হযরত আয়িশা সিদ্দীকা (রাঃ) -এর ৩য় পর্ব

হযরত আয়িশা সিদ্দীকা (রাঃ) -এর ২ পর্ব পড়তে ক্লিক করুন

হযরত ‘আয়িশা (রাঃ)-কে বিয়ে করার পূর্বেই রাসূলে কারীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর সম্পর্কে সুসংবাদ লাভ করেছিলেন। একদিন তিনি স্বপ্নে দেখেন—এক ব্যক্তি একটি জিনিস এক টুকরো রেশমে জড়িয়ে এনে তাঁকে দেখিয়ে বলছে, “এটি আপনার।” তিনি খুলে দেখেন, তার মধ্যে রয়েছেন হযরত ‘আয়িশা (রাঃ)।

হযরত ‘আয়িশা (রাঃ) নিজে বলেনঃ

“রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাকে বলেছেন—তিন রাত আমি তোমাকে স্বপ্নে দেখেছি। একজন ফেরেশতা রেশমের একটি টুকরোয় কিছু মুড়ে এনে বললো, ‘এ আপনার স্ত্রী।’ আমি মাথার দিক থেকে খুলে দেখলাম, তার মধ্যে তুমি। তখন আমি বললাম, ‘এ যদি আল্লাহর পক্ষ থেকে হয়ে থাকে, তবে তা অবশ্যই বাস্তব হবে।’”

ইমাম তিরমিযীও বর্ণনা করেছেন—হযরত ‘আয়িশা (রাঃ) বলেনঃ

“জিবরীল (আঃ) তাঁর একটি প্রতিকৃতি সবুজ রেশমের টুকরোয় জড়িয়ে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কাছে নিয়ে এসে বলেন, ‘ইনি দুনিয়া ও আখিরাতে আপনার স্ত্রী হবেন।’”

হযরত ‘আয়িশা (রাঃ)-এর বিয়ের সঠিক সময়কাল নিয়ে কিছু মতভেদ রয়েছে। আল্লামা বদরুদ্দীন ‘আয়নী সহীহ আল-বুখারীর ব্যাখ্যায় লিখেছেনঃ

“‘আয়িশা (রাঃ)-এর বিয়ে হিজরতের দুই বছর পূর্বে হয়েছিল—এ মতই সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য। আবার কেউ কেউ বলেছেন তিন বছর পূর্বে, আবার কেউ বলেছেন দেড় বছর পূর্বে।”

কিছু বর্ণনায় উল্লেখ আছে যে, হযরত খাদীজা (রাঃ)-এর ইন্তিকালের তিন বছর পর রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হযরত ‘আয়িশা (রাঃ)-কে বিয়ে করেন। অন্য কিছু সীরাত বিশেষজ্ঞের মতে, যে বছরে খাদীজা (রাঃ)-এর ইন্তিকাল হয়, সেই বছরই ‘আয়িশা (রাঃ)-এর বিয়েও সম্পন্ন হয়।

সাইয়্যেদ সুলায়মান নাদবী বলেনঃ হযরত খাদীজা (রাঃ)-এর ওফাতের তারিখের ভিত্তিতে হযরত ‘আয়িশা (রাঃ)-এর বিয়ের সঠিক তারিখ নির্ধারণ করা সম্ভব। তবে খাদীজা (রাঃ)-এর ওফাতের তারিখও সর্বসম্মত নয়—এখানেও মতভেদ দেখা যায়। এই ক্ষেত্রে হযরত ‘আয়িশা (রাঃ)-এর বর্ণনা গ্রহণযোগ্য হতে পারতো। কিন্তু সহীহ বুখারী ও মুসনাদে তাঁর থেকে ভিন্ন দুইটি বর্ণনা পাওয়া যায়।

একটি বর্ণনায় এসেছে যে, খাদীজা (রাঃ)-এর ওফাতের তিন বছর পর হযরত ‘আয়িশা (রাঃ)-এর বিয়ে সম্পন্ন হয়। অপর বর্ণনায় বলা হয়েছে, খাদীজা (রাঃ)-এর ওফাতের বছরেই বিয়ের ঘটনা ঘটেছিল।

অধিকাংশ গবেষকের সিদ্ধান্ত এবং নির্ভরযোগ্য বর্ণনাসমূহের গরিষ্ঠ অংশ যা সমর্থন করে তা হলো—হযরত খাদীজা (রাঃ) নুবুওয়াতের দশম বছরে, হিজরাতের তিন বছর পূর্বে রমযান মাসে ইন্তিকাল করেন। আর তার এক মাস পরে, শাওয়াল মাসে, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হযরত ‘আয়িশা (রাঃ)-কে বিয়ে করেন। তখন হযরত ‘আয়িশা (রাঃ)-এর বয়স ছিল ছয় বছর।

এই হিসেবে হিজরাতের পূর্ব তিন সনের শাওয়াল মাসে, মুতাবিক ৬২০ খ্রিস্টাব্দের মে মাসে হযরত ‘আয়িশা (রাঃ)-এর বিয়ে সম্পন্ন হয়। আল-ইসতীয়ার গ্রন্থাগারে ইবন আবিদল-বার এই মত সমর্থন করেছেন। মূলত বিয়ে হয়েছিল খাদীজা (রাঃ)-এর ওফাতের বছরেই, কিন্তু স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয় তিন বছর পরে—যখন নয় বছর বয়সে হযরত ‘আয়িশা (রাঃ)-কে ঘরে তোলা হয়।

