স্বার্থপর—আমিনুল ইসলাম হুসাইনী

দুপুরে সূর্যটা যখন তার প্রখর তাপে আনল বর্ষিত করে বোবা প্রাণী গুলো যখন পিপাসায় কাতর হয়ে জিহবা বের করে ‘হা’ করে থাকে তখন হেলালেরও পিপাসায় কলজে শুকিয়ে যায়। শরফত আলীর গরুগুলোর সাথে দৌড়াতে হয় হেলালকে। শরফত আলীর বাড়িতে হেলাল বদলি খাটে। সেই ভোরে ঘুম থেকে উঠে নিজের জরুরত শেষ করে কাজে লেগে যায় হেলাল। গরু বাছুর বের করা, গোয়াল পরিষ্কার করা, ঘাস কাটতে যাওয়া, ঘাস ধোয়া তারপর গোসল করে সামান্য পান্তা আর দু’টো কাঁচা মরিচ খাওয়া শেষে গরুগুলো নিয়ে মাঠে যাওয়া। সারাদিন রোদে পুড়ে সন্ধ্যায় ফেরা। আরেকবার গোসল করে শাক পাতা দিয়ে গরম গরম এক থালা ভাত দিয়ে ক্ষুধা নামক দৈত্যকে সান্ত্বনা দেয়া। তারপর আবার গোয়ালে ধোয়া দেয়া, গরু বাছুর গোয়ালে বাধা। সব শেষে হাত মুখ দুয়ে ছেড়া কাঁথাটা বিছিয়ে শুয়ে পড়া।

প্রতিদিনের মতো আজও সব কাজ শেষ করে হেলাল শুয়ে পরে। কিন্তু ঘুম আসছেনা চোখে। হেলালের চোখে ভাসতে থাকে সেদিনের দৃশ্যটি। যেদিন তার ছোট ভাই দুলাল কাঁদতে কাঁদতে তার কাছে এসেছিল। হেলাল জিজ্ঞাসা করলঃ

কান্দস ক্যান, কি অয়ছে?

জমির জেডা আমারে আর রাখবনা, কান্না থামিয়ে বলল দুলাল।

ক্যান তুইকি ঠিক মতন কাম করছ নাই?

সারাদিন গরুর মতন খাটি, কত্ত বড় বড় ফোজা (বোঝা) লয়। মনে অয় মাটির নিচে ডুইকা যাইতাছি।

তায়লে আর রাখবনা কেন?

হেরা কয় আমি বলে বেশি ভাত খাই। দুলাল কাঁদতে থাকে। হেলালও কিছু বলতে পারলনা। বাধ ভাঙ্গা ঢেউয়ের মতো চোখ দিয়ে নেমে আসে কষ্টের অশ্রু। কিছুদিন পর হেলাল তার জমানো টাকা গুলো দিয়ে পাশের গ্রামের স্কুলে দুলালকে ভর্তি করে দেয়। সেদিন থেকে হেলালের কষ্ট আরো বেড়ে যায়। বাড়তি ক’টা টাকার জন্য বাড়তি কাজ করতে হয় হেলালকে। তবুও কোন কষ্টই যেন নেই তার। শত কষ্টের মাঝেও দুলালের মধ্য দিয়ে হেলাল খুঁজতে থাকে আশার আলো, বুনে যায় হাজারো রঙ্গিন স্বপ্ন।

*   *   *

হেলাল এখন বাইশ বছরের যুবক।

তার অমায়িক ব্যবহারে গ্রামের সবাই মুগ্ধ। শরফত আলী হেলালকে কাছে বসিয়ে বলল- রাক্ষুসী নদী তোর বাপ মারে খাওয়ার পর থেইকা আত্মীয় স্বজন আর কেউ রইল না তোর। এত বছর আমার বাড়িতে কামলা খাটছ, কোন দিন কোন বেয়াদবি দেখিনায়। তোর মতন পুলা পাওয়া বড় কপালের দরকার। তোর বাপ মা নাই তায় কথাডা আমারে কইতে হইতাছে। আমি জানি তুই আমার কথা ফালাইবিনা। আর সমন্দডাও ভালা। মাইয়া দেখবার মতন। বাপ মা মরা মাইয়া তয় একখান বসত বাড়ি আর একখানি ক্ষেত আছে।

কাহা আফনে কারকথা কন?

