হযরত আয়িশা সিদ্দীকা (রাঃ) -এর ১ম পর্ব

উম্মুল মু’মিনীন আয়িশা সিদ্দীকা (রাঃ) ছিলেন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর প্রিয়তমা স্ত্রী। তাঁর ডাকনাম বা কুনিয়াত ছিল ‘উম্মু আবদিল্লাহ’ এবং উপাধি ‘সিদ্দীকা’। কিছু বর্ণনায় এসেছে, তাঁর আরেকটি উপাধি ছিল ‘আল-হুমায়রা’। তিনি ফরসা ও সুন্দরী ছিলেন, এ কারণেই তাঁকে ‘আল-হুমায়রা’ বলা হতো।

উরওয়া (রহঃ) বলেন, একবার হিজাবের হুকুম নাযিলের পূর্বে উয়ায়না ইবন হিসন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সাথে সাক্ষাৎ করতে আসেন। তখন আয়িশা (রাঃ) সেখানে উপস্থিত ছিলেন। উয়ায়না আয়িশার প্রতি ইঙ্গিত করে বললেন, “ইয়া রাসূলুল্লাহ! এই ‘আল-হুমায়রা’ (সুন্দরীটি) কে?” রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জবাব দিলেন, “তিনি আবু বকরের কন্যা আয়িশা।” তবে অনেকে এই বর্ণনাটিকে ভিত্তিহীন বলেছেন।

আবদুল্লাহ ছিলেন আয়িশা (রাঃ)-এর বোন আসমা (রাঃ)-এর ছেলে। ইতিহাসে তিনি ‘আবদুল্লাহ ইবন যুবাইর’ নামে প্রসিদ্ধ। কুনিয়াত সাধারণত সন্তানের নামের সাথে যুক্ত হয়ে থাকে। আয়িশা (রাঃ) নিঃসন্তান ছিলেন, তাই তাঁর কোনো কুনিয়াতও ছিল না। সে সময়ের আরবে কুনিয়াত ছিল মর্যাদা ও আভিজাত্যের প্রতীক। অভিজাত শ্রেণির মানুষদের নাম ধরে ডাকার প্রচলন ছিল না; তাঁদের কুনিয়াত বা উপনামেই সম্বোধন করা হতো।

একদিন আয়িশা (রাঃ) স্বামী রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে বললেন, “আপনার অন্য স্ত্রীগণ তাঁদের পূর্ব স্বামীদের সন্তানদের নামে কুনিয়াত ধারণ করেছেন, আমি কার নামে কুনিয়াত গ্রহণ করব?” রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, “তোমার বোনের ছেলে আবদুল্লাহর নামে।” সেই দিন থেকে তাঁর কুনিয়াত বা ডাকনাম হয় ‘উম্মু আবদিল্লাহ’— অর্থাৎ ‘আবদুল্লাহর মা’।

একথাও বর্ণিত হয়েছে যে, আয়িশা (রাঃ) একটি পুত্রসন্তানের মা হয়েছিলেন এবং শিশুকালেই তার মৃত্যু হয়। তার নাম রাখা হয় ‘আবদুল্লাহ’। সেই সন্তানের নামেই তাঁর কুনিয়াত হয়। তবে ইবনু হাজার আসকালানী বলেন, এই বর্ণনা সঠিক নয়। তাছাড়া বিভিন্ন সহীহ হাদীসে স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে যে, তিনি নিঃসন্তান ছিলেন।

আয়িশা (রাঃ)-এর পিতা ছিলেন খলীফাতু রাসূলিল্লাহ, আস্-সিদ্দীকুল আকবর আবু বকর (রাঃ) এবং মাতা উম্মু রূমান জয়নাব বিনত আমির (মতান্তরে উমাইর আলি কিনানী)। পিতার দিক দিয়ে তিনি কুরাইশ গোত্রের বনু তাইম শাখার এবং মাতার দিক দিয়ে বনু কিনানার সন্তান। তাঁর মা ছিলেন গানাম ইবন মালিক কিনানার কন্যা।

রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও আয়িশা (রাঃ)-এর বংশধারা পিতৃকূলের দিক দিয়ে উপরের দিকে সপ্তম বা অষ্টম পুরুষে এবং মাতৃকূলের দিক দিয়ে একাদশ বা দ্বাদশ পুরুষে মিলিত হয়েছে।

আয়িশা (রাঃ)-এর পিতা আবু বকর (রাঃ) হিজরী ১৩ সনে ইনতিকাল করেন। মাতা উম্মু রূমান সম্পর্কে অধিকাংশ ঐতিহাসিক লিখেছেন যে, তিনি পাঁচ অথবা ছয় হিজরীতে ইনতিকাল করেন। বলা হয়, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিজ হাতে তাঁর কবরে নেমে দাফন করেন এবং জানাযার নামায পড়েন। তবে এ তথ্যটি নির্ভুল নয়।

