হযরত আয়িশা সিদ্দীকা (রাঃ) -এর ১৪ পর্ব

হযরত আয়িশা সিদ্দীকা (রাঃ) -এর ১৩ পর্ব পড়তে ক্লিক করুন

সতীন ও তাঁদের সন্তানদের সঙ্গে সম্পর্ক

আমাদের জানা মতে, এ পৃথিবীতে একজন নারীর জন্য সবচেয়ে অসহনীয় বিষয় হলো সতীনের অস্তিত্ব। কিন্তু আয়িশা (রাঃ)-এর একসঙ্গে সতীন ছিলেন একজন থেকে শুরু করে আটজন পর্যন্ত। রাসূলুল্লাহর (সাঃ) মহান সাহচর্যের বরকতে তাঁদের সকলের হৃদয়ের যাবতীয় কলুষতা দূর হয়ে তা স্বচ্ছ ও পবিত্র বন্ধনে পরিণত হয়েছিল।

সতীন ও তাঁদের সন্তান-সন্ততিদের সঙ্গে আয়িশা (রাঃ)-এর জীবনযাপনের যে চিত্র আমরা পাই, তা সমগ্র নারীজাতির জন্য এক অতুলনীয় আদর্শ হয়ে আছে।

খাদিজা (রাঃ) যদিও আয়িশা (রাঃ)-এর সময়ে জীবিত ছিলেন না, তবু রাসূলুল্লাহর (সাঃ) হৃদয়ে তিনি সর্বদা জীবন্ত ছিলেন। নবী করিম (সাঃ) প্রায়ই আয়িশা (রাঃ)-এর কাছে খাদিজা (রাঃ)-এর স্মৃতিচারণ করতেন।

এই প্রসঙ্গে আয়িশা (রাঃ) বলেন—
“আমি যতটা খাদিজাকে (রাঃ) ঈর্ষা করতাম, ততটা অন্য কাউকে করিনি। আর তা এই কারণে যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাঁকে অত্যন্ত বেশি স্মরণ করতেন।”

রাসূলুল্লাহ (সাঃ) খাদিজা (রাঃ)-এর নামে কুরবানী দিতেন, তাঁর বান্ধবীদের কাছে হাদিয়া ও তোহফা পাঠাতেন, এবং ইসলামের প্রারম্ভিক সময়ে খাদিজা (রাঃ)-এর অসামান্য অবদান—যেমন স্বামীকে সান্ত্বনা দেওয়া, ধৈর্যধারণের উপদেশ দেওয়া, যাবতীয় উপকরণ দিয়ে সহায়তা করা—এসব কর্মকাণ্ডের কথা এই উম্মতকে জানিয়েছেন আয়িশা (রাঃ) নিজেই।

আয়িশা (রাঃ)-এর মাধ্যমেই আমরা জেনেছি, আল্লাহ তাআলা খাদিজা (রাঃ)-কে জান্নাতের সুসংবাদ দিয়েছিলেন।
এতেই বোঝা যায়, আয়িশা (রাঃ)-এর হৃদয়ের স্বচ্ছতা, উদারতা ও প্রশস্ততা কত গভীর ছিল।

সাওদা (রাঃ)-এর প্রশংসা:
আয়িশা (রাঃ) বলেন, “একমাত্র সাওদা ছাড়া অন্য কোনো নারীকে দেখে আমার মধ্যে এমন আগ্রহ সৃষ্টি হয়নি যে, তাঁর দেহে যদি আমার প্রাণটি থাকত!”

মায়মূনা (রাঃ)-এর প্রসঙ্গে:
মায়মূনার (রাঃ) মৃত্যুর পর আয়িশা (রাঃ) বলেন, “তিনি আমাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি পরহেজগার ছিলেন।”

সাফিয়া (রাঃ)-এর সম্পর্কে:
সাফিয়া (রাঃ) চমৎকার খাবার তৈরি করতে পারতেন। তাঁর এই পারদর্শিতা তিনি (আয়িশা রাঃ) স্বীকার করেছিলেন এইভাবে — “আমি তাঁর চেয়ে ভালো খাবার তৈরি করতে পারে এমন কাউকে দেখিনি।”

সতীনদের সঙ্গে তাঁর (আয়িশা রাঃ-এর) ওঠা-বসা ও আচার-আচরণের অনেক কথা হাদীস ও সীরাতের গ্রন্থসমূহে বর্ণিত আছে—যেখানে তাঁর উদারতা, মহানুভবতা ও উন্নত নৈতিকতার সুন্দর চিত্র ফুটে উঠেছে।

