা দেশে দুর্ভিক্ষ ও ক্রমাগত ফসলহানি ঘটানো যে কোন যাদুকরের কৃতিত্ব হতে পারে, তা বোধ হয় কোনো নির্বোধ বিশ্বাস করবে না। এ কারণেই কুরআনে বলা হয়েছেঃ

“আমার নিদর্শনগুলো যখন তারা দেখতে পেল তখন বলল, এটা নিশ্চয়ই সুস্পষ্ট যাদু। অথচ ভেতর থেকে তাদের মন বিশ্বাসী হয়ে উঠেছিল। কিন্তু নিছক দাম্ভিকতা ও অংকার বশেই তারা অস্বীকার করলো”।–(সূরা আন নামলঃ ১৩-১৪)

পূর্বোক্ত আয়াতে যে ঝড়-তুফানের কথা বলা হয়েছে, তা সম্ভবত শিলাবৃষ্টিসহ প্রবল বারিবর্ষণ ছিল। তুফান অন্য ধরনেরও হতে পারে। তবে বাইবেলে তুষারাপাতজনিত তুফানের উল্লেখ করা হয়েছে। তাই আমি এ অর্থই ব্যবহার করেছি।

ঐ আয়াতে যে ‘কুম্মাল’ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে তার কয়েকটি অর্থ রয়েছে, যথাঃ উকুন, ক্ষুদে পংগপাল, মশা, উইপোকা ইত্যাদি। এমন ব্যাপক অর্থবোধক শব্দ প্রয়োগের কারণ সম্ভবত এই যে, মশা ও উকুন মানুষের ওপর এবং উই পোকা খাদ্য-গুদামে হামলা চালিয়েছিল।–(বাইবেলের যাত্রাপুস্তক, ৭ম থেকে ১২শ অধ্যায় দ্রষ্টব্য)

নয়টি নিদর্শন

“আমি মূসাকে নয়টি সুস্পষ্ট নিদর্শন দিয়েছিলাম। এখন তুমি নিজেই বনী ইসরাঈলকে জিজ্ঞেস কর যে, মূসা যখন তাদের সামনে এসেছিল তখন ফেরাউন তাঁকে কি বলেছিল যে, হে মূসা, আমি মনে করি তোমাকে অবশ্যই যাদু করা হয়েছে। মূসা তার জবাবে বলল, এসব মনোজ্ঞ নিদর্শন আসমান-যমীনের প্রভু ছাড়া আর কেউ নাযিল করেনি। হে ফেরাউন। আমার ধারণা যে তুমি নিশ্চয়ই হতভাগ্য”।–(সূরা বনী ইসরাঈলঃ ১০১-১০২)

সূরা আল আ’রাফে এ নয়টি নিদর্শনের উল্লেখ করা হয়েছে। সেগুলো হলঃ ১. লাঠি –যা সাপে রূপান্তরিত হত ২. উজ্জল হস্ত –যা বগল থেকে বের করে আনলেই সূর্যের মত আলো-ঝলমল করত ৩. যাদুকরদের যাদুকে জনসাধারণ্যে পরাজিত করা ৪. একটি ঘোষণা অনুসারে সারাদেশে দুর্ভিক্ষ হওয়া ৫. ক্রমাগত তুফান ৬. পঙ্গপাল ৭. উইপোকা ৮. ব্যাঙ ও ৯. রক্ত প্রভৃতি বিপদসমূহ অবতীর্ণ হওয়া।

