মালেক হুজুর উত্তর ভেদুরিয়া ফাজিল মাদ্রাসার পৌরনীতির প্রভাষক। লম্বা জুব্বা আর চুড়িদার পাজামা পরেন সবসময়। মাথায় পরেন সাদা নেটের টুপি। মালেক হুজুরের চেহারা কৃষ্ণবর্ণ। লম্বা দাড়িতে ঈষৎ পাক ধরেছে তার। গোঁফজোড়া ছোট করে ছাঁটা। বয়স চল্নিশের কোঠায়। তার চেহারা কৃষ্ণবর্ণ হলেও মলিন নয়। চেহারায় উজ্জ্বলতা আছে যাকে নূরানী ছাট বলা যায়। কেউ অব্যাহতভাবে ধর্মকর্ম করলে চেহারায় এ রকম ছাট পড়ে। তার চোখ জোড়া ধ্যানমগ্ন, ভীষণ মায়াবী। খুব কাছ থেকে দেখলে দেখা যাবে চোখের পিসিতে তিনি খুব সূক্ষ্মভাবে সুরমা এঁকেছেন। সুরমা রসুলের সুন্নত। তার লেবাসও রসুলের তরিকা মত। তিনি যতই পৌরনীতির প্রভাষক হন আর পৌর বিজ্ঞান পড়ান তার চেহারা এবং বেশভূষা দেখলে কেই তাকে ‘হুজুর’ ছাড়া কিছু বলবে না। এই মালেক হুজুর জিন্দাবাহার ডিগ্রী কলেজের পদার্থবিদ্যার প্রভাষক জাকির হোসেনকে কখনোই চিনত না।
জাকির হোসেন লম্বা, স্নিম, সুদর্শন। হালকা স্ট্রাইপের মসৃণ সুতি শার্ট চকচকে বেল্টে ইন করা। তার কালো প্যান্টের নিচে কালো সু জোড়াও বেশ চকচকে। দাড়ি-গোঁফ নেই। চমৎকার ক্লিনসেভড, কিন্তু তার বসয়টা ঠিক বোঝা যায় না। কখনো মনে হয় তার বয়স ত্রিশের নিচে, কখনো মনে হয় উপরে। এক কথায় তাকে ‘স্মার্ট গাই’ বলা যায়। তার সম্পর্কে যদি আরেকটু বাড়িয়ে বলা হয় তাহলে বলতে হবে জাকির হোসেন শিক্ষকতার মতো একটি মিনমিনে পেশায় ঠিক মানানসই নয়। তার যে স্মার্টনেস, তার যে চলন-বলন সবকিছুই যেন কোন কর্পোরেট কর্মকর্তার মতো উচ্চাভিলাষী এবং দাম্ভিকতাপূর্ণ।
উত্তর ভেদুরিয়া ফাজিল মাদ্রাসার এই মালেক হুজুর এবং জিন্দাবাহার ডিগ্রী কলেজের জাকির হোসেনের সঙ্গে হঠাৎ একদিন দেখা হয়ে যায়। তারা শিক্ষা বোর্ডের ভিজিলেন্স টিমের সদস্য হিসেবে বিদ্যানন্দপুর মহিলা কলেজের পরীক্ষার হলে হল পরিদর্শকের দায়িত্ব পায়।
সেদিন পরীক্ষা ছিল ইংরেজি। উচ্চ মাধ্যমিক লেভেলে খুব কঠিন পরীক্ষা। কিছু দিন আগেও হলে নকলের খুব প্রচলন ছিল। কিন্তু সরকারের সদিচ্ছা এবং ভিজিলেন্স টিমের অব্যাহত দৌরাত্ম্যের কারণে নকল প্রবণতা এখন নেই বললেই চলে। হলের ভিতরে বাইরের লোকজনের ঘোরাফেরাও এখন রেস্ট্রিক্টেড। সে কারণে জাকির হোসেন এবং মালেক হুজুর অতটা সতর্ক অবস্থায় নেই। তারা একটি বড় হলে এমাথা ওমাথা ঘুরেফিরে ডিউটি করে। মালেক হুজুর ঘোরাফেরা অবস্থায়, পাশাপাশি অবস্থানের সময় কিম্বা যখন একটু বিশ্রামের সময় কোথাও সে দাঁড়ায় তখন সে জাকির হোসেনকে প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে। সে জিজ্ঞেস করে, ভাইসাব কোন কলেজের? জাকির হোসেন কলেজের নাম বলে কিন্তু সে বাড়তি কিছু বলে না। কিম্বা সে মালেক হুজুরকে উল্টো কোন প্রশ্ন করে না। জাকির হোসেনের মধ্যে এক ধরনের সহনশীলতা কিম্বা ব্যক্তিগত ব্যাপারে ঔদাসীন্য সপষ্ট হয়ে ওঠে। সে সুযোগে মালেক হুজুর তাকে একের পর এক প্রশ্ন করে যায়।
-নাম কি?
