হযরত আয়িশা সিদ্দীকা (রাঃ) -এর ১৯ পর্ব

হযরত আয়িশা সিদ্দীকা (রাঃ) -এর ১৮ পর্ব পড়তে ক্লিক করুন

স্বামীর ইনতিকাল

হযরত আয়েশা (রাঃ)-এর বয়স যখন আঠারো বছর, তখন স্বামী রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ইনতিকাল করেন। হিজরী ১১ সনের সফর মাসের পূর্বে একদিন রাসূল (সাঃ) আয়েশা (রাঃ)-এর ঘরে এসে দেখলেন, তিনি মাথার যন্ত্রণায় আহ উহ করছেন। রাসূল (সাঃ) তাঁর এ অবস্থা দেখে বললেনঃ
“তুমি যদি আমার সামনে মারা যাও, আমি তোমাকে নিজ হাতে গোসল দিয়ে কাফন-দাফন করতাম।”

হযরত আয়েশা (রাঃ) সাথে সাথে প্রতিক্রিয়া জানালেন এইভাবেঃ
“ইয়া রাসূলুল্লাহ! আপনি তো একথা বলছেন এ জন্য যে, যাতে এই ঘরে অন্য একজন স্ত্রীকে এনে উঠাতে পারেন।”

একথা শুনে রাসূল (সাঃ) নিজের মাথায় হাত রেখে বললেনঃ
“হায়, আমার মাথা!”
মূলত তখন থেকেই রাসূলুল্লাহর (সাঃ) মাথায় যন্ত্রণা শুরু হয়। এরপর তিনি হযরত মায়মূনার (রাঃ) ঘরে গিয়ে শয্যাশয়ী হয়ে পড়েন। এ অবস্থায়ও তিনি নির্ধারিত দিনে নির্দিষ্ট স্ত্রীর ঘরে রাত কাটাতেন। কিন্তু প্রত্যেক দিনই জানতে চাইতেন, আগামীকাল তিনি কোথায় থাকবেন। স্ত্রীগণ বুঝতে পারলেন, তিনি আয়েশা (রাঃ)-এর কাছেই থাকতে চাচ্ছেন। তাই তাঁরা সবাই অনুমতি দিলেন। সেই দিন থেকে পার্থিব জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি আয়েশা (রাঃ)-এর ঘরে অবস্থান করেন।

এখন কারো মনে এ প্রশ্ন দেখা দিতে পারে যে, হযরত রাসূলুল্লাহ (সাঃ) আয়েশা (রাঃ)-এর কাছে যাওয়ার জন্য এত ব্যাকুল ছিলেন কেন? তাঁর অতিমাত্রায় ভালোবাসার কারণে কি?

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তা নয়। মূলত আল্লাহ আয়েশাকে (রাঃ) যে পরিমাণ বুদ্ধি, মেধা, স্মরণশক্তি, স্বভাবগত পূর্ণতা এবং চিন্তাশক্তি দান করেছিলেন, তা কোন স্ত্রীর মধ্যে ছিল না। সুতরাং এমন ধারণা অমূলক নয় যে, রাসূলুল্লাহর (সাঃ) উদ্দেশ্য ছিল, তাঁর জীবনের শেষ দিনগুলির যাবতীয় কথা, কাজ ও আচরণ যেন পূর্ণরূপে সংরক্ষিত থাকে। বাস্তবে তাই হয়েছে। রাসূলুল্লাহর (সাঃ) ওফাতে সংক্রান্ত অধিকাংশ সহীহ বর্ণনা আয়েশা (রাঃ)-এর মাধ্যমে বিশ্ববাসীর কাছে পৌঁছেছে।

রাসূলুল্লাহর (সাঃ) রোগের তীব্রতা প্রতিদিনই বৃদ্ধি পাচ্ছিল। এক পর্যায়ে তিনি ইমামতির জন্য মসজিদে যেতে অক্ষম হয়ে পড়েন। সহধর্মিণীগণ সেবায় নিয়োজিত ছিলেন। রাসূলুল্লাহর (সাঃ) নিকট থেকে শেখা কিছু দু’আ পড়ে তাঁরা ফুঁক দিচ্ছিলেন। হযরত আয়েশা (রাঃ)ও কিছু দু’আ পড়ে ফুঁক দিয়েছিলেন।

ফজরের নামাজে সমবেত মুসল্লীরা রাসূলুল্লাহর (সাঃ) অপেক্ষায় বসে ছিলেন। তিনি কয়েকবার ওঠার চেষ্টা করতেই অচেতন হয়ে পড়ছিলেন। অবশেষে তিনি আবু বকরকে (রাঃ) ইমামতি করার নির্দেশ দিলেন।

