হযরত আবদুল্লাহ খাফীফ (রঃ) – পর্ব ৩
হযরত আবদুল্লাহ খাফীফ (রঃ) – পর্ব ২ পড়তে এখানে ক্লিক করুন
এদের মধ্যে একজন ছিলেন এক মন্ত্রী কন্যা। তিনি একটানা চল্লিশ বছর তাঁর স্ত্রী হিসেবে বহাল ছিলেন। তিনি বলেন, হযরত আবদুল্লাহ যখন তাঁর কাছে আসতেন, তা তিনি আগেই জানিয়ে দিতেন। তাঁর জন্য সুন্দর সুন্দর খাবার তৈরি করা হত। তিনি নিজেও সুসজ্জিত হয়ে থাকতেন। প্রথম যেদিন তিনি মন্ত্রী দুহিতার কাছে আসেন সেদিন তাঁর আহার্য সামগ্রী স্পর্শ না করে স্ত্রীর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকেন। তারপর তাঁর হাতখানি টেনে নিয়ে তাঁর পেট ও বুকের গর্তেগুলি দেখান (মোট আঠারোটি গর্ত ছিল)।
তিনি বলেন, এই গর্তগুলি হল তাঁর ধৈর্য ও সহিষ্ণতার চিহ্ন। তাঁর মতো সুন্দরীর প্রতি কিংবা তাঁর পরিবেশিত আহার্যের প্রতি তাঁর বিন্দুমাত্র লোভ নেই। এ কথা বলেই তিনি চলে যান। আর সেদিন থেকে মন্ত্রী কন্যা কোন বিষয়ে তাঁকে আর প্রশ্ন করার সাহস দেখাননি।
হযরত আবদুল্লাহ খফীফ (রঃ)-এর দুজন শিষ্য ছিলেন। দুজনেরই নাম ছিল আহমদ। তিনি একজনকে বলতেন, আহমদ কাহ ও অন্যজনকে বলতেন আহমদ মাহ। আহমদ কাহ এর প্রতি তাঁর স্নেহ একটু বেশী ছিল। শিষ্যগণের কাছে সেটি বিসদৃশ মনে হত। কেননা অধ্যাত্ম দিক দিয়ে আহমদ মাহই ছিলেন অগ্রগণ্য। হযরত আবদুল্লাহ (রঃ) শিষ্যগণের এ মনোভাবে কথা বুঝতে পেরে একদিন প্রকাশ্য সভায় আহমদ মাহকে নির্দেশ দেন দরজায় দাঁড়ানো উটকে ছাদের ওপর নিয়ে গিয়ে তিনি যেন বেঁধে রাখেন। আহমদ মাহ বললেন, উট ছাদের কাহ এক হাতে উটের পেট ও অন্য হাতে উটের পিঠ ধরে টানাটানি করলেন। কিন্তু উটটি এক পা-ও নড়ল না। এবার হযরত আবদুল্লাহ খফীফ (রঃ) তাঁর শিষ্যদের বললেন, দুজনের মধ্যে পার্থক্য কোথায় বুঝতে পারলে? আহমদ কাহ নির্দেশ পাওয়া মাত্র তা পালন করার চেষ্টা করছে। সেটি সম্ভব কি তা ভাবতে যায়নি। আর আহমদ মাহ নির্দেশ পালনের ব্যাপারে যুক্তি ও বুদ্ধির আশ্রয় নিয়েছে।
একদিন এক লোক এলেন হযরত খাফীফ (রঃ)-এর দরবারে। কালো জামা গায়ে, মাথার কালো পাগড়ী, এমনকি পরনের পাজামাটিও কালো। তিনি বিরক্তে হয়ে বললেন, আপনার এমন কালো পোশাক কেন? তিনি বললেন, আমার প্রভু অর্থাৎ রিপুর মৃত্যু ঘটেছে। আমার পরনে তাই শোকের প্রতীক। তখন হযরত খাফীফ (রঃ) তাঁকে দরবার থেকে বের করে দিতে বললেন। তাই করা হল। কিন্তু পরক্ষণে তাঁকে আবার ভেতরে আনার আদেশ দিলেন। তাও করা হল। এভাবে পর পর সত্তরবার তাঁকে ভেতর বার করা হল। কিন্তু দেখা গেল। কিন্তু দেখা গেল লোকটির চোখে-মুখে বিরক্তির কোন চিহ্ন ফুটে উঠল না। তিনি তখন মন্তব্য করলেন, হ্যাঁ, কালো পোশাক পরিধান করা তাঁর পক্ষে যথাযথ হয়েছে।