নির্ভরযোগ্য হাদীসসমূহ দ্বারা প্রমাণিত যে, তিনি উসমান (রাঃ)-এর খিলাফতকাল পর্যন্ত জীবিত ছিলেন। হিজরী ৬ষ্ঠ সনের ইফক (আয়িশা রাঃ-এর চরিত্রে অপবাদ আরোপ) ঘটনার সকল হাদীসে তাঁর উল্লেখ পাওয়া যায়। হিজরী নবম সনের ‘তাখইর’ (যে কোনো একটি জিনিস বেছে নেওয়ার অনুমতি) ঘটনার সময়ও তিনি জীবিত ছিলেন—এ তথ্য তাবাকাত, সহীহ বুখারী, সহীহ মুসলিম ও মুসনাদে আহমাদের বর্ণনাসমূহে পাওয়া যায়।

ইমাম বুখারী তাঁর তারীখুস সাগীর গ্রন্থে উম্মু রূমান (রাঃ)-এর নাম উল্লেখ করেছেন সেইসব ব্যক্তিদের মধ্যে, যারা হযরত আবু বকর (রাঃ)-এর খিলাফতকালে ইনতিকাল করেন। তিনি প্রথম বর্ণনাটিকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। হাফেজ ইবনু হাজার তাঁর আত-তাহযীব গ্রন্থে বিশ্লেষণধর্মী আলোচনা করে প্রমাণ করেছেন যে, ইমাম বুখারীর বর্ণনাই সঠিক।

আয়িশা (রাঃ)-এর মা উম্মু রূমান (রাঃ)-এর প্রথম বিয়ে হয় আবদুল্লাহ ইবন আল-হারিস আল-আযদীর সঙ্গে। আবদুল্লাহ স্ত্রী উম্মু রূমানকে নিয়ে মক্কায় আসেন এবং আবু বকর (রাঃ)-এর সঙ্গে মৈত্রী চুক্তি করে সেখানে বসবাস করতে থাকেন। এটি ইসলাম-পূর্ব সময়ের ঘটনা। তাঁদের আত-তুফাইল নামে এক পুত্রসন্তান জন্ম নেয়। পরে আবদুল্লাহ মৃত্যুবরণ করলে আবু বকর (রাঃ) উম্মু রূমানকে বিয়ে করেন। এই দাম্পত্য জীবনেই তাঁদের দুই সন্তান জন্মগ্রহণ করেন—আবদুল্লাহ ও আয়িশা (রাঃ)।

হযরত আয়িশা (রাঃ)-এর জন্মের সঠিক সময়কাল সম্পর্কে তারিখ ও সীরাতের গ্রন্থগুলোতে সুস্পষ্ট তথ্য পাওয়া যায় না। এ কারণেই তাঁর জন্মসন সম্পর্কে মতভেদ পরিলক্ষিত হয়।

সাইয়্যেদ সুলায়মান নাদবী বলেন, ঐতিহাসিক ইবন সা’দ লিখেছেন—এবং কিছু সীরাতবিশারদ তাঁকে অনুসরণ করে বলেছেন—নুবুওয়াতের চতুর্থ বছরের সূচনায় আয়িশা (রাঃ) জন্মগ্রহণ করেন এবং দশম বছরে ছয় বছর বয়সে তাঁর বিয়ে হয়। কিন্তু এ কথা কোনোভাবেই সঠিক হতে পারে না, কারণ নুবুওয়াতের চতুর্থ বছরের সূচনায় তাঁর জন্ম হলে দশম বছরে তাঁর বয়স ছয় নয়, বরং সাত বছর হবে।

মূলত আয়িশা (রাঃ)-এর বয়স সম্পর্কে কয়েকটি বিষয় সর্বসম্মতভাবে প্রতিষ্ঠিত। তা হলো—

হিজরতের তিন বছর পূর্বে ছয় বছর বয়সে তাঁর বিয়ে সম্পন্ন হয়।

প্রথম হিজরীর শাওয়াল মাসে নয় বছর বয়সে তিনি স্বামীর গৃহে যান।

এগারো হিজরীর রাবীউল আউয়াল মাসে আঠারো বছর বয়সে তিনি বিধবা হন।

এই হিসেবে তাঁর জন্মের সঠিক সময়কাল হবে নুবুওয়াতের পঞ্চম বছরের শেষ দিক। অর্থাৎ হিজরতের পূর্ব নবম সনের শাওয়াল মাসে—যা খ্রিষ্টীয় বর্ষপঞ্জিতে জুলাই, ৬১৪ খ্রিস্টাব্দের সমতুল্য।

উল্লেখ্য যে, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর তেইশ বছরের নুবুওয়াতী জীবনের প্রায় তেরো বছর মক্কায় এবং দশ বছর মদীনায় অতিবাহিত হয়েছে। নাদবী সাহেবের বর্ণনা মতে, আয়িশা (রাঃ)-এর জন্ম হয় যখন নুবুওয়াতের চার বছর অতিক্রান্ত হয়ে পঞ্চম বছর চলছিল।

