হযরত ঈসা (আঃ)-এর মোজেযা

হযরত ঈষা (আ)-এর মোজেযা

হযরত ঈসার বিনা বাপে জন্ম লাভ

“মরিয়মকে ও তার ছেলেকে আমি একটা নিদর্শন বানালাম এবং উভয়কে একটা উঁচু জায়গায় রাখলাম যেখানে তারা স্বস্তি লাভ করেছিল এবং যেখানে ঝর্ণাসমূহ প্রবাহিত ছিল”।–(সূরা মুমিনুনঃ ৫০)

এখানে এ কথা বলা হয়নি যে, মরিয়ম একটা নিদর্শন ছিল এবং মরিয়মের ছেলে আর একটা নিদর্শন ছিল। এ কথাও বলাহ য়নি যে, মরিয়ম ও তার ছেলেকে দু’টো নিদর্শনে পরিণত করেছি। বরং উভয়ের সমন্বয়ে একটা নিদর্শন বানান হয়েছে –এ কথাই বলা হয়েছে। এর তাৎপর্য এই যে, বাপ ছাড়া ঈসা (আঃ)-এর জন্ম হওয়া এবং পুরুষের সংসর্গ ছাড়া মরিয়মের গর্ভবতী হওয়াটাই মা ও ছেলের একত্রে একটি নিদর্শনে পরিণত হওয়ার কারণ।

“(আর হে মুহাম্মদ!) তুমি এ গ্রন্থে মরিয়ামের সেই ঘটনা বর্ণনা কর, যখন সে আপনজন থেকে আলাদা হয়ে পূর্ব নির্জনবাস গ্রহণ করেছিল। সে পর্দায় আচ্ছাদিত হয়ে তাদের থেকে লুকিয়েছিল। সে অবস্থায় আমি তার কাছে আপন আত্মা (ফেরেশতা)-কে পাঠালাম। সে তার কাছে পূর্ণ মানবীয় রূপে দেখা দিল। মরিয়ম ফেরেশতা-কে পাঠালাম। সে তার কাছে পূর্ণ মানবীয় রূপে দেখা দিল। মরিয়ম হঠাৎ বলে উঠলঃ তুমি যদি কোনো খোদাভীরু লোক হয়ে থাক তবে আমি তোমার থেকে দয়ামত খোদার আশ্রয় প্রার্থনা করি। সে বলল, আমি তোমার রবের দূত মাত্র। তোমাকে একটা পবিত্র সন্তান দান করবো, এ উদ্দেশ্যে এসেছি।

মরিয়ম বলল, আমার ছেলে হবে কেমন করে? আমাকে তো কোনো পুরুষ মানুষ স্পর্শও করেনি, আর আমি কোনো চরিত্রহীন মেয়েলোকও নই। ফেরেশতা বলল, এমনিই হবে। তোমার রব বলেছেনঃ এ কাজ আমার পক্ষে খুবই সহজ। আমি এ ছেলেটিকে মানবমণ্ডলীর জন্যে একটা নিদর্শন এবং নিজের পক্ষ থেকে এক অনুগ্রহে পরিণত করার উদ্দেশ্যেই এ কাজ করব। আর এটা আল্লাহর সিদ্ধান্তকৃত বিষয়, এটা হবেই। মরিয়ম সেই সন্তানটিকে গর্ভে ধারণ করল এবং দূরবর্তী স্থানে চলে গেল। অতপর প্রসব বেদনা তাকে এক খেজুর গাছের নীচে যেতে বাধ্য করল। সে বলতে লাগলঃ হায় এর আগে যদি আমার মরণ হত এবং আমার নাম-নিশানা না থাকত”।–(সূরা মরিয়মঃ ১৬-২৩)

এখানে দূরবর্তী স্থান অর্থে বেথলেহেমকে বুঝানো হয়েছে। হযরত মরিয়মের ই’তেকাফ থেকে বেরিয়ে সেখানে যাওয়া একটা স্বাভাবিক ব্যাপার ছিল। মরিয়ম একেতো ছিলেন বনী ইসরাঈলের সবচেয়ে ধার্মিক গোষ্ঠী বনী হারুনের বংশধর, তার ওপর আবার আল্লহার ইবাদাতের জন্যে নিবেদিতা হয়ে বায়তুল মাকদাসে অবস্থান করছিলেন। এমন মেয়ে হঠাৎ গর্ভবতী হয়ে পড়লেন। এ অবস্থায় তিনি যদি ই’তেকাফের জায়গায় বসে থাকতেন এবং তাঁর গর্ভের ব্যাপারটা জানাজানি হয়ে যেত তাহলে পরিবারের লোকেরা তো বটেই, তাঁর স্বজাতির অন্যান্য লোকেরাও তাঁর জবিন দুর্বিসহ করে তুলত।

