হযরত আয়িশা সিদ্দীকা (রাঃ) -এর ৬ পর্ব পড়তে ক্লিক করুন
আর একবার রাসূল (সাঃ) দু’আ করলেনঃ
“হে আল্লাহ! আমাকে দরিদ্র অবস্থায় বাঁচিয়ে রাখ, দরিদ্র অবস্থায় মৃত্যু দাও এবং কিয়ামতের দিন দরিদ্রদের সাথেই উঠাও।”
‘আয়িশা (রাঃ) বললেনঃ
“কেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ!”
রাসূল (সাঃ) বললেনঃ
“সম্পদহীনরা সম্পদশালীদের চেয়ে চল্লিশ বছর পূর্বে জান্নাতে যাবে। ‘আয়িশা, কোনো ভিক্ষুককে কিছু না দিয়ে ফিরিয়ে দিও না। তা সে খোরমার একটি টুকরোই হোক না কেন। দরিদ্রদের ভালোবাসবে এবং তাদেরকে নিজের পাশে বসাবে।”
হাদীস ও সীরাতের গ্রন্থসমূহে হযরত ‘আয়িশা (রাঃ) এ জাতীয় অসংখ্য প্রশ্ন ও তার জবাব বর্ণিত হয়েছে। মূলত এগুলোই ছিল তাঁর নিত্যদিনের পাঠ। বিভিন্ন নৈতিক উপদেশ ছাড়াও নামাজ, হজ্জ, যাকাত, তথা দীন ও দুনিয়ার অসংখ্য বিষয় রাসূলুল্লাহ (সাঃ) হযরত ‘আয়িশাকে (রাঃ) অত্যন্ত ধৈর্যসহকারে শেখাতেন। ‘আয়িশা (রাঃ) অতি আগ্রহসহকারে শিখতেন এবং অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে তা আমল করতেন।
হযরত ‘আয়িশা (রাঃ)-এর মধ্যে জানার আগ্রহ ছিল অতি তীব্র। যে কোনও মুহূর্তে রাসূলুল্লাহর (সাঃ) অসন্তুষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা থাকলেও তিনি জিজ্ঞেস করা থেকে বিরত থাকতেন না। মূলত তিনি স্বামী হযরত রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর স্বভাব ও প্রকৃতি সম্পর্কে অভিজ্ঞ ছিলেন। তাই তিনি খোলামেলা ও দুঃসাহসী হতে পারতেন।
একবার রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কোনো কারণে স্ত্রীদের প্রতি বিরক্ত হয়ে অঙ্গীকার করলেন যে, আগামী এক মাস কোনও স্ত্রীর কাছেই যাবেন না। ঊনত্রিশ দিন এই অঙ্গীকারের উপর অটল থাকলেন। ঘটনাক্রমে সেই চন্দ্র মাসটি ছিল ঊনত্রিশ দিনের। রাসূল (সাঃ) পরের মাসের প্রথম তারিখ অর্থাৎ ৩০তম দিনে ‘আয়িশা (রাঃ)-এর নিকট গেলেন। আপাতদৃষ্টিতে ‘আয়িশা (রাঃ) উল্লাসিত হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু আমরা দেখতে পাই, তিনি প্রশ্ন করলেনঃ
“ইয়া রাসূলুল্লাহ! আপনি বলেছেন, এক মাস আমাদের কাছে আসবেন না। একদিন আগে কিভাবে এলেন?”
রাসূল (সাঃ) বললেনঃ
“‘আয়িশা! মাস ঊনত্রিশ দিনও হয়।”
সংসার জীবনঃ
হযরত ‘আয়িশা (রাঃ) পিতৃগৃহ থেকে বউ হয়ে যে ঘরে ওঠেন, তা কোনো আলিশান অট্টালিকা ছিল না। মদীনার বনু নাজ্জার মহল্লার মসজিদে নববীর চারপাশে ছোট ছোট কিছু কাঁচা ঘর ছিল, তারই একটি ঘরে তিনি এসে ওঠেন। ঘরটি ছিল মসজিদের পূর্ব দিকে। এর একটি দরজা ছিল পশ্চিম দিকে, মসজিদের ভিতরে। ফলে ঘরটি মসজিদের আঙ্গিনায় পরিণত হয়েছিল।
হযরত রাসূলুল্লাহ (সাঃ) সেই দরজা দিয়ে মসজিদে প্রবেশ করতেন। যখন তিনি মসজিদে ইতিকাফ করতেন, মাথাটি ঘরের মধ্যে ঢুকিয়ে দিতেন, আর ‘আয়িশা (রাঃ) চুলে চিরুনী করতেন। কখনো মসজিদে বসে থাকলেও ঘরের মধ্যে হাত ঢুকিয়ে দিয়ে কোনো কিছু ‘আয়িশা (রাঃ)-এর নিকট থেকে চেয়ে নিতেন।
ঘরটির প্রশস্ততা ছিল ছয় হাতেরও বেশি। দেয়াল ছিল মাটির। ছাদ খেজুরের পাতা ও ডালের তৈরি, তার উপরে বৃষ্টি থেকে বাঁচার জন্য কম্বল দেওয়া যেত। ছাদ এতটুকু উঁচু ছিল যে একজন মানুষ দাঁড়ালে তার হাতে ছাদের নাগাল পাওয়া যেত। একটি পাল্লার দরজা ছিল, কিন্তু তা খনো বন্ধ করার প্রয়োজন পড়েনি। পর্দার জন্য দরজায় একটি কম্বল ঝুলানো থাকতো।