হযরত ‘আয়িশা (রাঃ)-এর একটি বর্ণনা, যা ইবন সা‘দ নকল করেছেন, এ বিষয়টি স্পষ্টভাবে ফুটিয়ে তোলে।

বিয়ের পর হযরত ‘আয়িশা (রাঃ) প্রায় তিন বছর পিতৃগৃহে অবস্থান করেন—দুই বছর তিন মাস মক্কায় এবং সাত বা আট মাস হিজরাতের পর মদীনায়।

মক্কায় পৌত্তলিকদের অত্যাচার ও নির্যাতনের মাত্রা যখন সহ্যের সীমা অতিক্রম করল, তখন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মদীনায় হিজরাতের সিদ্ধান্ত নিলেন।

হযরত ‘আয়িশা (রাঃ) বলেনঃ

“রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) প্রতিদিন সকাল ও সন্ধ্যায় আবু বকরের (রাঃ) গৃহে আসতেন। একদিন অভ্যাসের বিপরীতে চাদর দিয়ে মাথা-মুখ ঢেকে দপ্তরে উপস্থিত হলেন। তখন আবু বকরের (রাঃ) কাছে বসেছিল তাঁর দুই কন্যা—‘আয়িশা (রাঃ) ও আসমা (রাঃ)।”

রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেনঃ

“আবু বকর! আপনার কাছে বসা লোকগুলিকে একটু সরিয়ে দিন, আমি কথা বলতে চাই।”

আবু বকর (রাঃ) উত্তর দিলেনঃ

“ইয়া রাসূলাল্লাহ! এখানে অন্য কেউ নেই। আপনি তো আপনারই ঘরের লোক।”

এরপর রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হিজরাতের সিদ্ধান্তের কথা প্রকাশ করলেন।

হযরত ‘আয়িশা (রাঃ) ও আসমা (রাঃ) দুই বোন মিলে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র গোছগাছ করলেন। তারপর দুই বোন মদীনার পথ ধরলেন, এবং তাদের পরিবার-পরিজনকে মক্কায় পৌত্তলিকদের হাতে ছেড়ে এলেন।

মদীনায় কিছুটা স্থির হওয়ার পর, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মক্কা থেকে পরিবার-পরিজনকে মদীনায় নেওয়ার জন্য জায়িদ ইবন হারিসা (রাঃ) ও আবু রাফেহ (রাঃ)-কে মক্কায় পাঠালেন। তাঁদের দুইটি উট এবং পাঁচশো দিরহাম প্রদান করা হয়েছিল—যা আবু বকর (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে প্রয়োজন পূরণের জন্য দিয়েছেন।

আবু বকর (রাঃ)ও তাঁদের সাথে আবদুল্লাহকে পাঠালেন, নির্দেশ দিয়ে যে, সে যেন হযরত ‘আয়িশা (রাঃ), আসমা (রাঃ) এবং তাঁদের মা উম্মু রূমানকে মদীনায় নিয়ে আসে।

এই সকল লোক যখন মক্কা থেকে যাত্রা শুরু করেন, তখন তালহা ইবন ‘আবদুল্লাহ হিজরাতের উদ্দেশ্যে তাঁদের সহযাত্রী হন। আবু রাফে’ ও জায়িদ ইবন হারিসার সঙ্গে ফাতিমা, উম্ম কুলসুম, সাওদা বিনতে যাম‘আ, উম্ম আয়মান, উসামা ইবন জায়িদ এবং ‘আবদুল্লাহ ইবন আবি বকরের (রাঃ) সঙ্গে উম্মু রূমান, ‘আবদুল্লাহর দুই বোন—‘আয়িশা ও আসমা ছিলেন।

এই কাফেলা মক্কা থেকে যাত্রা শুরু করে, এবং হিজাযের বনু কিনানর আবাসস্থল আল-বায়দ‘-এ পৌঁছালে হযরত ‘আয়িশা (রাঃ) ও তাঁর মা উম্মু রূমান (রাঃ) যে উটের আরোহী ছিলেন, সেটি হঠাৎ দ্রুত গতিতে ছুটে পালালো। প্রতি মুহূর্তে তাঁরা আশঙ্কা করতেন যে, এই বুঝি উটটি ছিটকে গিয়ে কোন দুর্ঘটনা ঘটাবে।

মেয়েদের মতোই স্বাভাবিকভাবে, মা উম্মু রূমান নিজের জানের প্রতি সচেতন ছিলেন না, কিন্তু হযরত ‘আয়িশা (রাঃ) অস্থির হয়ে কান্না শুরু করলেন। অনেক দূর যাওয়ার পর উটটি ধরে বশে আনা হয়। সবই নিরাপদে শেষ হয়, এবং কাফেলা নিরাপদে মদীনায় পৌঁছে।

হযরত রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তখন মসজিদে নববী ও তার আশেপাশে ঘরবাড়ী নির্মাণ করছিলেন। সেই নির্মাণকাজের একটি ঘরে হযরত সাওদা (রাঃ) এবং রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কন্যাদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়।

হযরত আয়িশা সিদ্দীকা (রাঃ) -এর ৪ পর্ব পড়তে ক্লিক করুন

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

সম্পর্কিত পোস্ট

দুঃখিত!