হংপাল — অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর-পঞ্চম পর্ব

গল্পের শেষ অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন ।

স্বপন দেখেছে বলে উড়িয়ে দিলে। কিন্তু বুড়ি বলতে লাগল – “ওরে তোরা দেখে আয় না!”

সকালে সত্যি দেখা গেল চারটে ছানাকে নিয়ে কাঠবেরালি দুধ খাওয়াচ্ছে। এমন ঘটনা কেউ দেখেনি! সুরেশ্বরের মোহন্ত পর্যন্ত এই আশ্চর্য ঘটনা দেখতে হাতি চড়ে চাষার বাড়ি উপস্থিত! ওদিকে চাষার বৌ যত পিঠে সেদ্ধ করে, সবই পুড়ে ছাই হয়ে যায়, সুরেশ্বরের মালপোভোগও হয় না, তখন মোহন্ত পরামর্শ দিলেন – “ওই কাঠবেরালি নিশ্চয় সুরেশ্বরী, নয় আর-কোনো দেবী ওঁকে ছোনা-পোনা সুদ্ধ বন্ধ করেছে, হয়তো সুরেশ্বর তাই রাগ করেছেন।

না হলে মালপো-ভোগ পিঠে-ভোগ হঠাৎ পুড়েই বা যায় কেন? যাও, এখনি ওঁদের যেখানে বাসা, সেইখানে দিয়ে এস। না হলে আরো বিপদ ঘটতে পারে!”চাষা তো ভয়ে অস্থির! গ্রামসুদ্ধ কেউ আর খাঁচায় হাত দিতে সাহস পায় না। তখন সবাই মিলে দিদিমাকে সেই খাঁচা নিয়ে বনে কাঠবেরালির বাসায় পাঠিয়ে দিলে।

বুড়ি যেখানকার জিনিস সেখানে রেখে, আসবার সময় রাস্তায় একটা মোহর পেয়ে গেল। ‘যতো ধর্ম স্ততো জয়’ বলে খবরের কাগজের সম্পাদক খবরটা শেষ করলেন। এই বুড়ো-আংলাটি কিনি – লোকে তাই নিয়ে মাথা ঘামাতে লাগল সুরেশ্বরে, বাগবাজারে, ফরিদপুরে, যশোহরে, ময়মনসিংহে, আগরতলায়, আসামে, কাছাড়ে!

এই ঘটনার দুইদিন পরে আর এক কাণ্ড। গঙ্গা আর ব্রহ্মপুত্র যেখানে এক হয়েছে, সেইখানে আড়ালিয়ার চর। বুনো-হাঁসের সঙ্গে রিদয়কে নিয়ে খোঁড়া-হাঁস সেই চরে নামল।

চরটা কেবলি বালি, মাঝে মাঝে ছোট-ছোট ঝাউ, আর এখানে-ওখানে শুকনো ঘাস।

চরের একদিকে আড়ালিয়া গ্রাম। হাঁসরা চরছে, এমন সময় চরের উপরে কতকগুলো জেলের ছেলে খেলতে এল। মানুষ দেখেই চকা হাঁক দিলে, আর অমনি সব বুনো-হাঁস ডানা মেলে উড়ে পড়ল।

কিন্তু খোঁড়া-হাঁস ছেলে দেখে একটুও ভয় পেল না; বরং গলা চড়িয়ে বুনো-হাঁসদের বললে, “ছেলে দেখে ভয় কি?”রিদয় হাঁসের পিঠ থেকে নেমে একটা ঝাউতলায় বসে ঝাউফুল কুড়িয়ে মার্বেল খেলছে, ছেলেগুলো কাছে আসতেই সে একবার শিস দিয়ে খোঁড়াকে সাবধান করে একটা ঘাস-বনে লুকিয়ে পড়ল। কিন্তু খোঁড়ার আজ যে কি হল, সে যেমন চরছিল তেমনি চরে বেড়াতে লাগল।

ছেলেদুটো একটা বালির ঢিপি ঘুরে একেবারে দুদিক থেকে হাঁসকে তাড়া করলে। কেমন করে যে তারা এত কাছে হঠাৎ এসে পড়ল, ভেবে না পেয়ে খোঁড়া একেবারে হতভম্ব! উড়তে যে জানে তা মনেই এল না। সে ক্রমাগত দৌড়ে পালাবার চেষ্টা করতে লাগল। তারপর একটা ডোবার কাছে গিয়ে ধরা পড়ে গেল।

রিদয়ের প্রথমে মনে এল যে ছুটে গিয়ে ছেলে-দুটোকে থাবড়া মেরে হাঁসটা কেড়ে নেয়, কিন্তু তখনই মনে পড়ল, সে ছোট হয়ে গেছে! তখন সে রেগে বসে-বসে কেবলি বালি খুঁড়তে লাগল। এদিকে খোঁড়া ডাকছে – “বুড়ো-আংলা ভাই লক্ষ্মীটি, আমায় বাঁচাও।”

“ধরা পড়ে এখন বাঁচাও!” – বলে রিদয় ছেলে-দুটোর সঙ্গে দৌড়ল। ছেলে-দুটো হাঁস নিয়ে একটা নালা পেরিয়ে চর ছেড়ে গ্রামে ঢুকল।

রিদয় আর তাদের দেখতে পেলে না। নালায় অনেক জল। রিদয় অনেকটা ঘুরে তবে একটা শুকনো-গাছের ডাল বেয়ে ওপারে উঠে, হাঁসকে খুঁজতে মাটির উপর ছেলেদের পায়ের চিহ্ন ধরে এগিয়ে চলল।

একটা চৌমাথায় দেখা গেল, ছেলে-দুটো দুদিকে গেছে। কোন পথে যাওয়া যায়, রিদয় ভাবছে, এমন সময় বাঁকের রাস্তায় একটা হাঁসের পালক রয়েছে দেখে রিদয় বুঝলে হাঁস এই পথে গেছে – পালক ফেলতে-ফেলতে, যাতে সে সন্ধান পায় সেই জন্যে।

রিদয় পালকের চিহ্ন ধরে দুটো মাঠ পেরিয়ে গ্রামের একটা সরু গলি পেলে। গলির মোড়ে একটা মন্দির। হাঁস কোথায় দেখা নেই। মন্দিরের খিলানের উপর লেখা “হংসেশ্বরী”। আর তারি উপরে মাটির গড়া এক হাঁস।

গল্পের শেষ অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন ।

সম্পর্কিত পোস্ট

দুঃখিত!