ইমাম যাহাবী বলেন, আয়িশা (রাঃ) ফাতিমা (রাঃ)-এর চেয়ে আট বছরের ছোট ছিলেন। আয়িশা (রাঃ) স্বয়ং বলেছেন, তিনি মক্কায় এক বৃদ্ধ অন্ধ হাতি চালকের সাক্ষাৎ পেয়েছিলেন।

আয়িশা (রাঃ) কখন ও কীভাবে মুসলমান হয়েছিলেন, সে সম্পর্কে বিশেষ কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। তবে হযরত সিদ্দীক আকবর (রাঃ)-এর এটি বড় সৌভাগ্য যে, তাঁরই গৃহে সর্বপ্রথম ইসলামের আলো প্রবেশ করেছিল। এই কারণে হযরত আয়িশা (রাঃ) তাঁদের মধ্যেই অন্যতম, যাঁদের কর্ণকুহরে মুহূর্তের জন্যও কুফর বা শিরকের শব্দ প্রবেশ করেনি।

আয়িশা (রাঃ) বলেন,

“যখন থেকে আমি আমার বাবা-মাকে চিনেছি, তখন থেকেই তাঁদের মুসলমান অবস্থায় পেয়েছি।”

ইমাম যাহাবী শুধু এ কথাই বলেছেন যে, আয়িশা (রাঃ) ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন; তবে কখন এবং কীভাবে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন, সে বিষয়ে কিছু বলেননি।

ইবন হিশাম যাঁরা আবু বকর (রাঃ)-এর হাতে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন, তাঁদের একটি স্বতন্ত্র শিরোনামে উল্লেখ করেছেন। সেখানে আয়িশা (রাঃ)-এর নামও এসেছে।

আয়িশা (রাঃ)-কে ওয়ায়িলের স্ত্রী দুধ পান করান। এই ওয়ায়িলের ডাকনাম ছিল আবুল ফুকাই’য়াস। তাঁর ভাই আফলাহ, যিনি আয়িশা (রাঃ)-এর দুধচাচা, পরবর্তীকালে মাঝে মাঝে তাঁর সাথে দেখা করতে আসতেন। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর অনুমতি নিয়ে আয়িশা (রাঃ) তাঁর সামনে যেতেন। তাঁর দুধভাইও মাঝে মাঝে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আসতেন।

আয়িশা (রাঃ)-এর বাল্যজীবন অন্যসব শিশুদের মতোই কেটেছে, তবে কিছুটা ভিন্নতায় পরিপূর্ণ ছিল। শৈশবেই তাঁর তীক্ষ্ণ মেধা ও বুদ্ধিমত্তার পরিচয় পাওয়া যায়। অন্যান্য শিশুদের মতো তিনিও খেলাধুলায় আগ্রহী ছিলেন। সমবয়সী প্রতিবেশী মেয়েরা প্রায়ই তাঁর কাছে আসত, এবং তিনি অধিকাংশ সময় তাঁদের সঙ্গে খেলতেন।

কিন্তু সেই বয়সেও তিনি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর মর্যাদা ও সম্মানের প্রতি সচেতন ছিলেন। অনেক সময় এমন হতো—তিনি অন্যদের সঙ্গে পুতুল নিয়ে খেলছেন, এমন সময় রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁদের গৃহে প্রবেশ করতেন। তখন আয়িশা (রাঃ) তাড়াতাড়ি পুতুলগুলো লুকিয়ে ফেলতেন, আর তাঁর সাথীরা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে দেখামাত্র ছুটে পালিয়ে যেত।

রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) শিশুদের ভালোবাসতেন এবং তাঁদের খেলাধুলাকে খারাপ মনে করতেন না। তিনি পালিয়ে যাওয়া শিশুদের ডেকে এনে আয়িশা (রাঃ)-এর সঙ্গে খেলতে বলতেন।

শিশুদের খেলাধুলার মধ্যে দুটি খেলা ছিল আয়িশা (রাঃ)-এর প্রিয়তম—পুতুল খেলা ও দোল খাওয়া।

একদিন আয়িশা (রাঃ) পুতুল নিয়ে খেলছিলেন, এমন সময় রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এসে পড়লেন। পুতুলগুলোর মধ্যে একটি দুই ডানাওয়ালা ঘোড়াও ছিল। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হাসতে হাসতে বললেন,

“ঘোড়ার তো কোনো ডানা হয় না!”

আয়িশা (রাঃ) সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিলেন,

“কেন হবে না? সুলাইমান (আলাইহিস সালাম)-এর ঘোড়াগুলোর তো ডানা ছিল! আপনি কি তা শোনেননি?”

আয়িশা (রাঃ)-এর এমন উপস্থিত বুদ্ধির জবাব শুনে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এতটাই হাসলেন যে, তাঁর দাঁত পর্যন্ত দেখা গেল।

হযরত আয়িশা সিদ্দীকা (রাঃ) -এর ২য় পর্ব পড়তে ক্লিক করুন

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

সম্পর্কিত পোস্ট

দুঃখিত!