-কোন সাবজেক্ট?
-চাকরি হয়েছে কবে?
-বিয়ে করেছেন…
জাকির হোসেন নিসপৃহভাবে একের পর এক উত্তর দিয়ে যায়। মালেক হুজুর সবশেষে প্রশ্ন করে আপনার দেশের বাড়ি কোথায়? এ প্রশ্নে জাকির হোসেন হাসে। কিন্তু হাসিটা ঠিক অবজ্ঞার নয়। তার ধারণার সঙ্গে মালেক হুজুরের বৈশিষ্ট্য মিলে যাওয়ায় তার এই হাসি। জাকির হোসেনের ধারণা; প্রয়োজনে মানুষ নাম ঠিকানা জিজ্ঞেস করতে পারে অপ্রয়োজনে কেন করবে? তার সঙ্গে তো ভদ্রলোকের কোন প্রয়োজন নেই। পরীক্ষার হলে যার যার কাজ সে সে করবে। জাকির হোসেনের ধারণা যারা অহেতুক এ ধরনের প্রশ্ন করে তারা অশিক্ষিত, ব্যক্তি স্বাধীনতা বোঝে না। আর যারা দেশের বাড়ির কথা জিজ্ঞেস করে তারা আসলে গ্রাম্য।
জাকির হোসেনের জন্ম গ্রামে হলেও গ্রামের সঙ্গে তার এখন আর যোগাযোগ নেই। গ্রামে তার ছোট চাচা থাকে। জাকির হোসেন স্কুলে পড়ার সময় বহুবার গ্রামে গেছে। বাবা-চাচার সঙ্গেতো গেছেই একাও গেছে অনেকবার। গ্রামে গিয়ে নদীতে গোসল করা, পুকুরে সাঁতার কাটা, হা-ডু-ডু, দাড়িয়াবান্দা খেলা, আম কাঁঠালের দিনে গাছে চড়ে আম কাঁঠাল পাড়া, মাছ ধরা এ সবকিছু এখন তার স্মৃতির অংশ। মাঝে মাঝে তার শৈশবকে বেশ সমৃদ্ধই মনে হয়। জাকির হোসেনের ভিতরে গ্রামের প্রতি পূর্বের সেই টান আর নেই। তবে তার বাবার টান এখনো অটুট। চাচা শহরে এলে বাবা গ্রামের বিভিন্ন লোক সম্পর্কে খোঁজ-খবর করেন। কে কি করছে, কার কোথায় বিয়ে হল, নদীর চরটা কতদূর বাড়ল। গ্রামের জমিজমা, মামলা-মোকদ্দমা নিয়েও তার কৌতূহলের শেষ নেই। জাকির হোসেনের বাবা একটা প্রাইভেট কোম্পানির বড় কর্মকর্তা। সারাদিন কাজের মধ্যেই ডুবে থাকেন। গ্রামে যাবার ফুসরৎ পান না। তবে তার একটি স্বপ্ন আছে; তিনি রিটায়ার করে গ্রামে ফিরে যাবেন, বাংলো টাইপের একটি বাড়ি বানাবেন। তার বাকি জীবন গাছপালা লাগিয়ে, গাছের পরিচর্যা করে, গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগী পালন করে নদীর পাড়ে ঘুরে ফিরে কাটিয়ে দেবেন। তার বাবা তার স্বপ্নের কথা ছেলেমেয়েদের প্রায়ই বলেন। কিন্তু জাকির হোসেন জানে তার বাবা নাগরিক জীবনে পুরোপুরি অভ্যসত হয়ে গেছেন, তার পক্ষে গ্রামে ফিরে যাওয়া সম্ভব নয়।
মালেক হুজুরের প্রশ্নের জবাবে জাকির হোসেন ছোট করে তার গ্রামের নাম বলে। তখন মালেক হুজুর চমকে উঠে। তার সুরমা দেয়া চোখ স্থির হয়ে পড়ে। সে জাকির হোসেনকে জিজ্ঞেস করে, কোন বাড়ি আপনার? জাকির হোসেন বাড়ির নাম বলে। তখন সে তার প্রশ্ন করার ভঙ্গি নরম করে ফেলে।
-হাতেম মীরবর আপনার কি হন?
