সে — রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর– চর্তদশ অংশ

ঝগড়ুকে বললেম , কোথায় আছে সেই বাঁদরটা । যেখানে পাও বোলাও উস্‌কো ।

এল সে তার কাঁটাওয়ালা মোটা গোলাপের গুঁড়ির লাঠিখানা ঠক্‌ঠক্‌ করতে করতে । মালকোঁচা – মারা ধুতি , চাদরখানা জড়ানো কোমরে , হাঁটু পর্যন্ত কালো পশমের মোটা মোজা , লাল ডোরা – কাটা জামার উপর হাতাহীন বিলিতি ওয়েস্টকোট সবুজ বনাতের , সাদা রোঁয়াওয়ালা রাশিয়ান টুপি মাথায় — পুরোনো মালের দোকান থেকে কেনা — বাঁ হাতের আঙুলে ন্যাকড়া জড়ানো — কোনো একটা সদ্য অপঘাতের প্রত্যক্ষ সাক্ষী । কড়া চামড়ার জুতোর মস্‌মসানি শোনা যায় গলির মোড় থেকে । ঘন ভুরুদুটোর নীচে চোখদুটো যেন মন্ত্রে – থেমে – যাওয়া দুটো বুলেটের মতো ।

বললে , হয়েছে কী । শুকনো মটর চিবোচ্ছিলুম দাঁত শক্ত করবার জন্যে , ছাড়ল না তোমার ঝগড়ু । বললে , বাবুর চোখদুটো ভীষণ লাল হয়েছে , বোধ হয় ডাক্তার ডাকতে হবে । শুনেই তাড়াতাড়ি গয়লাবাড়ি থেকে এক – ভাঁড় চোনা এনেছি মোচার খোলায় করে ফোঁটা ফোঁটা ঢালতে থাকো , সাফ হয়ে যাবে চোখ ।

আমি বললুম , যতক্ষণ তুমি আছ আমার ত্রিসীমানায় , আমার চোখের লাল কিছুতেই ঘুচবে না । ভোরবেলাতেই তোমাদের পাড়ার যত মাতব্বর আমার দরজায় ধন্না দিয়ে পড়েছে ।

বিচলিত হবার কী কারণ ।

তুমি থাকতে দোসরা কারণের দরকার নেই । খবর পাওয়া গেল , তোমার চেলা কংসারি মুন্সি , যার মুখ দেখলে অযাত্রা , তোমার ছাদে বসে একখানা রামশিঙে তুলে ধরে ফুঁক দিচ্ছে ; আর গাঁজার লোভ দেখিয়ে জড়ো করেছ যত ফাটা – গলার ফৌজ , তারা প্রাণপণে চেঁচানি অভ্যেস করছে । ভদ্রলোকেরা বলছে , হয় তারা ছাড়বে পাড়া নয় তোমাকে ছাড়াবে ।

মহা উৎসাহে লাফ দিয়ে উঠে সে চীৎকারস্বরে বললে , প্রমাণ হয়েছে !

কিসের প্রমাণ ।

বেসুরের দুঃসহ জোর । একেবারে ডাইনামাইট । বদ্‌সুরের ভিতর থেকে ছাড়া পেয়েছে দুর্জয় বেগ , উড়ে গিয়েছে পাড়ার ঘুম , দৌড় দিয়েছে পাড়ার শান্তি , পালাই – পালাই রব উঠেছে চার দিকে । প্রচণ্ড আসুরিক শক্তি । এর ধাক্কা একদিন টের পেয়েছিলেন স্বর্গের ভালো – মানুষরা । বসে বসে আধ চোখ বুজে অমৃত খাচ্ছিলেন । গন্ধর্ব ওস্তাদের তম্বুরা ঘাড়ে অতি নিখুঁত স্বরে তান লাগাচ্ছিলেন পরজ – বসন্তে , আর নূপুরঝংকারিণী অপ্সরীরা নিপুণ তালে তেহাই দিয়ে নৃত্য জমিয়েছিলেন । এ দিকে মৃত্যুবরণ নীল অন্ধকারে তিন যুগ ধরে অসুরের দল রসাতল – কোঠায় তিমিমাছের লেজের ঝাপ্‌টায় বেলয়ে বেসুর সাধনা করছিল । অবশেষে একদিন শনিতে কলিতে মিলে দিলে সিগ‍্নাল , এসে পড়ল বেসুর – সংগতের কালাপাহাড়ের দল সুরওয়ালাদের সমে – নাড়া – দেওয়া ঘাড়ে হুংকার ক্রেংকার ঝন্‌ঝন্‌কার ধ্রুম‍্কার দুড়ুমকার গড় – গড়্‌গড়ৎকার শব্দে । তীব্র বেসুরের তেলেবেগুনি জ্বলনে পিতামহ – পিতামহ ডাক ছেড়ে তাঁরা লুকোলেন ব্রহ্মাণীর অন্দরমহলে । তোমাকে বলব কী আর , তোমার তো জানা আছে সকল শাস্ত্রই ।