একবার দূর পথ পাড়ি দিয়ে দুজনে সুফী সাধক তাঁর সঙ্গে দেখা করতে এলেন। কিন্তু তাঁর জানতে পারলেন, কিছুক্ষণ আগে উনি গিয়েছেন বাদশাহর দরবারে। আর স্বভাবতই তাঁরা অপ্রসন্ন হয়ে উঠলেন। একজন সাধক কেন রাজসভায় যাবেন? আর তাই যদি হয় তা হলে তাঁর সঙ্গে আর দেখা করার কি প্রয়োজন? তাঁরা দেশে ফিরে চললেন। পথে এক বাজারে তাঁরা গেলেন একজনের ছেঁড়া জেব সেলাই করতে এক দর্জির কাছে। তাঁরা দোকানে থাকতে থাকতেই দর্জির একখানা কাঁচি চুরি গেল। আর সন্দেহ পড়ল তাঁদেরই ওপর। দর্জি দুজনকে ধরে নিয়ে গেল বাদশাহ
আযদুদ্দৌলার দরবারে। তখন দরবারে হাজির রয়েছেন হযরত আবদুল্লাহ খাফীফ (রঃ)। বিচারে সূফী দুজনের হাত কাটার রায় দেয়া হল। কিন্তু হযরত আবদুল্লাহ খাফীফ (রঃ) তাঁদের নির্দোষ বলে সুপারিশ করলেন। তাঁদের ছেড়ে দেয়া হল। অতঃপর তাঁদের লক্ষ্য করে হযরত খাফীফ (রঃ) বললেন, আমার সম্বন্ধে আপনারা যা ধারণা করেছিলেন তা অমূলক। আপনাদের উদ্ধার করার জন্যই আজ আমাকে রাজদরবারে আসতে হয়েছিল। এ ধরণের প্রয়োজনে আমাকে মাঝে মাঝে দরবারে আসতে হয়।
বলাবাহুল্য, লজ্জিত হয়ে সুফী-দরবেশগণ তাঁর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করলেন। দীক্ষা নিলেন অধ্যাত্ম বিদ্যার। পরবর্তীকালে তাঁরা বিখ্যাত সাধক হলেন।
আর একদিন তাঁর দরবারে এলেন এক মেহমান। তাঁর আপ্যায়নে কোন ত্রুটি হল না। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে লোকটির পেট খারাপ হয়ে গেল। প্রায় পঁঞ্চাশ বারেও বেশী তাঁকে পায়খানায় যেতে হল। প্রতিবারই তাঁকে সাহায্য করলেন খাফীফ (রঃ) নিজেই। বস্তুত তাঁর পরিচর্যায় তিনি সারারাত দুচোখ এক করতে পারলেন না। শুধু শেষ রাতে যখন একটু ঘুম এল, তখন পা দুটি বিছানার ওপর ছড়িয়ে দিলেন। আর ঠিক সে সময় মুসাফিরের আবার পায়খানায় যাওয়ার প্রয়োজন দেখা দিল। তিনি হযরত খাফীফ (রঃ)-কে ডাক দিলেন। কিন্তু তাঁর কোন সাড়া পাওয়া গেল না। কিন্তু মেহমানেরও অবস্থা তখন চরম। তিনি জোরে চেঁচিয়ে উঠলেন, কোথায় গেলেন আপনি? আপনার ওপর আল্লাহর অভিশাপ নেমে আসুক। তাঁর চেঁচামেচিতে অন্যান্য সবাই জেগে উঠলেন। তাঁরা হযরত আবদুল্লাহ (রঃ)-কে বললেন, কার জন্য আপনি এত কষ্ট করলেন? একটুকুতেই যে আল্লাহর অভিশাপ কামনা করে বসল? তিনি বললেন, আমার তো মনে হয় তিনি আমার ওপর আল্লাহর রহমত কামনা করলেন।
হযরত আবদুল্লাহ খাফীফ (রঃ)-এর উপদেশগুলি মানব জাতির জন্য এক অমূল্য সম্পদ।
সূত্রঃ তাযকিরাতুল আউলিয়া