-চাচা।
-আপনার বাবার নাম হাসেম মীরবর?
জাকির হোসেন মাথা নেড়ে সায় দেয়। কিন্তু সে মালেক হুজুরকে একবারের জন্যও প্রশ্ন করে না। কিম্বা তার বাড়ি-ঘর, ঠায়-ঠিকানা, এতটা সে কিভাবে জানে সেটা নিয়েও জাকির হোসেনর কোন কৌতূহল নেই। সে আগের মতই পুরোপুরি নিসপৃহ। জাকির হোসেন প্রশ্ন না করলেও মালেক হুজুর প্রশ্ন করে যেতে থাকে…
-আপনার বাবা এখন কি করেন?
-তিনি কেমন আছেন? বহুদিন তার সঙ্গে দেখা হয় না। আপনার চাচাতো ভাইয়েরাতো সবাই বিদেশে। আপনার চাচা-চাচি গ্রামে ভালই আছেন। ছেলেরা বিদেশ থেকে মেলা টাকা পাঠায়; বাড়িতে ফ্রিজ কিনছে…
জাকির হোসেন এবার একটু বিরক্ত। তাদের কথা বলার ফাঁকে হলের মেয়েরা এ ওর খাতা দেখার চেষ্টা করছে, কথা বলছে। হলের শানিতপূর্ণ পরিবেশ আর নেই। ছাত্রীরা যাদের ভয় পাবে তারা নিজেরাই যদি কথাবার্তায় মশগুল থাকে তারাতো একটু অমনোযোগী হবেই। জাকির হোসেন কয়েকবার ধমক-ধামক দিয়ে কয়েকজনের খাতা টেনে আটকে রেখে হলের পরিস্থিতি কিছুক্ষণের মধ্যে স্বাভাবিক করে ফেলে। জাকির হোসেনের বিরক্তি আরো একটি কারণে, লোকটা এতগুলো প্রশ্ন করলো অথচ একবারেও সে নিজের পরিচয় দিল না। এটা এক ধরনের অভদ্রতা। জাকির হোসেন মনে মনে সিদ্ধানত নেয় সে আর কোন প্রশ্নের উত্তর দেবে না। এবং কোন প্রশ্নও করবে না। ঠিক তখনই মালেক হুজুর তার পাশে এসে দাঁড়ায়। সে যেন তার মনের কথা বুঝে ফেলে। সে বলে, আসলে আমার ভুল হয়ে গেছে, আমি আমর নিজের পরিচয়টাইতো দেই নাই। আমি আপনার বাড়ির পাশের লোক। আমাদের বাড়ি আমিরাবাদের হাটখোলার দক্ষিণ দিকে। খোদানেওয়াজ খাঁর বাড়ি। আপনার চাচার সঙ্গে আমাদের খুব ভাল সম্পর্ক।
এবার জাকির হোসেন মালেক হুজুরের প্রতি ভীষণ উৎসাহী হয়ে ওঠে। তার চোখেমুখের বিরক্তিভাব চলে যায়। কারণ সে তার গ্রামের অনেক কাহিনী জানে যা সে তার দাদা-দাদি, বাবা-মা আর ভাই-বোনদের কাছ থেকে শুনেছে। তার ধারণা প্রতিটি গ্রামের একটা নিজস্ব গল্প আছে। যেটা গ্রামের লোক বংশ পরম্পরায় বহন করে। মালেক হুজুর সেইসব গল্প থেকে বেরিয়ে আসা এক চরিত্র। তার বাড়িটা গ্রামের বিশেষ ঐতিহ্যমণ্ডিত।
জাকির হোসেনের ভিতরে মানুষের ইতিহাস, ঐতিহ্য, পরম্পরা ইত্যাদি বিষয় নিয়ে শুধু কৌতূহলই নয়, এক ধরনের নস্টালজিয়াও কাজ করে। সে অতীত মানুষকে সবসময় বর্তমানের ভেতর খুঁজে বেড়ায়। নানা রকম প্রত্ন নিদর্শন, আদি মানুষ তার প্রিয় বিষয়। মাঝে মাঝে তার মনে হয় পূর্ব জন্মে সে একজন জবরদসত ইতিহাসবেত্তা ছিল, তা না হলে ইতিহাস-ঐতিহ্য নিয়ে তার এতে মাথা ব্যথা কেন!