আয়িশা (রাঃ)-এর মধুর ব্যবহার ও আচরণ সকলকে খুশি করত। আর তাই ‘ইফক’ (কলঙ্কারোপ) ঘটনার সময়, যখন তিনি দিশেহারা অবস্থায় ছিলেন, তখন তাঁর অন্যতম সতীন যায়নাব (রাঃ)-কে রাসূল (সাঃ) তাঁর চরিত্র সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে, তিনি উত্তর দিয়েছিলেন—
“আমি তো তাঁর মধ্যে ভালো ছাড়া কিছুই জানি না।”

আয়িশা (রাঃ) ও নবীজির (সাঃ) কন্যাগণ

আয়িশা (রাঃ) নিঃসন্তান ছিলেন। তবে রাসূলুল্লাহর (সাঃ) অন্য স্ত্রীদের বেশ কয়েকজন সন্তান ছিলেন। তাঁদের সঙ্গে আয়িশা (রাঃ)-এর সম্পর্ক ছিল আদর্শমানের।

যয়নাব, রুকাইয়্যা, উম্মু কুলসুম ও ফাতিমা—এই চার কন্যা ছিলেন খাদিজা (রাঃ)-এর সন্তান। আয়িশা (রাঃ) রাসূলুল্লাহর (সাঃ) ঘরে আগমনের পূর্বে একমাত্র ফাতিমা (রাঃ) ছাড়া অন্যদের বিয়ে হয়ে যায়, এবং তাঁরা নিজ নিজ স্বামীর ঘরে চলে যান।

হিজরির ৬ষ্ঠ সনে রুকাইয়্যা (রাঃ), এবং হিজরির ৮ম ও ৯ম সনে যথাক্রমে যায়নাব (রাঃ) ও উম্মু কুলসুম (রাঃ) ইন্তেকাল করেন।

হাদীস ও সীরাতের গ্রন্থাবলীতে তাঁদের সঙ্গে আয়িশা (রাঃ)-এর কোনো তিক্ত সম্পর্কের ঘটনাও পাওয়া যায় না। বরং নবীজির (সাঃ) এই কন্যাদের সম্পর্কে আয়িশা (রাঃ)-এর যেসব মন্তব্য ও আচরণের বিবরণ পাওয়া যায়, তাতে তাঁদের সঙ্গে তাঁর গভীর হৃদ্যতা ও ভালোবাসার সম্পর্কের প্রকাশ দেখা যায়।

যয়নাব (রাঃ), যিনি আল্লাহর পথে শাহাদাত বরণ করেন, তাঁর সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর এই বাণীটি আয়িশা (রাঃ) বর্ণনা করেছেন—
“সে আমার অতি ভালো মেয়ে ছিল; আমাকে ভালোবাসার কারণে তাকে কষ্ট দেওয়া হয়েছে।”

এই যায়নাবের মেয়ে উমামাহকে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কতটা স্নেহ ও আদর করতেন, তাও আয়িশা (রাঃ) নিজেই বর্ণনা করেছেন।

ফাতিমা (রাঃ)-এর সঙ্গে আয়িশা (রাঃ)-এর সম্পর্ক

আয়িশা (রাঃ) যখন স্বামীগৃহে আসেন, তখন কুমারী মেয়ে ফাতিমা (রাঃ) পিতার ঘরেই ছিলেন। তবে তিনি বয়সে আয়িশা (রাঃ)-এর চেয়ে পাঁচ বা ছয় বছর বড় ছিলেন। প্রায় এক বছর বা তার চেয়ে কিছু কম সময়ের জন্য এই মা-মেয়ে (ফাতিমা ও আয়িশা রাঃ) একসঙ্গে কাটিয়েছেন।

হিজরির ২য় সনের মধ্যে আলী (রাঃ)-এর সঙ্গে ফাতিমা (রাঃ)-এর বিয়ে সম্পন্ন হয়। এই বিয়ের উদ্যোগ ও আয়োজনের ক্ষেত্রে অন্যান্য মায়েদের সঙ্গে আয়িশা (রাঃ)ও শরিক ছিলেন। শুধু তাই নয়, রাসূলুল্লাহর (সাঃ) নির্দেশে তিনি এতে বিশেষ গুরুত্বও প্রদান করেন।

তিনি নিজ হাতে ঘর লেপেন, বিছানা তৈরি করেন, খেজুরের ছাল দুনে বালিশ বানান, খেজুর ও মানাক্কা অতিথিদের সামনে পরিবেশন করেন এবং কাঠের একটি আলনার মতো তৈরি করেন যাতে পানির মশক ও কাপড়চোপড় ঝুলিয়ে রাখা যায়।

আয়িশা (রাঃ) বর্ণনা করেছেন—
“ফাতিমার বিয়ের মতো এত চমৎকার বিয়ে আমি আর দেখিনি।”

ফাতিমা (রাঃ)-এর প্রশংসায় আয়িশা (রাঃ)

