স্বামী– শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় –অষ্টম অংশ

বললুম, মাথাধরা আমার ছেড়ে গেছে, আর ঘুমোবো না।

তিনি বললেন, তবে সবুর কর, ওষুধটা তোমার কপালে লাগিয়ে দিই, বলে উঠে গিয়ে কি একটা নিয়ে এসে ধীরে ধীরে আমার কপালে ঘষে দিতে লাগলেন। আমি ঠিক ইচ্ছে করেই যে করলুম, তা নয়, কিন্তু আমার ডান হাতটা কেমন করে তাঁর কোলের ওপর গিয়ে পড়তেই তিনি একটা হাত দিয়ে সেটা ধরে রাখলেন। হয়ত একবার একটু জোর করেও ছিলুম। কিন্তু জোর আপনিই কোথায় মিলিয়ে গেল। দুরন্ত ছেলেকে মা যখন কোলে টেনে নিয়ে জোর করে ধরে রাখেন, তখন বাইরে থেকে হয়ত সেটাকে একটুখানি অত্যাচারের মতও দেখায়, কিন্তু সে অত্যাচারের মধ্যে শিশুর ঘুমিয়ে পড়তে বাধে না।

বাইরের লোক যাই বলুক, শিশু বোঝে, ওটাই তার সবচেয়ে নিরাপদ স্থান। আমার এই জড়পিণ্ড হাতটারও বোধ করি সে জ্ঞানই ছিল, নইলে কি করে সে টের পেলে, নিশ্চিন্ত নির্ভয়ে পড়ে থাকবার এমন আশ্রয় তার আর নাই!

তারপর তিনি আস্তে আস্তে আমার কপালে হাত বুলোতে লাগলেন, আমি চুপ করে পড়ে রইলুম। আমি এর বেশি আর বলব না। আমার সেই প্রথম রাত্রির আনন্দ-স্মৃতি—সে আমার, একেবারে আমারই থাক।

কিন্তু আমি ত জানতুম, ভালবাসার যা-কিছু সে আমি শিখে এবং শেষ করে দিয়ে শ্বশুরবাড়ি এসেছি। কিন্তু সে শেখা যে ডাঙ্গায় হাত-পা ছুঁড়ে সাঁতার শেখার মত ভুল শেখা, এই সোজা কথাটা সেদিন যদি টের পেতাম! স্বামীর কোলের উপর থেকে আমার হাতখানা যে তার সর্বাঙ্গ দিয়ে শোষণ করে এই কথাটাই আমার বুকের ভেতর পৌঁছে দেবার মত চেষ্টা করছিল, এই কথাটাই যদি সেদিন আমার কাছে ধরা পড়ত!

সকালে ঘুম ভেঙ্গে দেখলুম স্বামী ঘরে নেই, কখন উঠে গেছেন। হঠাৎ মনে হল স্বপ্ন দেখিনি ত? কিন্তু চেয়ে দেখি, সেই ওষুধের শিশিটা তখনও শিয়রের কাছে রয়েছে। কি যেন মনে হল, সেটা বার বার মাথায় ঠেকিয়ে তবে কুলুঙ্গিতে রেখে বাইরে এলুম।

শাশুড়ীসঠাকরুন সেইদিন থেকে আমার উপর যে কড়া নজর রাখছিলেন, সে আমি টের পেলুম। আমিও ভেবেছিলুম, মরুক গে, আমি কোন কথায় আর থাকব না। তা ছাড়া দু’দিন আসতে না আসতেই স্বামীর খাওয়া-পরা নিয়ে ঝগড়া—ছি ছি, লোকে শুনলেই বা বলবে কি?

কিন্তু কবে যে এর মধ্যেই আমার মনের ওপর দাগ পড়ে গিয়েছিল, কবে যে তাঁর খাওয়া-পরা নিয়ে ভিতরে ভিতরে উৎসুক হয়ে উঠেছিলুম সে আমি নিজেই জানতুম না! তাই দুটো দিন যেতে-না-যেতেই আবার একদিন ঝগড়া করে ফেললুম।

আমার স্বামীর কে একজন আড়তদার বন্ধু সেদিন সকালে মস্ত একটা রুইমাছ পাঠিয়েছিলেন, স্নান করতে পুকুরে যাচ্ছি, দেখি, বারান্দার ওপর সবাই জড় হয়ে কথাবার্তা হচ্ছে। কাছে এসে দাঁড়ালুম, মাছ কোটা হয়ে গেছে। মেজজা তরকারি কুটচেন, শাশুড়ি বলে বলে দিচ্ছেন, এটা মাছের ঝোলের কুটনো, ওটা মাছের ডালনার কুটনো, ওটা মাছের অম্বলের কুটনো, এমনই সমস্তই প্রায় আঁশ-রান্না। আজ একাদশী, তাঁর এবং বিধবা মেয়ের খাবার হাঙ্গামা নেই, কিন্তু আমার স্বামীর জন্যে কোন ব্যবস্থাই দেখলুম না। তিনি বৈষ্ণবমানুষ, মাছ-মাংস ছুঁতেন না।

একটু ডাল, দুটো ভাজাভুজি, একটুখানি অম্বল হলেই তাঁর খাওয়া হত। অথচ ভাল খেতেও তিনি ভালবাসতেন। এক-আধদিন একটু ভাল তরকারি হলে তাঁর আহ্লাদের সীমা থাকত না, তাও দেখেচি।

বললুম, ওঁর জন্যে কি হচ্ছে মা?

