হযরত আয়িশা সিদ্দীকা (রাঃ) -এর ৯ পর্ব

হযরত আয়িশা সিদ্দীকা (রাঃ) -এর ৮ পর্ব পড়তে ক্লিক করুন

একবার এক সফরে চলার পথে ‘আয়িশার (রাঃ) উটনীটি হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে তাঁকে নিয়ে দৌড় দেয়। এতে রাসূলে কারীম (সাঃ) এতই অস্থির হয়ে পড়েন যে, তাঁর মুখ থেকে উচ্চারিত হতে শোনা যায়:
“ওয়া আরূসাহ!”
(হায়! আমার বধূ!)

হযরত রাসূলে কারীম (সাঃ) অন্তিম রোগ শয্যায় বারবার জিজ্ঞেস করতে লাগলেন:
“আজ কি বার?”

সকলেই বুঝলেন, তিনি ‘আয়িশার বারির দিনটির অপেক্ষা করছেন। সুতরাং তাঁকে ‘আয়িশার (রাঃ) ঘরে নিয়ে যাওয়া হলো। ওফাত পর্যন্ত তিনি সেখানেই অবস্থান করেন। ‘আয়িশার (রাঃ) বুকে মাথা রেখে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তেরো দিন রাসূল (সাঃ) অসুস্থ ছিলেন। তার মধ্যে পাঁচ দিন অন্য স্ত্রীদের ঘরে এবং আট দিন ‘আয়িশার (রাঃ) ঘরে কাটান।

পরবর্তীকালে ‘আয়িশা (রাঃ) বলতেন:
“রাসূল (সাঃ) আমার ঘরে, আমার বারির দিনে, এবং আমার বুকে ইন্তিকাল করেছেন। জীবনের একেবারে অন্তিম মুহূর্তে ‘আবদুর রহমান ইবন আবী বকর (রাঃ) একটি কাঁচা মিসওয়াক হাতে করে রাসূলুল্লাহকে (সাঃ) দেখতে আসেন। রাসূল (সাঃ) সেই মিসওয়াকটির দিকে বারবার তাকাতে লাগলেন। বুঝলাম, তিনি সেটা চাচ্ছেন। আমি সেটা নিয়ে ধুয়ে নিজে চিবিয়ে বরম করে রাসূলুল্লাহকে (সাঃ) দিলাম। তিনি সেটা দিয়ে সুন্দরভাবে মিসওয়াক করলেন। তারপর আমাকে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য হাত বাড়ালেন, কিন্তু হাতটি পড়ে গেল। তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন। সেই মহান আল্লাহর প্রশংসা, যিনি তাঁর রাসূলের পার্থিব জীবনের শেষ মুহূর্তটিতে আমার এবং তাঁর থুতু মিলিত করেছেন।”

অনেকের মনে হয় যে, ‘আয়িশার (রাঃ) প্রতি রাসূলুল্লাহর (সাঃ) এমন আবেগ ও মুগ্ধতার কারণ তাঁর রূপ-লাবণ্য। কিন্তু এই ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। রাসূলে পাকের সহধর্মিণীদের মধ্যে জুওয়াইরিয়া, জায়নাব ও সাফিয়্যা (রাঃ) ছিলেন সর্বাধিক সুন্দরী। তাঁদের সৌন্দর্যের কথা হাদীস, সীরাত ও ইতিহাসের গ্রন্থাবলীতে বিদ্যমান। কিন্তু ‘আয়িশার (রাঃ) রূপ-লাবণ্যের কথা দুই-একটি স্থান ব্যতীত তেমন উল্লেখ নেই।

যেমন একবার উমার (রাঃ) হাফসাকে (রাঃ) উপদেশ দিতে গিয়ে ‘আয়িশার (রাঃ) সম্পর্কে একটি মন্তব্য করেন। তা শুনে রাসূল (সাঃ) হেসে দেন। মূলতঃ উমারের এ মন্তব্য দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, ‘আয়িশা (রাঃ) হাফসার (রাঃ) চেয়ে প্রাধান্য পাওয়ার যোগ্য ছিলেন।

আসল কথা হলো, রাসূল (সাঃ) যা বলেছেন, তাই বলেছেন: বিয়ের জন্য কনের নির্বাচন চারটি গুণের ভিত্তিতে হতে পারে—
১. ধন-সম্পদ
২. রূপ-সৌন্দর্য
৩. বংশ-মর্যাদা
৪. দীনদারী

তোমরা দীনদারীর সন্ধান করবে। এ কারণে যাঁর দ্বারা দীনের অধিক খিদমাত সম্ভব, সেই স্ত্রীদের মধ্যে তিনিই রাসূলুল্লাহর (সাঃ) সর্বাধিক ভালোবাসার পাত্রী ছিলেন। ‘আয়িশার (রাঃ) সমঝ-বুঝ, চিন্তা-অনুধ্যান, হুকুম-আহকাম স্মৃতিশক্তি অন্যান্য স্ত্রীদের তুলনায় অতিমাত্রায় বেশি ছিল। মূলতঃ এসব গুণই তাঁকে স্বামীর প্রিয়তমা করে তুলেছিল। আল্লামা ইবন হাযাম তাঁর ‘আল-মিলাল ওয়ান নিহাল’ গ্রন্থে বিস্তারিত আলোচনা করে একথা প্রমাণ করেছেন। বিভিন্ন হাদীস গ্রন্থে রাসূলুল্লাহর (সাঃ) এ হাদীসটি বর্ণিত হয়েছে।

