হযরত ইউসুফ (আঃ) -কে কূপে নিক্ষেপ
কেনান থেকে প্রায় বিস কিলোমিটার দূরে অবস্থিত পশু চারন ভূমির দিকে তাঁরা রওয়ানা করল। পিতার সম্মুখ থেকে হযরত ইউসুফ (আঃ)- কে কাঁধে তুলা তাঁরা পথ যাত্রা আরম্ভ করল। কিছুদূর গিয়ে তাঁরা হযরত ইউসুফ (আঃ)- কে কাঁধ থেকে নামিয়ে হেঁটে পথ অতিক্রম করতে আদেশ দেয়। হযরত ইউসুফ (আঃ) ছোট মানুষ। তাঁর বয়স তখন মাত্র বার বছর। ভাইদের সাথে তাল মিলিয়ে হাঁটার সক্ষমতা তাঁর ছিল না। তাই তিনি কিছুটা দৌড়ে ভাইদের চলার গতির সাথে সামঞ্জস্যতা বজায় রাখলেন। যদিও তিনি খুব ক্লান্তি বোধ করলেন। খুব হাপিয়ে গেলেন তবুও মনের আনন্দে ভাইদের সাথে পথ অতিক্রম করতে লাগলেন।
পথিমধ্যে সৎ ভাইয়েরা হযরত ইউসুফ (আঃ)-কে নিয়ে নানা জল্পনা-কল্পনা আরম্ভ করল। কেউ সরাসরি হত্যার প্রস্তাব দিল। কেউ বিদেশে পাচারের কথা বলল। আবার কেউ কূপে নিক্ষেপের পরামর্শ দিল। এভাবে কথা বার্তা বলতে বলতে তারা গিয়ে চারণ ভূমিতে পৌঁছল।
হযরত ইউসুফ (আঃ) নতুন জায়গায় নানা রকম প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলী অবলোকন করে খুব আনন্দিত হলেন। তিনি এদিক সেদিক ছুটাছুটি করে তৃপ্তিলাভ করতে লাগলেন। এমন সময় তাঁর এক ভাই এসে তাঁকে মারধর আরম্ভ করল। কিছুক্ষণের মধ্যে আরো দুই ভাই এসে হযরত ইউসুফ (আঃ) এর প্রতি বেদম অত্যাচার শুরু করে দিল। এমনকি তাঁকে পাথর দিয়ে আঘাত করতেও ছাড়ল না। তাঁর শরীর ক্ষত-বিক্ষত হল। মাটিতে উপুড় করে ফেলে পা দিয়ে আঘাতের পর আঘাত করতে লাগল।
হযরত ইউসুফ (আঃ) অত্যন্ত কাকুতির সাথে বললেন, “তোমরা আমাকে এভাবে মারছ কেন? আমি তো কোন অন্যায় করিনি। তোমরা পিতার নিকট আমার নিরাপত্তার ওয়াদা করে এখন অত্যাচার আরম্ভ করে দিলে। এটা কি ওয়াদা ভঙ্গের শামিল নয়? তোমরা আমার ভাই, আমার প্রতি তোমাদের কোন দয়া মায়া নেই? তোমরা আমাকে আর মের না। আমি আর সহ্য করতে পারি না।” এক ভাই তখন বলল, “তুই নাকি স্বপ্নে একাদশ নক্ষত্র ও চন্দ্র-সূর্যকে দেখেছিস; তারা তোকে সেজদা করছে। অতএব এখন তাদেরকে ডেকে রক্ষার ব্যবস্থা গ্রহণ কর। আমরা তোকে মেরে ফেলব।” এই বলে তারা অত্যাচারের মাত্রা আরো বাড়িয়ে দিল।
