হযরত আয়িশা সিদ্দীকা (রাঃ) -এর ৮ পর্ব

হযরত আয়িশা সিদ্দীকা (রাঃ) -এর ৭ পর্ব পড়তে ক্লিক করুন

হযরত রাসূলে কারীম (সাঃ) যখন ওফাত লাভ করলেন, তখন গোটা আরব ইসলামের ছায়াতলে এসে গেছে। বিভিন্ন অঞ্চল থেকে প্রচুর অর্থ-সম্পদ বাইতুলমালে জমা হচ্ছে। তা সত্ত্বেও, যেদিন রাসূল (সাঃ) ওফাত লাভ করলেন, সেই দিন হযরত ‘আয়িশার (রাঃ) ঘরে এক দিনেরও চলার মত খাবার ছিল না।

হযরত আবু বকর সিদ্দীকের (রাঃ) খিলাফতের সময়ে হযরত ‘আয়িশা (রাঃ) খায়বারে উৎপাদিত ফসল থেকে নির্দিষ্ট পরিমাণ শস্য পেতেন। খলীফা হযরত ‘উমার (রাঃ) সবার জন্য গমের ভাতার প্রচলন করেন। রাসূলুল্লাহর (সাঃ) স্ত্রীদের প্রত্যেকের জন্য বাৎসরিক দশ হাজার দিরহাম নির্ধারণ করা হয়েছিল। কিন্তু হযরত ‘আয়িশার (রাঃ) জন্য নির্ধারণ করা হয়েছিল বারো হাজার। কারণ তিনি বলতেনঃ ‘আয়িশা ছিলেন রাসূলুল্লাহর (সাঃ) প্রিয়তমা স্ত্রী।

একটি বর্ণনায় এসেছে, খলীফা হযরত ‘উমার (রাঃ) তাঁর সময়ে খায়বারে উৎপন্ন ফসলের অংশ অথবা ভূমি গ্রহণের এখতিয়ার দান করেন। হযরত ‘আয়িশা (রাঃ) তখন ভূমি গ্রহণ করেন।

অর্থ-সম্পদ যা কিছু তাঁর হাতে আসতো, তা গরীব-মিসকীনদের মধ্যে অকাতরে বিলিয়ে দিতেন। খলীফা হযরত উসমান (রাঃ) থেকে শুরু করে আমীর মু’য়ারিয়া (রাঃ) পর্যন্ত উল্লিখিত ব্যবস্থা বিদ্যমান ছিল। হযরত ‘আবদুল্লাহ ইবন যুবাইর (রাঃ) ছিলেন হযরত ‘আয়িশার (রাঃ) ভাগ্নে, যিনি আমীর মু’য়ারিয়ার (রাঃ) পরে হিজাযের খলীফা হন। তিনি খালার যাবতীয় ব্যয়ভার বহন করতেন। কিন্তু যেদিন বাইতুলমাল থেকে ভাতা না আসতো, সেই দিন হযরত ‘আয়িশার (রাঃ) গৃহে অভূক্ত থাকার উপক্রম হতো।

স্বাভাবিকভাবেই হযরত ‘আয়িশার (রাঃ) তীক্ষ্ণ বুদ্ধি ও বোধ থাকা সত্ত্বেও বয়স কম হওয়ার কারণে মাঝে মধ্যে ভুল-ত্রুটি হয়ে যেত। একবার ঘরে গম পিষে আটা বানিয়ে ঘুমিয়ে পড়েন, তখন একটি ছাগল এসে তা খেয়ে ফেললো। একদিন তিনি নিজ হাতে আটা পিষে রুটি তৈরি করেন এবং রাসূলুল্লাহর (সাঃ) আগমনের প্রতীক্ষায় থাকেন। সময়টি ছিল রাতের বেলা। একপর্যায়ে রাসূল (সাঃ) আসলেন এবং নামাযে দাঁড়িয়ে গেলেন। ঘুমে হযরত ‘আয়িশার (রাঃ) চোখ দুইটি বন্ধ হয়ে এলো। এই ফাঁকে প্রতিবেশীর একটি ছাগল ঘরে ঢুকে সবকিছু খেয়ে ফেললো। রাসূলুল্লাহর (সাঃ) বয়স্ক স্ত্রীদের তুলনায় তিনি খাদ্য-খাবার ভালোভাবে পাকাতে পারতেন না।

দাম্পত্য জীবন

রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ও হযরত ‘আয়িশার (রাঃ) যুগল জীবন এবং তাঁদের মধ্যের মধুর সম্পর্কের একটি চিত্র আমাদের সামনে থাকা দরকার। ইসলাম নারীকে না অতি পবিত্র মনে করে দেবীর আসনে বসিয়েছে, এবং না তাকে কেবল পুরুষের ভোগের বস্তু বলে মনে করেছে। নারী সম্পর্কে প্রাচীন ও আধুনিক কালের পৃথিবীর মানুষের ধারণা মূলত এমনই। তাই কোন সমাজে নারী কখনও সঠিক মর্যাদা পায়নি। একমাত্র ইসলামই নারীর সঠিক মর্যাদা দিয়েছে। ইসলাম নারীর সর্বোত্তম পরিচিতি তুলে ধরেছে: এই দ্বন্দ্ব-সংঘাতময় বিশ্বের নারী হলো পুরুষের প্রশান্তি ও সান্ত্বনার উৎস। কুরআনে আল্লাহ তা‘আলা ঘোষণা করেছেন:

“আরবী হবে – আর এক নিদর্শন এই যে, তিনি তোমাদের জন্যে তোমাদের মধ্য থেকে তোমাদের সংগিনীদের সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা তাদের কাছে প্রশান্তি লাভ করতে পার এবং তিনি তোমাদের মধ্যে পারস্পরিক প্রেম-প্রীতি ও দয়া সৃষ্টি করেছেন।”
(সূরা আর-রূম, ৩০:২১)

আল্লাহ পাকের এই ঘোষণার বাস্তব চিত্র আমরা দেখতে পাই রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ও হযরত ‘আয়িশার (রাঃ) দাম্পত্য জীবনের মধ্যে। রাসূল (সাঃ) বলেছেন:

“আরবী হবে – তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তি সর্বোত্তম, যে তার স্ত্রীর নিকট সর্বোত্তম। আমি আমার স্ত্রীদের নিকট তোমাদের সকলের চেয়ে উত্তম।”

তাঁদের নয় বছরের দাম্পত্য জীবনে ছিল গভীর ভালোবাসা, পারস্পরিক সহমর্মিতা, সীমাহীন আবেগ ও নিষ্ঠা। কঠিন দারিদ্র্য, অনাহার, তথা সকল প্রতিকূল পরিবেশেও তাঁদের মধুর সম্পর্কে একদিনের জন্যও ক্ষয় দেখা যায়নি। কোন রকম তিক্ততা বা মনোমালিন্য সৃষ্টি হয়নি।

হযরত রাসূলুল্লাহ (সাঃ) হযরত ‘আয়িশাকে (রাঃ) গভীরভাবে ভালোবাসতেন। এ কথা গোটা সাহাবী সমাজের জানা ছিল। এ কারণে রাসূল (সাঃ) যেদিন হযরত ‘আয়িশার (রাঃ) ঘরে কাটাতেন, সেদিন সাহাবীরা বেশি বেশি হাদিয়া-তোহফা পাঠাতেন। এতে অন্য স্ত্রীরা কিছুটা ক্ষুব্ধ হতেন। তাঁরা চাইতেন রাসূল (সাঃ) লোকদের নির্দেশ দিন যেন যেখানে থাকেন, লোকেরা সেখানেই যা কিছু পাঠাবে। কিন্তু সে কথা বলার হিম্মত কারো হতো না।

এই কারণে তাঁরা সবাই মিলে তাঁদের মনের কথা রাসূলুল্লাহর (সাঃ) কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য ফাতিমা (রাঃ)-কে বেছে নেন। ফাতিমা (রাঃ) পিতার কাছে তাঁদের বক্তব্য পৌঁছে দেন। রাসূল (সাঃ) ফাতিমাকে বললেন:
“মা, আমি যা চাই, তুমি কি তা চাও না?”

ফাতিমা (রাঃ) পিতার ইচ্ছা বুঝতে পারলেন এবং ফিরে এলেন। এরপরও রাসূলুল্লাহর (সাঃ) স্ত্রীরা আবার তাঁকে পাঠাতে চাইলেন; কিন্তু ফাতিমা ছিলেন বয়স্ক, বুদ্ধিমতী ও রসিক মহিলা। তিনি যথাযথভাবে তাঁদের মনের কথা রাসূলুল্লাহর (সাঃ) কাছে জানালেন।

রাসূল (সাঃ) তাকে বললেন:
“উম্মু সালামা! আয়িশার ব্যাপারে তোমরা আমাকে বিরক্ত করবে না। কারণ ‘আয়িশা ছাড়া আর কোনো স্ত্রীর লেপের নীচে আমার উপর ওহী নাযিল হয়নি।”

ইমাম জাহাবী উল্লেখ করেছেন যে, রাসূলুল্লাহর (সাঃ) এই জবাব দ্বারা স্পষ্ট হয় যে, অন্যদের তুলনায় হযরত ‘আয়িশাকে (রাঃ) সর্বাধিক ভালোবাসার অন্যতম কারণ হলো আল্লাহর নির্দেশ। আল্লাহর নির্দেশেই তিনি হযরত ‘আয়িশাকে (রাঃ) এত ভালোবাসতেন।

হযরত ‘আমর ইবনুল ‘আস (রাঃ) ‘জাতুস সালাসিল’ যুদ্ধ থেকে ফিরে এসে একদিন রাসূলুল্লাহকে (সাঃ) জিজ্ঞেস করলেন:
“ইয়া রাসূলুল্লাহ! এই পৃথিবীতে আপনার সবচেয়ে প্রিয় ব্যক্তি কে?”

রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন:
“আয়িশা।”

হযরত ‘আমর ইবনুল ‘আস (রাঃ) আবার জিজ্ঞেস করলেন:
“ইয়া রাসূলুল্লাহ! আমার প্রশ্ন পুরুষ সম্পর্কে।”

রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন:
“আয়িশার পিতা।”

একবার হযরত ‘উমার (রাঃ) মেয়ে উম্মুল মুমিনীন হাফসাকে (রাঃ) উপদেশ দিতে গিয়ে বললেন:
“তুমি আয়িশার সাথে পাল্লা দিতে যেও না। কারণ সে তো রাসূলুল্লাহর (সাঃ) প্রিয়তমা।”

হযরত আয়িশা সিদ্দীকা (রাঃ) -এর ৯ পর্ব পড়তে ক্লিক করুন

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

সম্পর্কিত পোস্ট

দুঃখিত!