হযরত আয়িশা সিদ্দীকা (রাঃ) -এর ১ পর্ব পড়তে ক্লিক করুন
এই ঘটনাটি দ্বারা আয়িশা (রাঃ)-এর স্বভাবজাত উপস্থিত বুদ্ধিমত্তা, ইতিহাস-ঐতিহ্যের জ্ঞান এবং তীক্ষ্ণ মেধার ধারণা পাওয়া যায়।
সাধারণত মানুষের শৈশবের অনেক কথা স্মৃতি থেকে মুছে যায়। কিন্তু আয়িশা (রাঃ)-এর ছোটবেলার প্রায় সব ঘটনাই তাঁর স্মৃতিতে অম্লান ছিল। হযরত রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যখন মক্কা থেকে মদীনায় হিজরাত করেন, তখন আয়িশা (রাঃ)-এর বয়স আট বা নয় বছরের বেশি ছিল না। তবুও হিজরাতের ঘটনার যেসব বিস্তারিত বর্ণনা তিনি দিয়েছেন, তা আর কোনো সাহাবী দিতে পারেননি।
ইমাম বুখারী সূরা আল-কামার-এর তাফসিরে বর্ণনা করেছেন—
আয়িশা (রাঃ) বলেনঃ
“যখন এই আয়াত
اقْتَرَبَتِ السَّاعَةُ وَانشَقَّ الْقَمَرُ
(অর্থঃ ‘কিয়ামত আসন্ন, আর চন্দ্র ফেটে গেছে’)
মক্কায় নাযিল হয়, তখন আমি ছোট মেয়ে ছিলাম—খেলছিলাম।”
শৈশবে আয়িশা (রাঃ) মাঝে মাঝে দুষ্টুমি করতেন, আর তাঁর মা উম্মু রূমান (রাঃ) তাঁকে শাসন করতেন। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এতে কষ্ট অনুভব করতেন। একবার তিনি উম্মু রূমানকে বললেনঃ
“আমার খাতিরে তাকে আর শাস্তি দিও না।”
একবার রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আয়িশা (রাঃ)-এর পিতৃগৃহে এসে দেখেন—তিনি দরজার চৌকাঠে হেলান দিয়ে কাঁদছেন। তখন তিনি উম্মু রূমানকে বললেনঃ
“আপনি আমার কথার গুরুত্ব দেননি।”
উম্মু রূমান (রাঃ) বললেনঃ
“ইয়া রাসূলাল্লাহ, এই মেয়ে আমার বিরুদ্ধে তার বাবার কাছে অভিযোগ করে!”
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেনঃ
“সে যা-ই করুক না কেন, তাকে কষ্ট দিও না।”
আল্লামা সাইয়্যিদ সুলাইমান নাদবী মুস্তাদরাকুল হাকিম গ্রন্থের বরাতে এ ঘটনাটি উল্লেখ করেছেন।
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর প্রথমা স্ত্রী ছিলেন হযরত খাদীজা বিনতে খুয়াইলিদ (রাঃ)। তাঁকে বিয়ে করার সময় রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর বয়স ছিল পঁচিশ বছর এবং খাদীজা (রাঃ)-এর বয়স ছিল চল্লিশ বছর।
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) খাদীজা (রাঃ)-এর সঙ্গে পঁচিশ বছর সুখে-শান্তিতে সংসার করেন। নুবুওয়াতের দশম সনের রমযান মাসে, অর্থাৎ হিজরতের তিন বছর পূর্বে, খাদীজা (রাঃ) ইন্তিকাল করেন। তখন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর বয়স ছিল পঞ্চাশ বছর এবং খাদীজা (রাঃ)-এর বয়স ছিল পঁয়ষট্টি।
সাওদা (রাঃ)-এর জীবনীতে উল্লেখ করা হয়েছে—খাদীজা (রাঃ)-এর ইন্তিকালের পর রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে অত্যন্ত বিমর্ষ ও একাকী দেখে উসমান ইবন মাজঊনের স্ত্রী খাওলা বিনতে হাকীম (রাঃ) বললেনঃ
“ইয়া রাসূলাল্লাহ, আপনি বিয়ে করে নিন।”
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জিজ্ঞেস করলেনঃ
“কাকে বিয়ে করব?”
খাওলা (রাঃ) উত্তর দিলেনঃ
“দুই ধরনের পাত্রী আছে—একজন বিধবা এবং একজন কুমারী। আপনি যাকে উপযুক্ত মনে করেন, তাঁর বিষয়ে আমি কথা বলতে পারি।”
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জানতে চাইলেনঃ
“তারা কারা?”
খাওলা (রাঃ) বললেনঃ
“বিধবা হলেন সাওদা বিনতে যামআ (রাঃ), আর কুমারী হলেন আবু বকর (রাঃ)-এর কন্যা আয়িশা (রাঃ)।”
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেনঃ
“ভালো, তুমি তাদের বিষয়ে কথা বলো।”
হযরত খাওলা (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সম্মতি পাওয়ার পর প্রথমে হযরত আবু বকর (রাঃ)-এর বাড়িতে গিয়ে প্রস্তাব দেন।
তখনকার জাহেলি আরব সমাজে একটি রীতি প্রচলিত ছিল—তারা আপন ভাইয়ের সন্তানদের যেমন বিয়ে করত না, তেমনি সৎ ভাই, জ্ঞাতি ভাই বা দুধ-ভাইয়ের সন্তানদের সঙ্গেও বিবাহকে বৈধ মনে করত না।
এই কারণে প্রস্তাবটি শুনে হযরত আবু বকর (রাঃ) বললেনঃ
“খাওলা! আয়িশা তো রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ভাতিজি। তাঁর সঙ্গে বিয়ে কিভাবে সম্ভব?”