আয়িশা (রাঃ) বলেন,
“আমি ফাতিমার চেয়ে উত্তম মানুষ আর কাউকে দেখিনি, শুধুমাত্র তাঁর পিতা (রাসূলুল্লাহ সাঃ) ব্যতীত।”

একবার আয়িশা (রাঃ)-কে কেউ জিজ্ঞাসা করলেন,
“রাসূলুল্লাহর (সাঃ) কাছে সবচেয়ে প্রিয় কে ছিলেন?”
তিনি উত্তর দিলেন, “ফাতিমা।”

আয়িশা (রাঃ) আরও বলেন,
“রাসূলুল্লাহর (সাঃ) চলন-বলন, আচার-আচরণ, উঠা-বসার সাথে ফাতিমা (রাঃ)-এর মতো মিল আমি আর কারো মধ্যে দেখিনি।”

ফাতিমা (রাঃ) যখন তাঁর পিতার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আসতেন, পিতা সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে যেতেন, মেয়ের কপালে চুমু খেতেন এবং তাঁকে নিজের স্থানে বসাতেন। আবার পিতা (রাসূলুল্লাহ সাঃ) যখন তাঁর ঘরে যেতেন, মেয়ে উঠে দাঁড়াতেন, পিতার কপালে চুমু দিতেন এবং নিজ স্থানে বসাতেন।

স্বামীগৃহে ফাতিমা (রাঃ) নিজ হাতে সব গৃহকর্ম করতে করতে একসময় কিছুটা ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন। একদিন তিনি পিতার কাছে এসে একটি দাসী প্রাপ্তির আবেদন করেন। কিন্তু ঘটনাক্রমে পিতার (রাসূলুল্লাহ সাঃ) দেখা পাননি। তখন তিনি মা আয়িশা (রাঃ)-কে অনুরোধ করেন যেন এ বিষয়ে পিতার সঙ্গে কথা বলেন। এরপর তিনি ফিরে যান।

আয়িশা (রাঃ)-এর বর্ণনায় এক হৃদয়স্পর্শী ঘটনা

আয়িশা (রাঃ) বর্ণনা করেন—
“একদিন আমরা সকল স্ত্রী রাসূলুল্লাহর (সাঃ) পাশে বসে ছিলাম। এমন সময় ফাতিমা (রাঃ) সামনের দিক থেকে এলেন। তাঁর চলন ছিল রাসূলুল্লাহর (সাঃ)-এর মতো; একটুও পার্থক্য ছিল না।

রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাঁকে অত্যন্ত আবেগের সঙ্গে ডেকে পাশে বসালেন। তারপর চুপিসারে তাঁর কানে কিছু কথা বললেন। ফাতিমা (রাঃ) কাঁদতে লাগলেন। তাঁর এই অস্থিরতা দেখে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) আবার কানে কানে কিছু বললেন—এবার ফাতিমা (রাঃ) হাসতে লাগলেন।

আয়িশা (রাঃ) বলেন—
“আমি ফাতিমাকে বললাম, ‘ফাতিমা! রাসূল (সাঃ) তাঁর স্ত্রীদের বাদ দিয়ে তোমার সঙ্গে গোপন কথা বললেন, আর তুমি কাঁদছো?’”

রাসূলুল্লাহ (সাঃ) উঠে গেলে আমি ফাতিমার (রাঃ) কাছে বিষয়টি জানতে চাইলাম। তিনি বললেন,
“আমি আমার আব্বার গোপন কথা প্রকাশ করব না।”

পরে, রাসূলুল্লাহর (সাঃ) ইন্তেকালের পর, আয়িশা (রাঃ) একদিন আবার বিষয়টি জানতে চান। তখন ফাতিমা (রাঃ) বলেন—
“আমার কান্নার কারণ ছিল, তিনি আমাকে তাঁর মৃত্যুর কথা জানিয়েছিলেন। আর হাসির কারণ ছিল, তিনি আমাকে বলেছিলেন—
‘ফাতিমা! এটা কি তোমার জন্য আনন্দের বিষয় নয় যে, তুমি দুনিয়ার সকল নারীদের নেত্রী হবে?’”

উপরের এই সকল ঘটনার মাধ্যমে স্পষ্ট বোঝা যায়—
আয়িশা (রাঃ)-এর সঙ্গে নবীজির (সাঃ) কন্যাদের সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত মধুর, ভালোবাসা ও শ্রদ্ধায় পূর্ণ। এ ধরনের আরও বহু ঘটনা হাদীস ও সীরাতের গ্রন্থসমূহে উল্লেখ রয়েছে।

হযরত আয়িশা সিদ্দীকা (রাঃ) -এর ১৫ পর্ব পড়তে ক্লিক করুন

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

সম্পর্কিত পোস্ট

দুঃখিত!