পাত্রি আমাগো গাঁয়ের তাহের মুন্সির মাইয়া সালেহা।

সালেহা!

হ, তুমি যদি রাজি থাহ তায়লে আমি পাকা কথা দিতাম?

কিন্তু কাহা আমার চালচুলা কিচ্ছু নাই খাওয়ামু কি আর বা থামু কই?

বলদ কোনানের, কইলাম না মাইয়ার বসত বাড়ি আর মেঘনার পাড়ের….. আর বলতে পারলনা। শরফত আলী হেলালের মলিন মুখটার দিকে তাকিয়ে ফ্যাকাশে হয়ে যায় তার চেহারা।

মেঘনা এই নামটি শুনলেই হেলালের হৃদয়ে বয়ে চলে সিডরের তান্ডব, ক্ষত বিক্ষত হয়ে যায় তার বুকের মধ্য খানটি। এই রাক্ষুসী নদীটাই হেলালের সবকিছু খেয়েছে। বাবা-মা, আদরের একমাত্র বোন তাসলিমা। শুধু হেলালেরই নয় তাদের মতো আর ত্রিশ চল্লিশটি পরিবারকে খেয়েছে এই স্বার্থপর নদী। তবুও তার ক্ষুধা মিটেনি এখনও খেয়ে চলছে অবিরাম। আজ এ বাড়ি তো কাল ঐ ফসলি ক্ষেত। একের পর এক খেয়ে চলছে।

তোর কি এই সম্বন্ধে অমত আছে? হেলালকে জিজ্ঞাসা করে শরফত আলী।

কাহা বাপ মা মরণের পর থেইক্কা আপনে আমারে খাওয়াইয়া পরাইয়া বাছাইয়া রাখছেন, বাপ মার আদর দিয়া বড় করছেন আফনের কথা আমি কেমনে ফালাই? তয় একখান কথা।

কি কথা? শরফত আলীর জিজ্ঞাসু দৃষ্টি পড়ে হেলালের উপর।

সামনে দুলালের পরীক্ষা। দুলালই আমার স্বপ্ন। অরে লইয়াই আমার যত আনন্দ আয়োজন। এহন জদি এইসব জামেলা হয় তায়লে দুলালের পড়া লেহায় ক্ষতি হইতে পারে। তাছারা টেহা পয়সাও যোগান যাইবনা সময় মতন। হেলাল তুই খুবই সরল মানুষ। কিন্তু আইজ কাইল সরলের দাম নাই। দুনিয়াডা যে বড়ই স্বার্থপররে, হেলাল বড়ই স্বার্থপর।

*   *   *

দেখতে দেখতে সবক’টি পরীক্ষা শেষ হয় দুলালের। শরফত আলী ব্যস্ত হয়ে উঠে হেলালের বিয়ের কাজে। নির্ধারিত তারিখে সম্পন্ন হল হেলাল আর সালেহার বিয়ে। সালেহার বাড়িতেই হেলালের নতুন জীবনের প্রথম রাতটি কাটে। বিয়ের ক’টা দিন ভালই কাটতে লাগল। সালেহা ব্যস্ত হয়ে পড়ে ছোট্ট সংসারটি সাজাতে।

একদিন বের হয় দুলালের পরীক্ষার ফলাফল। জিপিএ-৫ (এ+) পেয়েছে দুলাল। হেলালের যে আজ কি আনন্দ সাধ্যনুযায়ী পাড়া পড়শীদের মিষ্টি মুখ করায়। মসজিদে দোয়াও পড়ায়। দুলালকে কলেজে ভর্তি করাতে প্রয়োজন দশ বারো হাজার টাকা। কিন্তু এত টাকা যোগান দেয়া হেলালের পক্ষে অসম্ভব। টাকা না হলে ভাইকে উচ্চ শিক্ষিত করা যাবেনা ভাবতেই হেলালের বুকটা কেঁপে উঠে। সারাদিনের কাজ শেষে বিষণ্ণ মন নিয়ে হেলাল বিছানায় শুয়ে পড়ে। হেলালের মলিন চেহারাটা দেখে সালেহা জিজ্ঞাসা করে-

শরীর খারাব?