ঘরের লাগোয়া আর একটি ঘর ছিল, যাকে ‘মাশরাবা’ বলা হতো। একবার রাসূল (সাঃ) স্ত্রীদের থেকে পৃথক থাকার সময় এক মাস তিনি এখানেই কাটান।
ঘরে আসবাবপত্রের মধ্যে ছিল—একটি খাট, একটি চাটাই, একটি বিছানা, একটি বালিশ, খোরমা ও খেজুর রাখার দুইটি মটকা, পানির একটি পাত্র এবং পান করার একটি পেয়ালা। এর বেশি কিছু ছিল না। বিভিন্ন হাদীসে একাধিক স্থানে উল্লেখ আছে যে, বাসিন্দাদের রাতের বেলা প্রায়ই বাতি জ্বালানোর সামর্থ্য ছিল না। ‘আয়িশা (রাঃ) বলেনঃ “একাধারে প্রায় চল্লিশ রাত চলত, ঘরে বাতি জ্বলতো না।”
ঘরে সর্বমোট দুইজন মানুষ থাকতেন—রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ও ‘আয়িশা (রাঃ)। কিছুদিন পর ‘বুরায়রা’ (রাঃ) নামের একজন দাস যুক্ত হন। যতদিন ‘আয়িশা ও সাওদা (রাঃ) একমাত্র দুই স্ত্রী ছিলেন, রাসূল (সাঃ) একদিন পর পর ‘আয়িশা (রাঃ)-এর ঘরে রাত কাটাতেন। পরে আরও কয়েকজনকে স্ত্রীর মর্যাদা দেওয়া হলে এবং হযরত সাওদা (রাঃ) স্বেচ্ছায় নিজের বারের দিনটি ‘আয়িশা (রাঃ)-কে দান করলে, প্রতি নয় দিনে দুই দিন তিনি ‘আয়িশা (রাঃ)-এর ঘরে কাটাতেন।
ঘর-গৃহস্থালীর গোছগাছ ও পরিপাটির বিশেষ কোনো প্রয়োজন পড়তো না। খাদ্য, খাবার তৈরি ও রান্নাবান্নার সুযোগ খুব কমই আসতো। হযরত ‘আয়িশা (রাঃ) নিজেই বলতেনঃ “কখনো একাধারে তিন দিন এমন যায়নি যখন নবী পরিবারের লোকেরা পেট ভরে খেয়েছেন।” তিনি আরও বলতেনঃ “মাসের পর মাস ঘরে আগুন জ্বলতো না।” এ সময় খেজুর ও পানির উপরই কাটতো।
খায়বার বিজয়ের পর হযরত রাসূলে কারীম (সাঃ) আযওয়াজে মুতাহারাতের (পবিত্র সহধর্মিণীগণ) প্রত্যেকের জন্য বাৎসরিক ভাতা নির্ধারণ করে দেন। আবদুর রহমান আল-আ’রাজ মদীনায় তাঁর মজলিসে বলতেনঃ “রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ‘আয়িশার (রাঃ) জীবিকার জন্য খায়বারের ফসল থেকে আশি ওয়াসাক খেজুর এবং বিশ ওয়াসাক যব বা গম দিতেন। কিন্তু তাঁর দানশীলতার কারণে এই পরিমাণ খাদ্য সারা বছরের জন্য কখনো যথেষ্ট ছিল না।”
সাহাবায়ে কিরাম (রাঃ) সব সময় নবী পরিবারের প্রতি উপহার ও উপঢৌকন পাঠাতেন। বিশেষ করে যেদিন রাসূল (সাঃ) ‘আয়িশার (রাঃ) ঘরে অবস্থান করতেন, লোকেরা ইচ্ছা করেই সেই দিন বেশি করে হাদিয়া-তোহফা পাঠাতেন।
অনেক সময় এমন হতো যে, রাসূল (সাঃ) বাইরে থেকে এসে জিজ্ঞেস করতেনঃ “আয়িশা! কিছু আছে কি?” তিনি জবাব দিতেনঃ “ইয়া রাসূলাল্লাহ! কিছুই নেই।” তারপর সবাই মিলে রোযা রাখতেন। অনেক সময় কোন কোন আনসার পরিবার দুধ পাঠাতো। তাই তা পান করেই পরিতৃপ্ত থাকতেন। উম্মু সালামা (রাঃ) বলেনঃ “রাসূলুল্লাহর (সাঃ) সময় আমাদের অধিকাংশ দিনের খাবার ছিল দুধ।”
রাসূলুল্লাহর (সাঃ) ঘর-গৃহস্থালীর ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব ছির হযরত বিলালের (রাঃ) উপর ছিল। তিনি সারা বছরের খাদ্যশস্য বণ্টন করতেন। প্রয়োজন পড়লে ধার-কর্জও করতেন।
হযরত আয়িশা সিদ্দীকা (রাঃ) -এর ৮ পর্ব পড়তে ক্লিক করুন
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।