হযরত মূসা ফেরাউনের কথার যে জবাব দেন, তার মর্ম ছিল এই যে, দেশব্যাপী দুর্ভিক্ষ লক্ষ লক্ষ বর্গমাইল এলাকা জুড়ে ব্যাঙের উৎপাত, সমস্ত খাদ্যগুদামে উই পোকার আক্রমণ এবং এ ধরনের অন্যান্য জাতীয় সংকট কোনো যাদুকরের যাদু অথবা কোনো মানবীয় শক্তির দ্বারা সংঘটিত হতে পারে না। এখানে স্মরণ রাখা দরকার যে, প্রত্যেক বিপদ আসার আগে হযরত মূসা ফেরাউনকে সাবধান করে দিয়ে বলতেন, তুমি যদি নিজের হঠকারিতা ত্যাগ না কর, তাহলে এই এই বিপদ তোমার রাজ্যের ওপর চাপেয়ে দেয়া হবে। তার কথা মত ঠিক সেই বিপদ যথাসময়ে এসে পড়তো। এমতাবস্থায় এসব বিপদাপদ আসমান-যমীনের মালিক আল্লাহ ছাড়া আর কারও দ্বারা সংঘঠিত হয়েছে –এ কথা বলা একমাত্র কোনো পাগল বা হঠকারী ব্যক্তির পক্ষেই সম্ভব।

লাঠি দ্বারা সাগরকে দ্বিখণ্ডিত করা

“আমি মূসাকে অহী দ্বারা বললাম, এখন তুমি আমার বান্দাদেরকে নিয়ে রাতারাতি বেরিয়ে পড় এবং তাদের জন্যে সমুদ্রের ভেতর শুকনো রাস্তা বানিয়ে দাও। তোমাদের পেছনে কেউ ধাওয়া করছে সে ভয় কর না। আর (সমুদ্রের ভেতর দিয়ে চলতে গিয়ে ঘাবড়ে যেও না”।–(সূরা ত্বাহাঃ ৭৭)

এ ঘটনার বিবরণ এই যে, আল্লাহ তায়ালা শেষ পর্যণ্ত একটা রাত নির্দিষ্ট করে দিলেন যে রাতে সকল ইসরাঈলী ও অইসরাঈলী মুসলমানদেরকে (যার জন্যে “আমার বান্দাগন” এ ব্যাপক অর্থবোধক শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে) সকল অঞ্চল থেকে হিজরত করে বেরিয়ে পড়ার কথা। আগে থেকে নির্ধারিত একটা জায়গায় তাঁরা সবাই একত্র হয়ে একটা কাফেলার আকারে বেরিয়ে পড়লেন। সে কালে সুয়েজ খাল ছিল না। লোহিত সাগর থেকে ভূমধ্য সাগর পর্যন্ত সমগ্র এলাকা ছিল মুক্ত এলাকা। কিন্তু সে এলাকার সমস্ত পথে সামরিক ঘাটি ছিল। এ জন্যে ঐ রাস্তা অতিক্রম করা নিরাপদ ছিল না। এ জন্যে হযরত মূসা লোহিত সাগর অভিমুখী পথ অবলম্বন করেন।

সম্ভবত সমুদ্রের তীর ধরে সিনাই উপদ্বীপের দিকে বেরিয়ে যাওয়ার ইচ্ছা তাঁর ছিল। কাফেলা সমুদ্রতীরে থাকতেই ওদিকে পেছন থেকে ফেরাউনের বিরাট বাহিনী এসে পৌঁছে গেল। সূরা শুয়ারাতে বর্ণিত হয়েছে যে, মোহাজেরদে কাফেলা সমুদ্র ও ফেরাউনের বাহিনীর মধ্যস্থলে অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছিল। ঠিক সেই মুহুর্তে আল্লাহ হযরত মূসাকে নির্দেশ দেন (আরবী**********) ‘তোমার লাঠি দিয়ে সমুদ্রের ওপর আঘাত কর’। (আরবী************) ‘তৎক্ষনাৎ সমুদ্র দ্বিখণ্ডিত হল এবং তার দু’ভাগ দু’দিকে মস্তবড় পাহাড়ের মত উঁচু হয়ে দাঁড়ালো’।