বেচারী এ কঠিন মুসিবতে পড়ে নিশব্দে ই’তেকাফের কক্ষ ত্যাগ করে বেরিয়ে পড়লেন যাতে করে আল্লাহর ইচ্ছা পূর্ণ হওয়িার মুহুর্তটা পর্যন্ত অন্ততঃ স্বজাতির ধিক্কার-তিরস্কার ও ব্যাপক দুর্নাম থেকে বেঁচে থাকতে পারেন। এ বেরিয়ে পড়ার ঘটনাটি হযরত ঈসার বিনা বাপে পয়দা হওয়ার জ্বলন্ত প্রমাণ। মরিয়ম যদি বিবাহিত হতেন এবং স্বামী থেকেই তাঁর গর্ভধারণ হত তাহলে পিত্রালয় ও শ্বশুরালয় ছেড়ে সন্তান প্রসবের জন্যে একটা দূরবর্তী স্থানে চলে যাওযার কোনো কারণই ছিল না।

‘হায়, যদি আমার মরণ হত এবং আমার নাম-নিশানা না থাকতো’ –মরিয়মের এ উক্তি থেকেই বুঝা যায়, তিনি তখন কতখানি উদ্বিগ্ন ও দুশ্চিন্তাগ্রস্তা ছিলেন। অবস্থার নাজুকতা উপলব্ধি করলে সে কথা কারোই বুঝতে কষ্ট হয় না যে, কেবল প্রসব বেদনার দরুন তাঁর মুখ দিয়ে এ কথা বের হয়নি বরং আল্লাহ যে ভয়াবহ অগ্নিপরীক্ষায় তাঁকে ফেলেছিলেন তাতে কি করে তিনি ভালভাবে উত্তীর্ণ হবেন, এ চিন্তাই তাঁকে অস্থির করে রেখেছিল। গর্ভে সন্তান থাকার ব্যাপারটা না হয় এ যাবত কোনো না কোনো উপায়ে তিনি লুকিয়ে রেখেছেন। কিন্তু এখন এ সন্তানকে নিয়ে যাবেন কোথায়? মরিয়ম যে এ কথাগুলো বলেছিলেন তা পরবর্তী এ কথা থেকে প্রমাণিত হয় যখন ফেরেশতা তাঁকে বললেন, তুমি চিন্তিত হয়ো না। বিবাহিত মেয়ের প্রসবকাল উপস্থিত হলে কষ্টের দরুন সে যতোই ছটফটই করুক না কেন, সে কখনো চিন্তিত ও উদ্বিগ্ন হয় না।

দোলনায় সদ্য ভূমিষ্ঠ শিশুর কথা বলা

“যে যখন বাচ্ছাকে কোলে নিয়ে নিজের লোকজনের কাছে এলো তখন লোকেরা জিজ্ঞেস করল, হে মিরয়ম! তুমি এ কোত্থেকে নিয়ে এলে? হে হারুনের বোন! না তোমার বাপ খারাপ লোক ছিল, আর না তোমার মা চরিত্রহীনা ছিল”।–(সূরা মরিয়মঃ ২৭-২৮)

যারা হযরত ঈসার অলৌকিক জন্ম অস্বীকার করে তাদের কাছে এর কি ব্যাখ্যা আছে যে, হযরত মরিয়ম যখন বাচ্চা কোলে নিয়ে এলেন তখন তাঁর জাতির লোকজন ক্ষুব্ধ হয়ে তাঁকে নানারূপে তিরস্কার-ভর্ৎসনা করতে লাগল কেন?

“মরিয়ম তার বাচ্চার দিকে ইঙ্গিত করলে লোকেরা বললো, দোলনায় শায়িত শিশুর সাথে আমরা কি কথা বলবো”।–(সূরা মরিয়মঃ ২৯)

কুরআনের বিকৃত ব্যাখ্যাকারীগণ আয়াতটির অর্থ এরূপ করেছেন –“যে কালকের শিশু তার সাথে আমরা কি কথা বলবো?” অর্থাৎ তাদের মতে এসব কথাবার্তা হযরত ঈসার যৌবনকালে হয়েছে। বনী ইসরাঈলের বয়স্ক ও বুড়ো লোকেরা বলেছিল, ‘যে ছেলেকে সেদিন আমরা দোলনায় পড়ে থাকতে দেখলাম তার সাথে আবার কি কথা বলব?’ কিন্তু পরিবেশ পরিস্থিতি এবং পূর্বাপর বর্ণনা ধারা লক্ষ্য করলেই বুঝা যায় যে, মোজেযাকে এড়িয়ে চলার জন্যে এটা নিছক একটা অর্থহীন অপব্যাখ্যা মাত্র। এ অপব্যাখ্যাকারীরা আর কিছু না হোক শুধু কথাটাও ভেবৈ দেখলে পারতো যে, লোকরা যে ব্যাপারটা নিয়ে আপত্তি জানাতে এসেছিল সেটা তার যৌবনকালে ঘটেনি, ভূমিষ্ঠ হওয়ার সময়েই ঘটেছিল।