জানা যে নেই আজ তা বোঝা গেল তোমার কথা শুনে ।

দাদা , তোমাদের বই – পড়া বিদ্যে , আসল খবর কানে পৌঁছয় না । আমি ঘুরে বেড়াই শ্মশানে মশানে , গূঢ়তত্ত্ব পাই সাধকদের কাছ থেকে । আমার উৎকটদন্তী গুরুর মুখকন্দর থেকে বেসুরতত্ত্ব অল্প কিছু জেনেছিলুম , তাঁর পায়ে অনেকদিন ভেরেণ্ডার বিরেচক তৈল মর্দন ক’রে ।

বেসুরতত্ত্ব আয়ত্ত করতে তোমার বিলম্ব হয় নি সেটা বুঝতে পারছি । অধিকারভেদ মানি আমি ।

দাদা , ঐ তো আমার গর্বের কথা । পুরুষ হয়ে জন্মালেই পুরুষ হয় না , পরুষতার প্রতিভা থাকা চাই । একদিন আমার গুরুর অতি অপূর্ব বিশ্রীমুখ থেকে —

গুরুমুখকে আমরা বলে থাকি শ্রীমুখ , তুমি বললে বিশ্রীমুখ !

গুরুর আদেশ । তিনি বলেন , শ্রীমুখটা নিতান্ত মেয়েলি , বিশ্রী মুখই পুরুষের গৌরব । ওর জোরটা আকর্ষণের নয় , বিপ্রকর্ষণের । মান কি না ।

মানতে যে হতভাগ্য বাধ্য হয় সে মানে বই কি ।

মধুর রসে তোমার মৌতাত পাকা হয়ে গেছে দাদা , কঠোর সত্য মুখে রোচে না , ভাঙতে হবে তোমাদের দুর্বলতা — মিঠে সুরে যার নাম দিয়েছ সুরুচি , বিশ্রীকে সহ্য করবার শক্তি নেই যার ।

দুর্বলতা ভাঙা সবলতা ভাঙার চেয়ে অনেক শক্ত । বিশ্রীতত্ত্বর গুরুবাক্য শোনাতে চাচ্ছিলে , শুনিয়ে দাও ।

একেবারে আদিপর্ব থেকে গুরু আরম্ভ করলেন ব্যাখ্যান । বললেন , মানবসৃষ্টির শুরুতে চতুর্মুখ তাঁর সামনের দিকের দাড়ি – কামানো দুটো মুখ থেকে মিহি সুর বের করলেন । কোমল রেখাব থেকে মধুর ধারার মসৃণ মিড়ের উপর দিয়ে পিছলে গড়িয়ে এল কোমল নিখাদ পর্যন্ত । সেই সুকুমার স্বরলহরী প্রত্যুষের অরুণবর্ণ মেঘের থেকে প্রতিফলিত হয়ে অত্যন্ত আরামের দোলা লাগালো অতিশয় মিঠে হাওয়ায় । তারই মৃদু হিল্লোল দোলায়িত নৃত্যচ্ছন্দে রূপ নিয়ে দেখা দিল নারী । স্বর্গে শাঁখ বাজাতে লাগলেন বরুণদেবের ঘরনী ।

