হযরত আয়িশা সিদ্দীকা (রাঃ) -এর ৩ পর্ব পড়তে ক্লিক করুন
হযরত ‘আয়িশা (রাঃ) আপনজনদের সঙ্গে মদীনার বনু হারিস ইবন খাজরাজের মহল্লায় অবতরণ করেন এবং সাত বা আট মাস সেখানে মায়ের সঙ্গে বসবাস করেন। মক্কা থেকে মদীনায় আগত অধিকাংশ মুহাজিরের জন্য মদীনার আবহাওয়া সুবিধাজনক ছিল না। বহু নারী-পুরুষ অসুস্থ হয়ে পড়েন। হযরত আবু বকর (রাঃ) ও ভীষণ জ্বরে আক্রান্ত হন।
অল্প বয়সী হযরত ‘আয়িশা (রাঃ) পিতার সেবায় ব্যস্ত হয়ে পড়েন। একদিন তিনি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকট এসে পিতার অবস্থার কথা জানান, এবং রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আবু বকর (রাঃ)-এর জন্য দু‘আ করেন। এর পর আবু বকর (রাঃ) সুস্থ হয়ে ওঠেন।
পিতাকে সুস্থ করে তোলার পর হযরত ‘আয়িশা (রাঃ) নিজেই শয্যায় নেমে পড়েন। এবার পিতা অসুস্থ মেয়ের প্রতি মনোযোগী হলেন। আবু বকর (রাঃ) অসুস্থ মেয়ের শয্যার কাছে যেতেন এবং অত্যন্ত দরদসহ তাঁর মুখে মুখ ঘেঁষতেন। অসুস্থতা এত মারাত্মক ছিল যে, হযরত ‘আয়িশা (রাঃ)-এর মাথার প্রায় সব চুল পড়ে যায়।
বিপদ থেকে মুক্ত হওয়ার পর হযরত আবু বকর (রাঃ) বা উম্মু রূমান (রাঃ) একদিন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে বললেনঃ
“ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনার স্ত্রীকে ঘরে তুলে নিচ্ছেন না কেন?”
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) উত্তর দিলেনঃ
“এমন সময় আমার হাতে মাহর আদায় করার মত অর্থ নেই।”
হযরত আবু বকর (রাঃ) বললেনঃ
“আমার অর্থ গ্রহণ করুন। আমি ধার দিচ্ছি।”
এর পর রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বারো উকিয়া ও এক নশ (পাঁচশো দিরহাম) হযরত আবু বকর (রাঃ)-এর নিকট থেকে ধার নিয়ে হযরত ‘আয়িশা (রাঃ)-এর কাছে পাঠিয়ে দেন।
মদীনা তখন যেন হযরত ‘আয়িশা (রাঃ)-এর শ্বশুর বাড়ী হয়ে উঠেছিল। আনসারী মহিলারা নববধূকে বরণ করার জন্য হযরত আবু বকর (রাঃ)-এর গৃহে এলেন। হযরত ‘আয়িশা (রাঃ) তখন বাড়ীর আঙ্গিনায় খেজুর গাছে রতলায় অন্য মেয়েদের সঙ্গে খেলছিলেন। মা উম্মু রূমান (রাঃ) ডাক দিলেন। মায়ের ডাক শোনার সঙ্গে সঙ্গে নববধূ হাঁফাতে হাঁফাতে ছুটে এসে সেই কক্ষে প্রবেশ করলেন, যেখানে অতিথি মহিলারা তাঁর অপেক্ষায় বসে ছিলেন।
কক্ষে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে মহিলারা বললেনঃ
“তোমার আগমন শুভ ও কল্যাণময় হোক।”
এরপর তারা নববধূকে সাজালেন। কিছুক্ষণ পর রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) উপস্থিত হলেন।
এক পেয়ারা দুধ ছাড়া সেই সময় রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সামনে আর কিছুই উপস্থাপন করা হয়নি।
আসমা বিনতে ইয়াযীদ, হযরত ‘আয়িশা (রাঃ)-এর একজন খেলার সাথী, বলেনঃ
“আমি ছিলাম হযরত ‘আয়িশা (রাঃ)-এর বান্ধবী। আমি তাকে সাজিয়ে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকট উপস্থাপন করেছিলাম। আমার সঙ্গে অন্যরাও ছিলেন। আমরা এক পেয়ারা দুধ ছাড়া তখন কিছুই পাইনি।”
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পেয়ারা থেকে সামান্য দুধ মুখে দিয়ে হযরত ‘আয়িশা (রাঃ)-এর দিকে এগিয়ে দেন। হযরত ‘আয়িশা (রাঃ) লজ্জা বোধ করায় আমি তাকে বললামঃ
“রাসূলুল্লাহর দান ফিরিয়ে দিও না।”
তখন হযরত ‘আয়িশা (রাঃ) অত্যন্ত লাজুক অবস্থায় গ্রহণ করেন এবং সামান্য পান করে রেখে দেন। এরপর রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাকে বললেনঃ
“তোমার সাথীদের দাও।”
আমরা বললামঃ
“ইয়া রাসূলাল্লাহ! এই সময় আমাদের পান করার ইচ্ছা নেই।”
তিনি উত্তর দিলেনঃ
“মিথ্যা বলবে না। মানুষের প্রতিটি মিথ্যা লেখা হয়।”