শাশুড়ি বললেন, আজ আর সময় কৈ বৌমা? ওর জন্যে দুটো আলু-উচ্ছে ভাতে দিতে বলে দিয়েচি, তার পর একটু দুধ দেব’খন।

বললুম, সময় নেই কেন মা?

শাশুড়ি বিরক্ত হয়ে বললেন, দেখতেই তো পাচ্ছ বৌমা! এতগুলো আঁশ-রান্না হতেই ত দশটা-এগারোটা বেজে যাবে। আজ আমার অখিলের (মেজদেওর) দু-চার জন বন্ধুবান্ধব খাবে, তারা হল সব অপিসার মানুষ, দশটার মধ্যে খাওয়া না হলে পিত্তি পড়ে সারাদিন আর খাওয়াই হবে না। এর উপর আবার নিরামিষ রান্না করতে গেলে ত রাঁধুনী বাঁচে না। তার প্রাণটাও দেখতে হবে বাছা!

রাগে সর্বাঙ্গ রি-রি করে জ্বলতে লাগল। তবু কোনমতে আত্মসংবরণ করে বললুম, শুধু আলু-উচ্ছে-ভাতে দিয়ে কি কেউ খেতে পারে? একটুখানি ডাল রাঁধবার কি সময় হত না?

তিনি আমার মুখের পানে কটমট করে চেয়ে বললেন, তোমার সঙ্গে তক্ক করতে পারিনে বাছা, আমার কাজ আছে।

এতক্ষণ রাগ সামলেছিলুম, আর পারলুম না। বলে ফেললুম, কাজ সকলেরি আছে মা! তিনি তিরিশ টাকার কেরানীগিরি করেন না বলে, কুলি-মজুর বলে তোমরা তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করতে পারো। কিন্তু আমি ত পারিনে। আমি ওই দিয়ে তাঁকে খেতে দেব না। রাঁধুনী রাঁধতে না পারে, আমি যাচ্ছি।

শাশুড়ি খানিকক্ষণ অবাক হয়ে আমার মুখের পানে চেয়ে থেকে বললেন, তুমি ত কাল এলে বৌমা, এতদিন তার কি করে খাওয়া হত শুনি?

বললুম, সে খোঁজে আমার দরকার নেই। কিন্তু কাল এলেও আমি কচি খুকী নই মা! এখন থেকে সে-সব হতে দিতে পারব না। রান্নাঘরে ঢুকে রাঁধুনীকে বললুম, বড়বাবুর জন্যে নিরামিষ ডাল, ডালনা, অম্বল হবে। তুমি না পার, একটা উনুন ছেড়ে দাও, আমি এসে রাঁধচি, বলে আর কোন তর্কাতর্কির অপেক্ষা না করে স্নান করতে চলে গেলুম।

স্বামীর বিছানা আমি রোজ নিজের হাতেই করতুম। এই ধপধপে সাদা বিছানাটার উপর ভেতরে ভেতরে যে একটা লোভ জন্মাচ্ছিল, হঠাৎ এতদিনের পর আজ বিছানা করবার সময় সে কথা জানতে পেরে নিজের কাছেই যেন লজ্জায় মরে গেলুম।

ঘড়িতে বারোটা বাজতে তিনি শুতে এলেন। কেন যে এত রাত পর্যন্ত জেগে বসে বই পড়ছিলুম, তাঁর পায়ের শব্দ সে খবর আজ এমনি স্পষ্ট করে আমার কানে কানে বলে দিল যে, লজ্জায় মুখ তুলে চাইতেও পারলাম না।

স্বামী বললেন, এখনো শোওনি যে?

আমি বই থেকে মুখ তুলে ঘড়ির পানে তাকিয়ে যেন চমকে উঠলুম—তাইত, বারোটা বেজে গেছে।

কিন্তু যিনি সব দেখতে পান, তিনি দেখেছিলেন, আমি পাঁচ মিনিট অন্তর ঘড়ি দেখেচি।

স্বামী শয্যায় বসে একটু হেসে বললেন, আজ আবার কি হাঙ্গামা বাধিয়েছিলে?

গল্পের নবম অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন

সম্পর্কিত পোস্ট

দুঃখিত!