খোদানেওয়াজ খাঁ জাকির হোসেনের গ্রামের ইতিহাসের এক খল চরিত্র। তিনশ বছর আগে তার প্রেম হয়েছিল মোঘল ফৌজ আসমান সিং এর স্ত্রী দুর্গার সঙ্গে। আসমান সিং এর বাড়িটি কালের সাক্ষী হয়ে এখনও দাঁড়িয়ে আছে। জাকির হোসেন শৈশবে দাদার হাত ধরে আমিরাবাদের হাটে যাবার সময় বহুবার সেই বাড়িটি দেখেছে, যেটা এখন মালেক হুজুরের বাড়ি। কিন্তু আসমান সিং আর দুর্গার বাড়িটি গ্রামের ঠিক কোন জায়গায় ছিল সেটা জাকির হোসেন জানে না। গ্রামে লোকজনও ঠিকঠাক বলতে পারে না।
আসমান সিং খোদানেওয়াজ এবং দুর্গার প্রণয় কাহিনী জানতে পেরে একদিন সে তাদের হাতে-নাতে ধরার জন্য রুদ্ররোষে তরবারি উঁচিয়ে বাড়িতে প্রবেশ করে। কিন্তু সে খোদানেওয়াজকে ধরতে পারে না। সে জানালা দিয়ে পালিয়ে যায়। তখন আসমান সিং-এর সমসত ক্রোধ গিয়ে পড়ে দুর্গার উপর। সে দুর্গাকে খুন করতে উদ্যত হয়। তখন দুর্গা বিছানার কোলবালিশ সামনে ধরে, আসমান সিং কোলবালিশ কেটে ফেলে। উপায়নত না দেখে সে তার কোলের সনতান তরবারির সামনে মেলে ধরে। দু’টুকরো হয়ে যায়। এ ঘটনায় আসমান সিং সম্বিত ফিরে পায় এবং হতবিহ্বল হয়ে পড়ে। সে সুযোগ দুর্গা আতরক্ষার জন্য পালিয়ে খোদানেওয়াজের বাড়িতে যায় এবং তাকে নিয়ে স্বামীর বিরুদ্ধে ব্রিটিশ আদালতে সনতান হত্যার মামলা দায়ের করে। ব্রিটিশ আদালত আসমান সিং-এর ফাঁসির আদেশ দেয়। ফাঁসির আদেশ কার্যকর হওয়ার পরপরই দুর্গা খোদানেওয়াজের বাড়িতে গিয়ে ওঠে। কিন্তু খোদানেওয়াজ তাকে, ‘স্বামীঘাতিনী’ বলে তাড়িয়ে দেয়। এই ছিল মোটামুটি কাহিনী।
জাকির হোসেনের গ্রামের সব মানুষ এ কাহিনী জানে। খোদানেওয়াজ খাঁ মালেক হুজুরেরই পূর্ব পুরুষ। জাকির হোসেন মালেক হুজুরকে আপদমসতক নিরীক্ষণ করে তাকে হঠাৎ প্রশ্ন করা শুরু করে, যে রকম প্রশ্ন মালেক হুজুর তাকে করেছিল।
-খোদানেওয়াজ খাঁ আপনার কে হন?
-উনি আমার বংশের দশম পূর্ব পুরুষ।
-উনি আসলে কি করতেন?
মালেক হুজুর গর্ব ভরে উত্তর দেয়, উনি মঞ্জুশ্রী পরগনার জমিদার ছিলেন।
-ভাই আপনাম নাম কি? জাকির হোসেন মালেক হুজুরের নাম জিজ্ঞেস করে।
-কোন মাদ্রাসায় আছেন?
মালেক হুজুর মাদ্রাসার নাম বলে।
-ছেলেমেয়ে কটা?
-বাবা কি করেন?
-দাদা কি করতেন?
-চাকরি কবে হল?
-সাবজেক্ট কি…
জাকির হোসেন অসংখ্য প্রশ্নের মধ্য দিয়ে মালেক হুজুরের মধ্যে তার পূর্ব পুরুষ খোদানেওয়াজকে খুঁজে ফেরে। তখন তার একবারও মনে হয় না এভাবে ব্যক্তিগত প্রশ্ন করা মূর্খতা। সে বরং মালেক হুজুরকে এক পর্যায়ে নির্লজ্জের মতো জিজ্ঞেস করে, জনাব আপনি কি পরস্ত্রীর প্রতি কখনো আসক্ত হয়েছেন? মালেক হুজুর জাকির হোসেনের এই আহামমক মার্কা প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে সোজা হল থেকে বেরিয়ে যায়। বেরিয়ে যাবার সময় তাকে ভীষণ অপমানিত লাগছিল।
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।