বরুণদেবের ঘরনী কেন ।

তিনি যে জলদেবী । নারী জাতটা বিশুদ্ধ জলীয় ; তার কাঠিন্য নেই , চাঞ্চল্য আছে , চঞ্চল করেও । ভূব্যবস্থার গোড়াতেই জলরাশি । সেই জলে পানকৌড়ির পিঠে চড়ে যত সব নারী ভেসে বেড়াতে লাগল সারিগান গাইতে গাইতে।

অতি চমৎকার । কিন্তু , তখন পানকৌড়ির সৃষ্টি হয়েছে না কি।

হয়েছে বৈকি । পাখিদের গলাতেই প্রথম সুর বাঁধা চলছিল । দুর্বলতার সঙ্গেই মাধুর্যের অনবচ্ছিন্ন যোগ , এই তত্ত্বটির প্রথম পরীক্ষা হল ঐ দুর্বল জীবগুলির ডানায় এবং কণ্ঠে । একটা কথা বলি , রাগ করবে না তো ?

না রাগতে চেষ্টা করব।

যুগান্তরে পিতামহ যখন মানবসমাজে দুর্বলতাকেই মহিমান্বিত করবার কাজে কবিসৃষ্টি করেছিলেন , তখন সেই সৃষ্টির ছাঁচ পেয়েছিলেন এই পাখির থেকেই । সেদিন একটা সাহিত্যসম্মিলন গোছের ব্যাপার হল তাঁর সভামণ্ডপে ; সভাপতিরূপে কবিদের আহ্বান করে বলে দিলেন , তোমরা মনে মনে উড়তে থাকো শূন্যে , আর ছন্দে ছন্দে গান করো বিনা কারণে , যা – কিছু কঠিন তা তরল হয়ে যাক , যা – কিছু বলিষ্ঠ তা এলিয়ে পড়ে যাক আর্দ্র হয়ে । — কবিসম্রাট , আজ পর্যন্ত তুমি তাঁর কথা রক্ষা করে চলেছ।

চলতেই হবে যতদিন না ছাঁচ বদল হয়।

আধুনিক যুগ শুকিয়ে শক্ত হয়ে আসছে , মোমের ছাঁচ আর মিলবেই না । এখন সেদিন নেই যখন নারীদেবতার জলের বাসাটি দোল খেত পদ্মে , যখন মনোহর দুর্বলতায় পৃথিবী ছিল অতলে নিমগ্ন।

সৃষ্টি ঐ মোলায়েমের ছন্দে এসেই থামল না কেন ।

গোটা কয়েক যুগ যেতে না যেতেই ধরণীদেবী আর্ত বাক্যে আবেদনপত্র পাঠালেন চতুর্মুখের দরবারে । বললেন , ললনাদের এই লকারবহুল লালিত্য আর তো সহ্য হয় না । স্বয়ং নারীরাই করুণ কল্লোলে ঘোষণা করতে লাগল , ভালো লাগছে না । ঊর্ধ্বলোক থেকে প্রশ্ন এল , কী ভালো লাগছে না । সুকুমারীরা বললে , বলতে পারি নে । — কী চাই । — কী চাই তারও সন্ধান পাচ্ছি নে।

ওদের মধ্যে পাড়াকুঁদুলিরও কি অভিব্যক্তি হয় নি । আগাগোড়াই কি সুবচনীর পালা।

কোঁদলের উপযুক্ত উপলক্ষটি না থাকাতেই বাক্যবাণের টংকার নিমগ্ন রইল অতলে , ঝাঁটার কাঠির অঙ্কুর স্থান পেল না অকূলে।

এত বড়ো দুঃখের সংবাদে চতুর্মুখ লজ্জিত হলেন বোধ করি ?