কাফেলা পার হয়ে যাওয়ার জন্যে মাঝখানে শুধু রাস্তা হয়ে গেল তাই নয় বরং মধ্যবর্তী এ অংশটি একটা শুষ্ক সড়কে পরিণত হল। এ হল একটা সুস্পষ্ট মোজেযারই বর্ণনা। যারা বলেন, ঝড় কিংবা জোয়ার-ভাটার কারণে সমুদ্রের পানি সরে গিয়েছিল, তাদের কথা এ বর্ণনা থেকে অসার প্রমাণিত হয়। কেননা সে কারণে পানি সরলে তা দু’পাশে পাহাড়ের মত উঁচু হয়ে দাঁড়ায় না এবং মাঝের অংশ শুকনো সড়কে পরিণত হয় না।

“আমি মূসাকে অহীর মাধ্যমে নির্দেশ দিলাম, তুমি সমুদ্রের ওপর লাঠি দিয়ে আঘাত কর। তৎক্ষণাৎ সমুদ্র দু’ভাগ হয়ে গেল এবং দু’ভাগ দু’দিকে মস্তবড় পাহাড়ের মত উঁচু হয়ে দাঁড়াল”।–(সূলা শূয়ারাঃ ৬৩)

আরবী ভাষায় (আরবী******* মানে পাহাড়। লিছানুল আরব নামক অভিধান গ্রন্থে বলা হয়েছে (আরবী***********) মানে বিরাটকায় পাহাড়। এর ওপর আবার (আরবী********) তথা ‘বিরাট’ বিশেষণ প্রয়োগ করার অর্থ দাঁড়ায় এই যে, পানি উভয় দিকে অত্যন্ত উঁচু পাহাড়ের আকারে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। সমুদ্রের ভেতর দিয়ে এই যে রাস্তার ব্যবস্থা, এটা একদিকে বনী ইসরাঈলের কাফেলার পার হওয়ার সুযোগ করে দেয়া এবং অপরদিকে ফেরাউনের বাহিনীকে ডুবিয়ে দেয়ার উদ্দেশ্যেই করা হয়েছিল। এর থেকে পরিস্কার বুঝা যায় যে, পানি এত বড় উঁচু পাহাড়ের আকারে এত দীর্ঘ সময় ধরে দাঁড়িয়েছিল যে, লক্ষ লক্ষ ইসরাঈলী মোহাজেরদের কাফেলা তার ওপর দিয়ে পারও হয়ে গেল, আবার তাদের পর ফেরাউনের বাহিনী তার মাঝখান পর্যন্ত পৌঁছেও গেল।

এ কথা বলাই নিষ্প্রয়োজন যে, সাধারণ প্রাকৃতিক নিয়মের অধীন যেসব ঝড়ো হাওয়া প্রবহিত হয়, তা যত প্রচণ্ডই হোক না কেন, তার দরুন সমুদ্রের পানি এত বড় পাহাড়ের মত হয়ে এত দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে থাকে না। আরও লক্ষ্য করার ব্যাপার এই যে, সূরা ত্বাহায় বলা হয়েছে (আরবী************) ‘তাদের জন্যে সমুদ্রের মধ্যে শুকনো রাস্তা বানিয়ে দাও’। অর্থাৎ সমুদ্রের ওপর লাঠি দেয় আঘাত করায় শুধু যে পানি সরে গিয়ে দু’দিকে পাহাড়ের মত দাঁড়াল তা নয়, বরং ভেতরে যে রাস্তা হলো তা শুষ্ক হয়ে গেল। বিন্দুমাত্র কাঁদা পানি রইল না যে, চলাচলে ব্যঘ্যাত সৃষ্টি হতে পারে। এটা একটা সুস্পষ্ট মোজেযার বর্ণনা। সাধারণ প্রাকৃতিক নিয়মের অধীন এ ঘটনা ঘটেছিল বলে যারা এর ব্যাখ্যা দিতে চেষ্টা করেন, তাদের ধারণা যে ভ্রান্ত তা সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে।

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

সম্পর্কিত পোস্ট

দুঃখিত!