খাওলা (রাঃ) ফিরে এসে বিষয়টি রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কাছে উপস্থাপন করেন। তখন তিনি বলেনঃ
“আবু বকর আমার দীনী ভাই। আর এ ধরনের ভাইদের সন্তানদের সঙ্গে বিবাহ করা বৈধ।”
এ কথা শোনার পর আবু বকর (রাঃ) প্রস্তাবে সম্মতি দেন এবং খাওলা (রাঃ)-কে বলেন,
“আপনি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে নিয়ে আসুন।”
এর আগে হযরত আয়িশা (রাঃ)-এর বিয়ের প্রস্তাব জুবাইর ইবন মুতইম ইবন আদীর পরিবারের কাছ থেকেও এসেছিল। তাই হযরত আবু বকর (রাঃ) মনে করলেন, তাদের মতামত জানা প্রয়োজন।
তিনি মুতইম ইবন আদীর কাছে গিয়ে বললেনঃ
“তুমি তোমার ছেলের সঙ্গে আমার কন্যা আয়িশার বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলে। এখন তোমাদের সিদ্ধান্ত কী?”
মুতইম (যিনি তখনও ইসলাম গ্রহণ করেননি) তাঁর স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলেন। তাঁর স্ত্রী বললেনঃ
“যদি আবু বকর তাঁর মেয়েকে তোমার ছেলের সঙ্গে বিয়ে দেন, তাহলে আমাদের ছেলে ইসলাম গ্রহণ করবে—এমন আশঙ্কা আছে।”
তখন মুতইম বললেনঃ
“আমার স্ত্রীর মতের সঙ্গেই আমার মত এক।”
এ কথা শুনে হযরত আবু বকর (রাঃ) প্রস্তাবটি থেকে সরে আসেন এবং ফিরে গিয়ে খাওলা (রাঃ)-কে বলেনঃ
“এখন আপনি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে নিয়ে আসুন।”
এরপর রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আবু বকরের (রাঃ) গৃহে আসেন, এবং তিনিই হযরত আয়িশা (রাঃ)-এর সঙ্গে তাঁর বিয়ের ব্যবস্থা সম্পন্ন করেন।
ইতিহাসবিদ আল-বালাজুরী অবশ্য উল্লেখ করেছেন যে, আয়িশা (রাঃ)-এর অন্য কারো সঙ্গে বিয়ের প্রস্তাবের কথা সঠিক নয়।
হযরত ‘আয়িশা (রাঃ) ও সাওদা (রাঃ)-এর বিয়ে একই সময়ে সম্পন্ন হয়। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাওদা (রাঃ)-কে বিয়ের পরই ঘরে তোলেন এবং কেবল তাঁর সঙ্গেই প্রায় তিন বছর সংসার করার পর হযরত ‘আয়িশা (রাঃ)-কে গৃহে নিয়ে আসেন।
এই বিয়ে ছিল অত্যন্ত সাদামাটা ও অনাড়ম্বরভাবে সম্পন্ন। হযরত ‘আতিয়া (রাঃ) এই বিয়ের বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে—
“‘আয়িশা (রাঃ) অন্যান্য মেয়েদের সঙ্গে খেলছিলেন। এমন সময় তাঁর সেবিকা এসে তাঁকে নিয়ে যান, এবং হযরত আবু বকর (রাঃ) এসে বিয়ে পড়িয়ে দেন।’”
এই বিয়ে কত সরল ও অনুষ্ঠানহীনভাবে সম্পন্ন হয়েছিল, তা অনুমান করা যায় খোদ হযরত ‘আয়িশা (রাঃ)-এর একটি বর্ণনা থেকে। তিনি বলেনঃ
“যখন আমার বিয়ে হয়, আমি কিছুই জানতাম না। বিয়ে সম্পন্ন হওয়ার পর মা আমাকে সবকিছু বুঝিয়ে দেন।”
‘আয়িশা (রাঃ) আরও বলেনঃ
“বিয়ের সময় আমি ছিলাম এক ছোট্ট মেয়ে। ‘হাওফ’ নামের এক প্রকার পোশাক পরেছিলাম। বিয়ের পর ছোট্ট হওয়া সত্ত্বেও আমার মধ্যে লজ্জা এসে যায়।”
উল্লেখ্য, ‘হাওফ’ ছিল চামড়ার তৈরি এক ধরনের পোশাক, যা শিশুদের কোমর থেকে হাঁটু পর্যন্ত পরানো হতো।
হযরত ‘আয়িশা (রাঃ)-এর মাহর (বিবাহ-দান) কত ছিল, এ বিষয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। ইবন সা‘দ (রহঃ)-এর বর্ণনা অনুযায়ী, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁকে মাহর হিসেবে একটি ঘর দান করেন, যার মূল্য ছিল পঞ্চাশ দিরহাম।
ইবন ইসহাক (রহঃ) বর্ণনা করেছেন যে, মাহর ছিল চারশো দিরহাম। আবার ইবন সা‘দের অন্য একটি বর্ণনায় এসেছে, যা স্বয়ং ‘আয়িশা (রাঃ)-এর কাছ থেকে বর্ণিত। তিনি বলেনঃ
“আমার মাহর ছিল বারো উকিয়া ও এক নশ—যা পাঁচশো দিরহামের সমান।”
সহীহ মুসলিমেও বর্ণিত হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর স্ত্রীগণের মাহর সাধারণত পাঁচশো দিরহাম হতো। মুসনাদে আহমাদেও হযরত ‘আয়িশা (রাঃ)-এর বর্ণনায় এসেছে, তাঁর মাহর ছিল পাঁচশো দিরহাম।
হযরত আয়িশা সিদ্দীকা (রাঃ) -এর ৩য় পর্ব পড়তে ক্লিক করুন
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।