আয়েশা (রাঃ) বলেন, “আমার ধারণা হলো, রাসূলুল্লাহর (সাঃ) স্থলে যিনি দাঁবাবেন, মানুষ তাঁকে অপাংক্তেয় ও অশুভ মনে করবে। এজন্য আমি বললামঃ ইয়া রাসূলুল্লাহ (সাঃ), আবু বকর একজন নরম মানুষ। মানুষের কাছে এ কাজ হবে কঠিন। তিনি কেঁদে ফেলবেন। অন্য কাউকে নির্দেশ দিন।”

কিন্তু দ্বিতীয়বারও একই নির্দেশ দিলেন। তখন আয়েশা (রাঃ) হাফসাকে (রাঃ) অনুরোধ করে কথাটি আবার রাসূলুল্লাহর (সাঃ) কাছে বললেন। রাসূলুল্লাহর (সাঃ) মন্তব্য ছিলঃ
“তোমরা সবাই ইউসুফের সঙ্গিনীর মত। বলে দাও, আবু বকর ইমামতি করবেন।”

রাসূলুল্লাহর (সাঃ) অসুস্থ হয়ে পড়ার পূর্বে কিছু নগদ অর্থ আয়েশা (রাঃ)-এর নিকট রেখে খরচ করতে ভুলে গিয়েছিলেন। এখন এই প্রবল রোগের মধ্যে সেই কথা স্মরণ হলো। তিনি আয়েশাকে (রাঃ) বললেনঃ
“সেই দিরহামগুলি কোথায়? ওগুলো আল্লাহর রাস্তায় খরচ করে ফেল। মুহাম্মাদ কি বিরূপ ধারণা নিয়ে আল্লাহর সঙ্গে মিলিত হবেন?”

এরপর সেই অর্থ দরিদ্র লোকদের মধ্যে বিলিয়ে দেওয়া হলো।

এখন রাসূলুল্লাহর (সাঃ) শেষ সময়। আয়েশা (রাঃ) রাসূলুল্লাহর (সাঃ)-এর মাথার কাছে বসেছিলেন এবং তিনি নিজের সিনার সাথে ঠেস দিয়ে বসে ছিলেন। আয়েশা (রাঃ) রাসূলুল্লাহর (সাঃ) সুস্থতার জন্য দু’আ করে চলেছিলেন। রাসূলুল্লাহর (সাঃ)-এর হাত তাঁর হাতের মধ্যেই ছিল। হঠাৎ তিনি টান দিয়ে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বললেনঃ

“اللهم وارفق بالأعلى” (আল্লাহুমা ওয়ার রাফীকিল আ’লা)

অর্থাৎ, “হে আল্লাহ! আমি সর্বশ্রেষ্ঠ বন্ধুর কাছে পৌঁছছি।”

আয়েশা (রাঃ) বলেনঃ সুস্থ অবস্থায় তিনি বলতেন, প্রত্যেক নবীর মরণকালে দুনিয়া ও আখিরাতের জীবনের যে কোন একটি বেছে নেওয়ার ইখতিয়ার দেওয়া হয়। রাসূলুল্লাহর (সাঃ) এই শব্দগুলি উচ্চারণের পর আমি বুঝলাম যে, তিনি আমাদের থেকে দূরে থাকতেই কবুল করেছেন। আমি আরজ করলামঃ
“ইয়া রাসূলাল্লাহ (সাঃ)! আপনার তো বড় কষ্ট হচ্ছে।”
বললেনঃ “কষ্ট অনুপাতে প্রতিদানও আছে।”

আয়েশা (রাঃ) হযরত রাসূলে কারীমকে (সাঃ) সামলে নিয়ে বসে ছিলেন। হঠাৎ তাঁর দেহের ভার অনুভব করলেন। চোখের দিকে তাকিয়ে বুঝলেন, তিনি আর নেই। আস্তে করে পবিত্র মাথাটি বালিশের উপর রেখে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন।

হযরত আয়েশা (রাঃ)-এর সবচেয়ে বড় সম্মান ও মর্যাদা হলো, তাঁরই ঘরে, এক পাশে রাসূলে কারীমের (সাঃ) পবিত্র দেহ সমাহিত করা হয়।

একবার হযরত আয়েশা (রাঃ) স্বপ্নে দেখেন, তাঁর ঘরে একের পর এক তিনটি চাঁদ ছুটে এসে পড়ছে। তিনি এই স্বপ্নের কথা পিতা আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ)-কে জানান। যখন রাসূলে কারীমকে (সাঃ) তাঁর ঘরে দাফন করা হলো, তখন আবু বকর (রাঃ) মেয়েকে বললেন, “সেই তিন চাঁদের একটি হলো এই এবং সবচেয়ে ভালোটি।” পরবর্তী ঘটনা প্রমাণ করেছে যে, তাঁর স্বপ্নের দ্বিতীয় ও তৃতীয় চাঁদ ছিলেন আবু বকর (রাঃ) ও উমার (রাঃ)।

হযরত আয়িশা সিদ্দীকা (রাঃ) -এর ২০ পর্ব পড়তে ক্লিক করুন

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

সম্পর্কিত পোস্ট

দুঃখিত!