লজ্জা বলে লজ্জা ! চার মুণ্ড হেঁট হয়ে গেল । স্তম্ভিত হয়ে বসে রইলেন রাজহংসের কোটি – যোজন – জোড়া ডানাদুটোর ‘পরে পুরো একটা ব্রহ্মযুগ । এ দিকে আদিকালের লোকবিশ্রুত সাধ্বী পরম – পানকৌড়িনী , শুভ্রতায় যিনি ব্রহ্মার পরমহংসের সঙ্গে পাল্লা দেবার সাধনায় হাজার বার করে জলে ডুব দিয়ে দিয়ে চঞ্চুঘর্ষণে পালকগুলোকে ডাঁটাসার করে ফেলছিলেন , তিনি পর্যন্ত বলে উঠলেন , নির্মলতাই যেখানে নিরতিশয় সেখানে শুচিতার সর্বপ্রধান সুখটাই বাদ পড়ে , যথা , পরকে খোঁটা দেওয়া ; শুদ্ধসত্ত্ব হবার মজাটাই থাকে না । প্রার্থনা করলেন , হে দেব , মলিনতা চাই , ভূরিপরিমাণে , অনতিবিলম্বে এবং প্রবল বেগে । বিধি তখন অস্থির হয়ে লাফিয়ে উঠে বললেন , ভুল হয়েছে , সংশোধন করতে হবে । বাস্‌ রে , কী গলা । মনে হল মহাদেবের মহাবৃষভটার ঘাড়ে এসে পড়েছে মহাদেবীর মহাসিংহটা — অতিলৌকিক সিংহনাদে আর বৃষগর্জনে মিলে দ্যুলোকের নীলমণিমণ্ডিত ভিতটাতে দিলে ফাটল ধরিয়ে । মজার আশায় বিষ্ণুলোক থেকে ছুটে বেরিয়ে এলেন নারদ । তাঁর ঢেঁকির পিঠ থাবড়িয়ে বললেন , বাবা ঢেঁকি , শুনে রাখো ভাবীলোকের বিশ্ব – বেসুরের আদিমন্ত্র , যথাকালে ঘর ভাঙাবার কাজে লাগবে । ক্ষুব্ধ ব্রহ্মার চার গলার ঐকতান আওয়াজের সঙ্গে যোগ দিলে দিঙ্‌নাগেরা শুঁড় তুলে , শব্দের ধাক্কায় দিগঙ্গনাদের বেণীবন্ধ খুলে গিয়ে আকাশ আগাগোড়া ঠাসা হয়ে গেল এলোচুলে — বোধ হল কালো – পাল – তোলা ব্যোমতরী ছুটল কালপুরুষের শ্মশানঘাটে।

হাজার হোক , সৃষ্টিকর্তা পুরুষ তো বটে ।

পৌরুষ চাপা রইল না । তাঁর পিছনের দাড়িওয়ালা দুই মুখের চার নাসাফলক উঠল ফুলে , হাঁপিয়ে – ওঠা বিরাট হাপরের মতো । চার নাসারন্ধ্র থেকে একসঙ্গে ঝড় ছুটল আকাশের চার দিককে তাড়না করে । ব্রহ্মাণ্ডে সেই প্রথম ছাড়া পেল দুর্জয়শক্তিমান বেসুরপ্রবাহ — গোঁ – গোঁ গাঁ – গাঁ হুড়্‌মুড়্‌ দুর্দাড়্‌ গড়্‌গড়্‌ ঘড়্‌ঘড়্‌ ঘড়াঙ । গন্ধর্বেরা কাঁধে তম্বুরা নিয়ে দলে দলে দৌড় দিল ইন্দ্রলোকের খিড়কির আঙিনায় যেখানে শচীদেবী স্নানান্তে মন্দারকুঞ্জচ্ছায়ায় পারিজাতকেশরের ধূপধূমে চুল শুকোতে যান । ধরণীদেবী ভয়ে কম্পান্বিতা ; ইষ্টমন্ত্র জপতে জপতে ভাবতে লাগলেন , ভুল করেছি বা । সেই বেসুরো ঝড়ের উল্টোপাল্টা ধাক্কায় কামানের মুখের তপ্ত গোলার মতো ধক্‌ধক্‌ শব্দে বেরিয়ে পড়তে লাগল পুরুষ — কী দাদা , চুপচাপ যে । কথাগুলো মনে লাগছে তো ?

গল্পের পনেরোতম অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

সম্পর্কিত পোস্ট

দুঃখিত!