অন্যান্য ভাইয়েরা এ দৃশ্য দেখে তৃপ্তিলাভ করছিল। কেউ কোন রূপ বাধা প্রদান করল না। দীর্ঘ সময় পরে ইয়াহুদ এসে বলল, “তোমরা ওকে মারছ কেন? এভাবে মারধর করার কথা ছিল না। তোমাদের যা ইচ্ছা তাই করলে নিজেদের মধ্যে কলহের সৃষ্টি হবে। তোমরা নিবৃও হও এবং ইউসুফকে গভীর এক কূপের মধ্যে ফেলে দিয়ে আমরা ফিরে যাই। তাহলে সকল দিক রক্ষা পাবে। হত্যার অভিযোগ থেকে আমরা মুক্তি পাব এবং ইউসুফকেও পিতার নিকট থেকে দূর করা হবে। পরে তওবা করে আমরা আল্লাহ তা’য়ালার নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করব।”
ইয়াহুদের কথায় সকলের চেতনা ফিরে এল। তখন তারা হযরত ইউসুফ (আঃ) কে নিয়ে একটি গভীর কূপের নিকট গমন করল এবং তাঁকে উলঙ্গ করে তাঁর হাত পা রশি দিয়ে বেঁধে নিল। অতঃপর বালতির উপর বসিয়ে তাঁকে কূপে ফেলতে আরম্ভ করল। হযরত ইউসুফ (আঃ) ভাইদের নিকট কাকুতির সঙ্গে কেঁদে কেঁদে জীবন ভিক্ষা চাইল। পিতার নিকট তাদের প্রতিশ্রুতির কথা বার বার স্মরণ করিয়ে দিল। আলাহ তা’য়ালার বিধান অনুসারে ন্যায় অন্যায়ের প্রতি তাদের দৃষ্টি আকর্ষন করল। কিছুতেই কোন কাজ হল না। তারা বালতির রশি ধীরে ধীরে ঢিল দিতে আরম্ভ করল। বালতি যখন মাঝা মাঝি স্থানে পৌঁছল তখন শমুন অগ্রসর হয়ে ইয়াহুদের হাত থেকে বালতির রশি হাতে নিয়ে একবারে রশি কেটে দিল। যাতে বালতি হটাৎ করে পড়ে গিয়ে হযরত ইউসুফ (আঃ) একেবারে মারা যায়।
ভাইদের এহেন নিষ্ঠুর আচরণের মুহূর্তে আল্লাহ তা’য়ালা হযরত জিব্রাঈল (আঃ) কে পাঠিয়ে তার প্রিয় নবীকে রক্ষা করেন। হযরত জিব্রাঈল (আঃ) তৎক্ষণাৎ সেখানে উপস্থিত হয়ে বালতির রশি ধরে ফেলেন এবং হযরত ইউসুফ (আঃ) কে ধীরে ধীরে কূপের নিচে একখানা পাথরের উপর অবতরণ করান এবং তাঁকে বেহেশতী পোশাক পরিয়ে দেন।
হযরত ইউসুফ (আঃ) নির্বিঘ্নে পাথরের উপর বসে আল্লাহ তা’য়ালার শুকরিয়া আদায় করেন। কিন্তু তাঁর বৃদ্ধ পিতার কথা মন থেকে মুছে ফেলতে পারলেন না। তাই তাঁর ক্রন্দনের ঢেউ অব্যাহত থাকল। তখন হযরত জিব্রাঈল (আঃ) আল্লাহ তা’য়ালার তরফ থেকে তাঁকে সান্তনার বানী পৌঁছে দিলেন। “হে ইউসুফ! তুমি ভয় পেয়ো না। একদিন তোমার এই অত্যাচারী ভাইদের উপর তুমি বিজয়ী হবে। সেদিন তোমার থাকবে আনন্দ উচ্ছল বদন আর ওদের থাকবে মলিন ও যাতনা ক্লিষ্ট বদন। কিন্তু ওরা এ খবর আদৌ জানে না। আর সেদিন বেশি দূরে নয় যেদিন ওরা থাকবে তোমার অধীন, তুমি থাকবে ওদের মনিব।”
সূত্রঃ কুরআনের শ্রেষ্ঠ কাহিনী