হযরত ইয়ারমিয়া (আঃ)
তাফসীরবিদের অভিমত পর্যালোচনা করলে হযরত ইয়ারমিয়া (আঃ)এর সময়কাল খ্রীষ্টপূর্ব সপ্তম শতাব্দী বলে অনুমান করা হয়। এ সময় বনী ইসরাঈল আল্লাহ্র নাফরমানী অবাধ্যতা এবং জুলুম অত্যাচার অবিচারে সীমালংঘন এবং মনুষ্যত্ববোধ পদদলিত করণে সর্বকালের রেকর্ড ভঙ্গ করে। হযরত ইয়ারমিয়া (আঃ) তাঁদেরকে জুলুম অত্যাচার করে আল্লাহ্ পাকের পথে ফিরে আসার আহ্বান জানান। কিন্তু দুর্ভাগ্য বনী ইসরাঈল তাঁর সদুপদেশ হিতোপদেশের প্রতি কোন প্রকার কর্ণপাত তো করেইনি, বরং নানাভাবে তাঁকে ঠাট্টা বিদ্রূপ করতে থাকে এবং জুলুম অত্যাচার, অবিচার আল্লাহ্র নাফরমানী পূর্বাপেক্ষা বেশী মাত্রায়ই করতে শুরু করে।
এক সময় তারা নবী হযরত ইয়ারমিয়া (আঃ) কে বন্দী করে। তিনি বন্দী অবস্থায়ও বনী ইসরাঈলদেরকে সাবধান বানী উচ্চারণ করে বললেন, যদি তোমরা এখনও আল্লাহ্র পথে প্রত্যাবর্তন না কর, তা হলে যে চরম সীমায় তোমরা পৌঁছেছ, তাতে তোমাদের জন্য শাস্তি অবধারিত। তা থেকে তোমরা কেউই রক্ষা পাবে না। বহিঃশত্রুর আক্রমণ জাতিগতভাবে তোমরা পর্যুদস্ত হবে। শেষ পর্যন্ত গোলামীর জীবনই হবে তোমাদের অদৃষ্টে।
কোন বহিঃশত্রু কর্তৃক আক্রান্ত হয়ে তারা পর্যদস্ত হবে। হযরত ইয়ারমিয়া (আঃ) তাও সুসম্পন্নভাবে ব্যক্ত করেন। তিনি বনী ইসরাঈলদেরকে বললেন, বাবেলের শাসক রোখতে নাসসার আক্রমণ করে তোমাদেরকে পর্যুদস্ত করবে। এ আক্রমণ তোমাদের জন্য আল্লাহ্র গজব হয়ে দেখা দিবে। বোখতে নাসসার যে শুধু তোমাদেরকে বন্দী করে বাবেলে নিয়ে যাবে তাই নয়, সে বায়তুল মোকাদ্দাসও ধ্বংস করবে। কিন্তু ঐদ্ধতা, হঠকারিতা, অবিশ্বাস এবং আম্বিয়ায়ে কেরামের সদুপদেশের অবমাননা, তৎপ্রতি অবহেলা যে বনী ইসরাঈলদের জাতীগত স্বভাব। তারা নবীর আহ্বানে সাড়া দিয়ে আল্লাহ্ পাকের পথে ফিরে আসার পাত্র নয়।
অবশেষে বাবেল অধিপতি বোখতে নাসসার বনী ইসরাঈলদের জন্য আল্লাহ্ পাকের গজব হিসাবেই আবির্ভূত হয়। সে উপর্যুপরি তিনবার আক্রমন করে বায়তুল মোকাদ্দাসসহ সমগ্র ফিলিস্তিন দখল করে। বায়তুল মোকাদ্দাসকে ধ্বংস স্তপে পরিণত করে এবং বনী ইসরাঈলদেরকে নির্বিচারে হত্যা করে হত্যা যজ্ঞ থেকে যারা কোন রকমে রক্ষা পেয়েছিল তাঁদেরকে বন্দী করে ছাগল ভেড়ার পালের মত হাকিয়ে বাবেলে