না।

তায়লে?

মনডা ভালা না।

কেন, কি অয়ছে?

দশ বারো হাজার টাকা না অইলে হেলালরে কলেজে ভর্তি করান যাইবনা। কিন্তু এত টাকা পামু কই?

যদি কিছু মনে না করেন একটা কথা কমু?

কি কইবা, কও।

কইছিলামকি আমার কানের দুল দুইডা বেইছা যদি কিছু একটা করেন তায়লেইতো আর কোন চিন্তা থাকল না।

না, না না এইডা হয়বার পারে না।

আমি কি তারপর?

আমি কি তা কইছি?

যেদিন আল্লাহ্র হুকুমে আফনারে কবুল করছি হেই দিন থেইক্কা আফনার সব সুখ-দুঃখ আমি ভাগ কইরা লইছি। আফনার কষ্ট মানে আমার কষ্ট, আফনার সুখই আমার সুখ। সালেহা কথাগুলো বলে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে।

হেলাল সালেহাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল-

ঠিক আছে তোমার কথায় রইল এহন কান্দন থামাও।

হেলাল সালেহার চোখের পানি হাত দিয়ে মুছে দেয়।

*   *   *

দশ বছর পর।

দুলাল এখন শহরে ভাল চাকরি করে। সেলারিও পায় ভাল। ছয় মাস যেতেই দুলালের কাজে খুশি হয়ে মালিক তাকে ম্যানেজারের চেয়ারে বসিয়ে দেয়। চেয়ার বদল হওয়ার সাথে সাথে দুলালও যেন বদলে গেছে অনেক খানি। সারাক্ষণ সাহেবি মেজাজ। কর্মচারিদের সাথে যা’তা ব্যবহার করে। খেটে খাওয়া দরিদ্রদের একদম সহ্য করতে পারে না। চার বছর হল বাড়িতে ভাই ভাবীরও কোন খোঁজ খবর রাখেনি। একবার একটা চিঠি এসেছিল। হেলাল লিখেছিল অনেক দিন তাকে না দেখে বুকটা খা খা করছে। খুব দেখতে ইচ্ছে করছে। সালেহার শরিরটাও ভাল না। টাকার অভাবে ভাল ডাক্তার দেখাতে পারছেনা। তবুও কিছুই চাইনা তাদের শুধু একবার ছোট ভাইটাকে দেখতে চাই। কেমন লাগছে সাহেবি বেশে ভাইকে। হেলালের স্বপ্ন কি তবে সত্যি হল? দুলাল চিঠির উত্তর দেয়নি কোন খোঁজ খবরও নেইনি। মালিক আফজাল সাহেব তার একমাত্র মেয়ে নাজমুনকে দিয়ে কিনে নেই দুলালকে। বসুন্ধরায় একটি বাড়ি রেখেদেয়। বিয়ের উপহার হিসেবে একটি দামী কালো জীপ দেয় দুলাল ও নাজমুনকে। দুলালতো এখন সত্যিই সাহেব। কি নেই তার? গাড়ি-বাড়ি সুন্দরী বধূ। কি প্রয়োজন গ্রামের ঐ মাটির ঘরের কথা ভাববার, আর সেই সময় বা কোথায়? তবে নাজমুন কিন্তু তার মত নয়। সে সোনার চামচ নিয়ে জন্মালেও হৃদয়টা তার বিশাল পাহাড়ের মতো, সাগরের মতো গভীর। নাজমুন প্রায় সময় দুলালকে বলেছে তার গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যেতে। কিন্তু দুলাল নানা কথায় পাশ কাটিয়ে গেছে। কখনো বলেছে গ্রামে এসি নেই, ফ্রিজ নেই, গোসল করতে হয় নদীর নোংরা জলে, আর কতসব।

যে ধূলোয় গড়াগড়ি করে বড় হয়েছ সে নদীর পানি খেয়ে প্রাণ বাঁচিয়েছ সেখানে মিশে আছে তোমার মা বাবার স্মৃতি সেই গ্রাম, মাটি, নদীকে নোংরা বলতে লজ্জা হয় না?

