হংপাল– অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর-৩য় পর্ব

গল্পের চতুর্থ অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন।

তার এত শত্রু আছে শুনে রিদয় ভাবলে, বাঁচা তো তাহলে শক্ত দেখছি। সে চকাকে বললে – “মরতে ভয় নেই। তবে শেয়াল-কুকুরের কিংবা শকুনের খাবার হতে আমি রাজী নই। এদের হাত থেকে বাঁচবার উপায় কিছু আছে বলতে পার?”চকা একটু ভেবে বললে – “বনের যত ছোট পাখি আর জন্তু এদের সঙ্গে ভাব করে ফেলবার চেষ্টা কর; তাহলে কাঠঠোকরা, ইঁদুর, কাঠবেরালি, খরগোস, তালচড়াই, বুলবুলি, টুনটুনি, শ্যামা, দোয়েল এরা তোমায় সময়-মতো সাবধান করে দেবে; লুকোবার জায়গাও দেখিয়ে দেবে। আর দরকার হয় তো এই সব ছোট জানোয়ারেরা তোমার জন্যে প্রাণও দিতে পারে।”

চকার কথা-মতো সেই দিনই রিদয় এক কাঠবেরালির সামনে উপস্থিত – ভাব করতে। যেমন দৌড়ে রিদয় সেদিকে যাওয়া, অমনি কাঠবেরালির গিয়ে গাছে ওঠা; আর ল্যাজ ফুলিয়ে কিচ-কিচ করে গালাগালি শুরু করা – “অত ভাবে আর কাজ নেই! তোমাকে চিনিনে? তুমি তো সেই আমতলির রিদয়!

কত পাখির বাসা ভেঙেছ, কত পাখির ছানা টিপে মেরেছ। ফাঁদ পেতে, ধামা চাপা দিয়ে কত কাঠবেরালি ধরে খাঁচায় পুরেছ, মনে নেই? এখন আমরা তোমায় বিপদ থেকে বাচাব?

এই ঢের যে বন থেকে আমরা এখনো তোমায় তাড়িয়ে মানুষের মধ্যে পাঠিয়ে দিচ্ছিনে! যাও, আমাদের দ্বারা কিছু হবে না। সরে পড় বাসার কাছ থেকে।”

অন্য সময় হলে রিদয় কাঠবেরালিকে মজা দেখিয়ে দিত! কিন্তু এখন সে ভালোমানুষ হয়ে গেছে; আস্তে-আস্তে হাঁসকে এসে সব খবর জানালে! খোঁড়া-হাঁস বললে – “অত দৌড়ে কাঠবেরালির কাছে যাওয়াটা ভালো হয়নি।

হঠাৎ কিছু একটা এসে পড়লে সব জানোয়ারই ভয় পায়, রাগ করে। যখন জানোয়ারদের কাছে যাবে – সহজে, আস্তে ভদ্রভাবে যাবে। তোমার স্বভাব একটু ভালো হয়ে এসেছে; এমনি আর দিনকতক ভালোমানুষটি থাকলেই, ওরা আপনি তোমার সঙ্গে ভাব করবে। তুমি যদি তাদের উপকার কর, তবে তারাও তোমার সহায় হবে – বনের এই নিয়ম জেনে রাখ।”

রিদয় সারাদিন ভাবছে, কেমন করে সে বনের পশু-পাখিদের কাজে লাগতে পারে, এমন সময় খবর হল, বেতগাঁয়ের একটা চাষা কাঠবেরালের বৌকে ধরে খাঁচায় বন্ধ করেছে; আর সে বেচারার আটদিনের বাচ্চাগুলি না খেয়ে মরবার দাখিল!

খোঁড়া-হাঁস রিদয়কে বললে – “দেখ, যদি কাঠবেরালির উপকার করতে চাও তো এই ঠিক সময়।” রিদয় অমনি কোমর-বেঁধে সন্ধানে বেরুল।

লক্ষ্মীবার পিঠে পার্বণের দিন কাঠবেরালের বৌ চুরি হল সুরেশ্বরে, আর শনিবার বাগবাজারে ছাপার কাগজে বার হল সেই খবর। কাগজওয়ালা ছোঁড়াগুলো গলিতে-গলিতে হেঁকে চলল –

কাণ্ডটা হয়েছিল এইঃ কাঠবেরালের বৌটি ছিল একেবারে শাদা ধপ-ধপে; তার একটা রোঁয়াও কালো ছিল না! চোখ-দুটি মানিকের মতো লাল টুকটুকে, পা-গুলি গোলাপী, এমন কাঠবেরালি আলিপুরেও নেই।

এ এক নতুনতর ছিষ্টি! গাঁয়ের ছেলে-বুড়ো, রেল-কোম্পানীর সায়েব-সুবো তাকে ধরতে কত ফাঁদই পেতেছে, কিন্তু এ পর্যন্ত কাঠবেরালি ধরা দেয়নি।

পোষ পার্বণের দিন বাদামতলী দিয়ে আসতে-আসতে এক চাষা এই কাঠবেরালিকে টোকা চাপা দিয়ে হঠাৎ কেমন করে পাকড়াও করে ঘরে এনে একটা বিলিতি ইঁদুরের খাঁচায় বন্ধ করলে। পাড়ার লোক – ছেলে-বুড়ো, এই আশ্চর্য কাঠবেরালি দেখতে দলে-দলে ছুটে এল। এক ডোম তার জন্যে এক চমৎকার খাঁচা-কল তৈরী করে এনে দিলে। খাঁচার মধ্যে শোবার খাট, দোলবার দোলনা, দুধের বাটি, খাবার খৈ রাখবার ঝাঁপি, বসবার চৌকি – এমনি সব ঘর-কন্নার ছোট-ছোট সামগ্রী দিয়ে সাজানো।

গল্পের চতুর্থ অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন।

সম্পর্কিত পোস্ট

দুঃখিত!