নিয়ে যায়। তাওরাত কিতাবও ধ্বংস করে ফেলে। তাঁর ধ্বংস যজ্ঞ থেকে তাওরাতের একটি কপিও রক্ষা পায়নি। বাবেল অধিপতি যখন বনী ইসরাঈলদেরকে নির্বিচারে হত্যা এবং বন্দী করছিল, তখন এক ব্যক্তি বাবেলের অধিপতিকে হযরত ইয়ারমিয়া (আঃ) এর সন্ধান দেয়। যে বলল, তিনি আপনার এ আক্রমণ ও বিজয় লাভ সম্পর্কে পূর্বেই ভবিষ্যদ্বানী করছিলেন। কিন্তু বনী ইসরাঈলগণ তাঁর ভবিষ্যদ্বানীর প্রতি কর্ণপাত করেনি। উপরন্তু তাঁকে বন্দী করে রেখেছে। লোকটির কথায় বোখতে নাসসার বুঝে ফেলল, নিশ্চয় হযরত ইয়ারমিয়া (আঃ) একজন উচ্চ পর্যায়ের লোক।
অতএব, হযরত ইয়ারমিয়া (আঃ) কে বন্দী থেকে মুক্ত করে তাঁর সাথে কথাবার্তা বলে বোখতে নাসসার দৃঢ় প্রীতি জন্মাল হযরত ইয়ারমিয়া (আঃ) পরিপূর্ণ বুদ্ধিমত্তার অধিকারী এক অসাধারণ ব্যক্তিত্ব। তাঁর প্রতি বোখতে নাসসারের বিশেষ সমীহবোধ সৃষ্টি হয়। সে হযরত ইয়ারমিয়া (আঃ) কে বাবেলে গমনের অনুরোধ করে বলল, বনী ইসরাঈল আপানার মর্যাদা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। আমি আপনাকে যাথাযোগ্য সম্মান প্রদান করব। সুতরাং আপনি বাবেলে চলুন।
বোখতে নাসসারের অনুরোধ প্রত্যাখান করে হযরত ইয়ারমিয়া (আঃ) বললেন আমার সম্প্রদায়ের লোকজন অপমানিত ও লাঞ্চিত হয়ে বাবেলে যাচ্ছে। সুতরাং আমি এ মান সম্মান দিয়ে কি করব? এমন সম্মানের চেয়ে বর্তমান অবস্থায় আমার কাছে শ্রেয়। অতঃপর তিনি বায়তুল মোকাদ্দাস ত্যাগ করে দূরে এক জঙ্গলে গিয়ে বসবাস শুরু করেন। এখানে অবস্থানকালেই তিনি নবী ইসরাঈলদের সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বানী করলেন যে, তারা নিজেদের আবাসভূমিতে ফিরে আসবে। হযরত ইয়ারমিয়া (আঃ) এর ভবিষ্যতবাণীর দীর্ঘদিন পর বোখতে নাসসার মারা গেলে পারস্য সম্রাট বাবেল আক্রমণ করে তথাকার অধিপতিকে পরাজিত ও বনী ইসরাঈলদেরকে মুক্তি প্রদান করে। মুক্তি পেয়ে বনী ইসরাঈলগণ নিজেদের আবাসভূমি ফিলিস্তিনে ফিরে আসে।
হযরত ইয়ারমিয়া (আঃ) এর জীবনের শেষ পরিণতির সম্পর্কে কিছুই জানা যায়নি। তবে এতটুকু ধারণা করা যায়, বোখতে নাসসার কর্তৃক বায়তুল মোকাদ্দাস ধ্বংস এবং ফিলিস্তিন অধিকৃত হবার পরও তিনি কিছুদিন জীবিত ছিলেন। তারপর অত্যন্ত অজ্ঞাত অবস্থায়ই তাঁর জীবনাবসান ঘটে।