মনে রেখ ময়ুরের পালক দিয়ে গা ঢাকলে যেমন কাক কোনদিন ময়ুর হয় না তেমনি দামি দামি পোষাক পরলে গাড়িতে চড়লে ভদ্র লোক হওয়া যায়না। বড় লোক হওয়া যায় না। বড় লোকতো সেই যার হৃদয়টা হিমালয়ের মতো বিশাল।

*   *   *

গ্রামের কাঁচা রাস্তাটি ধরে এগিয়ে চলছে ঢাকা থেকে আসা দুলাল ও নাজমুনের কালো রঙের গাড়িটি। কিছুদূর আসার পরই গাড়ি সামনে এগুতে পারছে না। রাস্তায় মানুষের ভিড়। কারো হাতে বাঁশ, কারো হাতে কোদাল আবার কারো কাছে জ্বলন্ত আগরবাতি। ওরা সবাই এগিয়ে চলছে। ওদের মধ্যখানে মাথার উপর দু’টি খাটিয়া দেখা যায়। গাড়ির ভেতর কালো গ্লাস দিয়েত দেখেও চিনতে কষ্ট হয়নি দুলালের। এ খাট দু’টি যে তার অতি পরিচিত। এই খাট দু’টি দিয়েই কবরস্থানে নিয়ে যাওয়া হয়েছে তার বাবা মাকে।

সেদিন দুলাল খুব ছোট থাকলেও এ দৃশ্যটি এখনো ভুলেনি।

ড্রাইবার হরর্ণ বাজালে কয়েক জন লোক ফিরে তাকায়, দুলাল জানালার গ্লাস নিচে নামিয়ে লোকদের জিজ্ঞাসা করে-

কে মারা গেছে?

একজন বৃদ্ধ এগিয়ে এসে বলল,

কাইল রাইতে রাক্ষুসী নদী তাদের বাড়িঘর খায় এতেও তার ভুখ মিটলনা বইলা জামায় বৌ দুইডারে খাইল। আহারে এতিম মাইয়াডা কার কাছে যাইব?

রাক্ষুসী মেঘনা এইডাও বুজলিনা।

কার কথা বলছেন?

মেঘনা পাড়ের হেলাল মিয়া আর তার বৌ সালেহা। এতিম মাইয়া সামিয়া কই যাইব এহন। হনছি দুলাল নামে একটা কাহা আছিল। জানেন স্যার, দুলালরে শিক্ষিত বানানের লাইগা সারা জীবনের সব টেহা পয়সা খরচ করছে। নিজের লাইগা কিছুই রাহেনায়। কিন্তু দুলাল ফিরাও তাকাইলনা। আহারে এতিম মাইয়াডা কার কাছে যাইব। দুলালের শরির যেন পাথরের মূর্তিতে রূপান্তিরিত হয়েছে। চোখ দু’টি দিয়ে বয়ে চলে নোনা পানি। গাড়ি থেকে নাজমুন সব শুনছিল। শত বাধা দিয়েও থামাতে পারেনি তার বাধ ভাঙ্গা চিৎকার। নাজমুনের চিৎকারে সবায় ফিরে তাকায়। নাজমুন দুলালকে গাড়ি থেকে নামায়। দুলালকে দেখে গ্রামের সবাই চমকে উঠলেও খুশি হয়নি কেউ। একজন বৃদ্ধা সামিয়াকে নিয়ে নাজমুনের সামনে এসে বলল-

তুমি কি দুলালের বৌ?

জি, নাজমুনের জবাব।

এই হইল হেলালের মাইয়া সামিয়া। বৃদ্ধা মহিলা দুলালকে দেখিয়ে সামিয়াকে বলল- এইডা হয়ল তোর দুলাল কাহা। সামিয়া দুলালের দিকে তাকিয়ে বলে-

না, কাহানা স্বার্থপর।

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

দুঃখিত!