তাছাড়া সূরা আলে ইমরানের ৪৬তম আয়াতে এবং সূরা মায়েদার ১০ম আয়াতে দ্ব্যর্থহীনভাবে ও অকাট্যভাবে বলা হয়েছে যে, এসব কথাবার্তা হযরত ঈসা যৌবনকালে বলেননি, বরং তিনি যখন সদ্য প্রসূত এবং দোলনায় শায়িত তখনই বলেছেন। প্রথম আয়াতটিতে ফেরেশতা হযরত মরিয়মকে ছেলে হওয়ার পূর্বাভাস দেয়অর সময় বলেন যে, সে ছেলে মানুষের সাথে দোলনায় থাকতেও কথা বলবে, যৌবনকালেও কথা বলবে। দ্বিতীয় আয়াতে আল্লাহ স্বয়ং হযরত ঈসা কে বলেন, তুমি দোলনায় থাকতেও মানুষের সাথে কথা বলবে, আর যৌবনকালেও বলবে।

“শিশু বলে উঠল, আমি আল্লাহর বান্দাহ। তিনি আমাকে কিতাব দিয়েছেন, নবী বানিয়েছেন এবং কল্যাণময় বানিয়েছেন –তা আমি যেখানেই থাকি না কেন, আর আমাকে আজীবন নামায ও যাকাত পালন করার নির্দেশ দিয়েছেন। আমাকে তিনি মায়ের হক আদায়কারী বানিয়েছেন, অত্যাচারী ও হতভাগ্য বানাননি”।–(সূরা মরিয়মঃ ৩০-৩২)

এখানে পিতা-মাতার হক আদায়কারী বলা হয়নি, শুধু মায়ের হক আদায়কারী বলা হয়েছে। এর থেকেও প্রমাণিত হয় যে, হযরত ঈসার বাপ ছিল না। কুরআনের সর্বত্র তাঁকে মরিয়মের ছেলে ঈসা বলে উল্লেখ করাও এর আর একটি অকাট্য প্রমাণ।

“আমি যেদিন জন্মেছি, যেদিন মরবো এবং যেদিন আবার জীবিত হব, সবসময়েই আমার ও পর শান্তি”।–(সূরা মরিয়মঃ ৩৩)

এ হল সেই ‘নিদর্শন’ যা হযরত ঈসা (আ)-এর সত্তার মাধ্যমে বনী ইসরাঈলের সামনে পেশ করা হয়েছিল। আল্লাহ বনী ইসরাঈলকে তাদের অবিরাম দুষ্কর্মের জন্যে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়ার আগে তাদের সংশোধনের সর্বশেষ সুযোগ দিতে চাচ্ছিলেন। সে জন্যে তিনি এ কৌশল অবলম্বন করলেন যে, বনী হারুনের যে ধার্মিকা মেয়েটি বায়তুল মাকদাসে ই’তেকাফরত ছিল এবং হযরত যাকারিয়ার তত্ত্বাবধানে লালিত পালিত হচ্ছিল তাকে হঠাৎ কুমারী অবস্থায় গর্ভবতী করে দিলেন। তারপর সে যখন বাচ্চা কোলে নিয়ে হাযির হবে তখন গোটা জাতির মধ্যে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হবে এবং তাৎক্ষণিকভাবে সবার দৃষ্টি তার ওপরে পড়বে।

এ কৌশলের ফলে হযরত মরিয়মকে ঘিরে মানুষের ভিড় জমে উঠল তখন তিনি সেই সদ্যপ্রসূত শিশুকে দিয়ে কথা বলালেন –যাতে করে সেই শিশু বড় হয়ে যখন নবুয়াত লাভ করবে তখন যেন জাতির হাজার হাজার লোক এ সাক্ষ্য দেয়ার জন্যে বিদ্যমান থাকে যে, তারা ঐ শিশুর মধ্যে আল্লাহ তায়ালার এক বিস্ময়কর মোজেযা দেখতে পেয়েছে। এতদসত্ত্বেও যখন জাতি তার নবুয়াত অস্বীকার করবে এবং তাকে অনুসরণের পরিবর্তে অপরাধী সাজিয়ে শূলে চড়ানোর চেষ্টা করবে, তখন তাদেরকে এক দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া হবে যা দুনিয়ার অন্য জাতিকে দেয়া হয়নি।

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

সম্পর্কিত পোস্ট

দুঃখিত!