অপর একটি বর্ণনায় এসেছে, ক্ষুধা ও মিথ্যা একত্র করো না। মিথ্যা লেখা হয়; এমনকি ছোট ছোট মিথ্যাও।
সহীহ বর্ণনাসমূহের ভিত্তিতে জানা যায় যে, হযরত ‘আয়িশা (রাঃ) স্বামীগৃহে প্রথম হিজরীর শাওয়াল মাসে গমন করেন। আল্লামা ‘আয়নী লিখেছেন, হিজরী দ্বিতীয় সনে বদর যুদ্ধের পর তিনি স্বামীগৃহে গিয়েছিলেন।
কিছু বর্ণনায় বলা হয় যে, হযরত ‘আয়িশা (রাঃ)-কে হিজরাতের তিন বছর পূর্বে বিয়ে করা হয় এবং হিজরাতের আঠারো মাসের শাওয়াল মাসে তিনি স্বামীগৃহে যান। বিয়ের সময় তার বয়স ছয় বছর এবং বাসরের সময় নয় বছর। কিন্তু এই বর্ণনা সঠিক নয়, কারণ এই অনুযায়ী হযরত ‘আয়িশা (রাঃ)-এর বয়স দশ বছর হবে। সব হাদীস ও ইতিহাসের গ্রন্থ এ বিষয়ে একমত যে, স্বামীগৃহে প্রবেশের সময় হযরত ‘আয়িশা (রাঃ)-এর বয়স নয় বছর ছিল।
হযরত ‘আয়িশা (রাঃ)-এর বিয়ে ও স্বামীগৃহে গমন উভয়ই শাওয়াল মাসে সম্পন্ন হয়। এ কারণে তিনি আজীবন এ ধরনের অনুষ্ঠান শাওয়াল মাসে করতে পছন্দ করতেন। তিনি বলতেনঃ
“আমার বিয়ে ও স্বামীগৃহে গমন—দুটোই শাওয়ালে। আর এ কারণে স্বামীর নিকট আমি চেয়ে অধিক ভাগ্যবতী আর কে ছিল?”
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মসজিদে নববীর পাশে নির্মিত ছোট্ট একটি ঘরে হযরত ‘আয়িশা (রাঃ)-কে এনে উঠান। আজ যেখানে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) শুয়ে আছেন, সেটিই হযরত ‘আয়িশা (রাঃ)-এর ঘর। পরবর্তীকালে হযরত ‘আয়িশা (রাঃ) বলতেনঃ
“এখন আমি যে ঘরে আছি, আমার এই ঘরে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাকে প্রথম এনে উঠান। এখানেই তিনি ওফাত পেয়েছেন।”
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ঘরের দরজা সরাসরি মসজিদের একটি দরজা বানিয়ে দেন। পূর্বের বর্ণনাসমূহ থেকে প্রত্যেকেই বুঝতে পারে, হযরত ‘আয়িশা (রাঃ)-এর বিয়ে, স্বামীগৃহে গমন এবং প্রতিটি অনুষ্ঠান কত আড়ম্বরহীন ও সাদামাটা ছিল। এতে অতিরঞ্জিত প্রদর্শনী বা বাহুল্য ভাবের কিছু ছিল না।
হযরত ‘আয়িশা (রাঃ)-এর বিয়ের মাধ্যমে তৎকালীন আরবের বহু কুপ্রথা ও কূসংস্কার বিলোপিত হলো। তখন মানুষ সব ধরনের ভাই সম্পর্কের মেয়েকে বিয়ে করা বৈধ মনে করতো না, এমনকি মুখে বরা ভাইকেও।
এই কারণে খাওলা (রাঃ)-এর প্রস্তাব শুনে হযরত আবু বকর (রাঃ) বললেনঃ
“এটি কি বৈধ? হযরত ‘আয়িশা তো রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ভাতিজী।”
যথাশীঘ্রই এই কথা রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কানে পৌঁছালে তিনি বললেনঃ
“আবু বকর আমার ইসলামী ভাই। তার মেয়ের সঙ্গে আমার বিয়ে বৈধ।”
আর একটি কুপ্রথা ছিল, শাওয়াল মাসে তারা বিয়ে-শাদি করত না। অতীতে কোনো এক শাওয়াল মাসে আরবে প্লেগ দেখা দিয়েছিল। এ কারণে তারা এই মাসটিকে অশুভ বলে বিশ্বাস করতো এবং এ মাসে বিয়ের অনুষ্ঠান আয়োজন করতো না।
তৎকালীন আরবের কিছু লোকের আরও একটি বিশ্বাস ছিল যে, এই মাসে নববধূকে ঘরে আনলে তাদের সম্পর্ক টেনে না। ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়—এমন ভুল ধারণার ভিত্তিতে হযরত ‘আয়িশা (রাঃ)-এর বিয়ে প্রচলিত কুপ্রথাকে চূড়ান্তভাবে ভেঙে দিল। নববধূকে ঘরে আনার অনুষ্ঠানটি দিনের বেলায় অনুষ্ঠিত হলো। এটি ছিল প্রচলিত বিশ্বাস ও প্রথার বিপরীত।
আরেকটি কুপ্রথা ছিল, দুলহানকে আগে আগে তারা আগুন জ্বালাত। নবদম্পতির প্রথম দৃষ্টি বিনিময় হতো কোনো মঞ্চে বা অভ্যন্তরে।
এই সকল কুপ্রথার মূল উৎপাত হযরত ‘আয়িশা (রাঃ)-এর বিয়ের মাধ্যমে বিলোপিত হলো।
হযরত আয়িশা সিদ্দীকা (রাঃ) -এর ৫ পর্ব পড়তে ক্লিক করুন
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।
 
					