আরবী হবে:
পুরুষদের মধ্যে অনেকেই কামালিয়াত বা পূর্ণতা অর্জন করেছেন, কিন্তু নারীদের মধ্যে মারিয়ম বিনত ইমরান এবং ফির’আউনের স্ত্রী আসিয়া ছাড়া আর কেউ পূর্ণতা অর্জন করতে পারেনি। তবে গোটা নারী জাতির মধ্যে ‘আয়িশার (রাঃ) মর্যাদা অন্য সকল নারীর মতোই সর্বাধিক।

‘আয়িশাকে (রাঃ) রাসূলুল্লাহর (সাঃ) এত বেশি ভালোবাসার তাৎপর্য এই হাদীস দ্বারা বোঝা যায়। তাঁর মুগ্ধতা ‘আয়িশার (রাঃ) রূপ-যৌবন বা সৌন্দর্য্যে নয়; বরং তা ছিল তাঁর অন্তর্গত গুণাবলী ও পূর্ণতায়। আর এই অন্তর্গত গুণাবলীর ক্ষেত্রে ‘আয়িশার (রাঃ) পরে স্থান ছিল উম্মু সালামা (রাঃ)-এর। এ কারণে বয়স্কা ওহয়া সত্ত্বেও তিনিও রাসূলুল্লাহর (সাঃ) গভীর ভালোবাসার পাত্রী ছিলেন। হযরত খাদীজা (রাঃ) পঁয়ষট্টি বছর বয়সে ওফাত লাভ করেছেন, এবং তাঁর ভালোবাসা রাসূলুল্লাহর (সাঃ) হৃদয়ের এত গভীরে ছিল যে, তাতে ‘আয়িশা (রাঃ) ঈর্ষা পোষণ করতেন।

স্বামী রাসূলুল্লাহর (সাঃ) প্রতি ছিল ‘আয়িশার (রাঃ) বুকভরা পবিত্র ভালোবাসা। সেই ভালোবাসায় অন্য কেউ ভাগের দাবিদার হলে তিনি কষ্ট পেতেন। কখনো রাতে ‘আয়িশার (রাঃ) ঘুম ভেঙে গেলে পাশে স্বামীকে না পেলে অস্থির হয়ে পড়তেন। একদিন গভীর রাতে ঘুম ভেঙে গেল। পাশে স্বামীকে পেলেন না। ঘরে বাতিও জ্বলতো না। অন্ধকারে এদিক-ওদিক হাত ছুঁড়তে লাগলেন। অবশেষে এক স্থানে স্বামীর কদম মুবারাক খুঁজে পেলেন। তিনি সিজদায় পড়ে আছেন।

আরও একবার একই অবস্থায় অবতারণা হলো। ‘আয়িশা (রাঃ) মনে করলেন, হয়তো স্বামী অন্য কোনো স্ত্রীর ঘরে গেছেন। তিনি তৎক্ষণাৎ এদিক-ওদিক দেখতে লাগলেন। দেখলেন, স্বামী এক কোণে নীরবে তাসবীহ পাঠে নিমগ্ন আছেন। ‘আয়িশা (রাঃ) নিজের অমূলক ধারণার জন্য লজ্জিত হলেন। তিনি নিজের মনে বলে উঠলেনঃ আমার মা-বাবা উৎসর্গীত হোক! আমি কোন ধারণায় আছি, আর তিনি কোন অবস্থায় আছেন।

অন্য এক রাতের ঘটনা। ‘আয়িশা (রাঃ) মধ্যরাতে জেগে উঠলেন। পাশে স্বামীকে না পেয়ে এখানে সেখানে খোঁজাখুঁজি করতে করতে কবরস্থানে পৌঁছে দেখলেন, তিনি দু’আ ও ইস্তিগফারে নিমগ্ন। তিনি আবার নীরবে ফিরে এলেন। সকালে এই ঘটনা স্বামীর কাছে বললে তিনি উত্তর দিলেনঃ হাঁ, রাতে আমার সামনে দিয়ে কোনো একটি জিনিস যাচ্ছিল মনে হয়েছিল। তাহলে তা তুমি হবে।

একবার এক সফরে ‘আয়িশা (রাঃ) ও হাফসা (রাঃ) রাসূলুল্লাহর (সাঃ) সফর সঙ্গিনী ছিলেন। রাতে চলার পথে রাসূল (সাঃ) ‘আয়িশার (রাঃ) বাহনের পিঠে বসে তাঁর সাথে কথা বলতে চাচ্ছিলেন।

হযরত আয়িশা সিদ্দীকা (রাঃ) -এর ১০ পর্ব পড়তে ক্লিক করুন

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

সম্পর্কিত পোস্ট

দুঃখিত!