সেরা উপহার — শ্রেয়সী ঘটক

আজ অনেক ভোরে ঘুম থেকে উঠেছে সৌম্য। একা একাই। আজ ওর জন্মদিন। মা কাল রাতে বলেছিল, বাবা নাকি এবার ওকে একটা সারপ্রাইজ গিফ্ট দেবে। কিন্তু নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে এসে সেরকম কিছুই দেখল না সৌম্য। মনটা বেশ খারাপ হয়ে গেল ওর। মা যে কেন বলতে গেল? মন খারাপ করে নিজের ঘরে ফিরে এসে ও বাথরুমে ঢুকে যায়। এখন ওর অনেক কাজ। দাঁত ব্রাশ করে, এক গ্লাস দুধ খেয়ে একটু পড়তে বসবে। এক ঘন্টা পড়ে, তারপর স্নান করে, খেয়ে, মায়া মাসীর সাথে বাস স্ট্যান্ডে যাবে। বাস স্ট্যান্ডের কথা মনে পড়তেই ওর মনটা ভালো হয়ে যায়। শান্ত’র সাথে দেখা হবে স্কুলে। শান্ত ওর বেষ্ট ফ্রেন্ড। ও ভীষণ ভালোবাসে শান্ত’কে।
বাথরুম থেকে বেরিয়ে এসে দেখল, মা দাঁড়িয়ে আছে। পিছনে বাবাও। ওরা দুজনেই ওকে ‘হ্যাপি বার্থডে’ বলে জড়িয়ে ধরে অনেক আদর করল। মা বোধহয় ওর মুখ দেখে কিছু একটা বুঝতে পেরে বাবাকে কানে কানে কিছু বলল। বাবা এক গাল হেসে সৌম্য’র পিঠ চাপড়ে দিয়ে বলল, “ডোন্ট ওরি মাই বয়। ইউ উইল গেট ইওর সারপ্রাইজ গিফ্ট ইন দ্য ইভিনিং”। তারপর বাবা আর মা, দুজনেই অফিসে বেরিয়ে গেল।
সৌম্য’রা বেশ বড়লোক। ও জানে না, ওর বাবা কি কাজ করে। শুধু এ’টুকু জানে যে, ওর বাবা আর মা, দুজনেই একটা মস্ত বড় অফিসে চাকরী করে। ওরা এতটাই ব্যস্ত থাকে যে, সৌম্য’র সাথে প্রায় দিন ভালো করে কথাই হয় না। স্কুল থেকে ফিরে কত্ত গল্প থাকে সৌম্য’র। কিন্তু শোনার যে কেউ নেই। হ্যাঁ, মায়া মাসী অবশ্য আছে। কিন্তু মায়া মাসী তো কিচ্ছুই বোঝে না। খালি বলে, “আমি কি ছাই তোমার মত লেখাপড়া জানি, যে আমি তোমার ইস্কুলের গল্প বুঝবো”?
মায়া মাসী’কে সেই ছোট্টবেলা থেকে ওদের বাড়ীতে দেখছে সৌম্য। মায়া মাসী’র নাকি কেউ নেই। তাই ওদের বাড়ীতেই থাকে। মাঝে মাঝে মায়া মাসী’র জন্য খুব কষ্ট হয় ওর। কেন যে কেউ নেই মায়া মাসী’র!
নাঃ, আজ আর পড়াশোনা হবে না। মনের মধ্যে একটা উত্তেজনা আর মন খারাপ, এক সাথে কাজ করছে। সৌম্য অবশ্য এসব বোঝে না। ও শুধু বুঝতে পারছে যে, আজ আর পড়াশোনা হবে না। বই খাতা বন্ধ করে, ব্যাগ গুছিয়ে, ও স্নান করতে চলে যায়। বেরিয়ে জামা, প্যান্ট, টাই আর জুতো-মোজা পরে নেয়। আইডেন্টিটি কার্ড’টাও ঝুলিয়ে নেয় গলায়। তারপর মায়া মাসী’কে বলে, “খাইয়ে দাও”। সৌম্য একা একা খেতে পারে। কিন্তু আজ ইচ্ছে করছে না। মায়া মাসী ওর টিফিনটা ব্যাগে ঢুকিয়ে দেয়। সঙ্গে আরোও একটা প্যাকেট। সৌম্য জানে, ওতে অনেক চকোলেট আছে। আজ ক্লাসে বন্ধুদের দিতে হবে। খাওয়া হয়ে গেলে মায়া মাসী ওকে বাসে তুলে দিয়ে আসে।
বাসে সব ক্লাসের ছেলেরাই থাকে। কেউই জানে না, আজ ওর জন্মদিন। সৌম্য অপেক্ষা করতে থাকে, কখন শান্ত’র সাথে দেখা হবে। শান্ত’র সাথে ও ওর মনের সব কথা শেয়ার করে। শান্ত’রা খুব একটা বড়লোক নয়। কিন্তু ওর মা বাড়ীতেই থাকে। আর শান্ত’কে কি ভালো ভালো টিফিন করে দেয়! সৌম্য প্রায় দিনই নিজের টিফিনটা শান্ত’কে দিয়ে দেয় আর শান্ত’র টিফিনটা নিজে খায়। শান্ত’র মা কি ভালো যে রান্না করে! ওর মা কেন কখনও করে দেয় না এরকম?
ক্লাসে ঢুকে সৌম্য দেখল, শান্ত বসে আছে। ওকে দেখেই এক গাল হেসে ওকে জড়িয়ে ধরে। তারপর খুব মিষ্টি করে বলে, “হ্যাপি বার্থডে সৌম্য। মা আজ তোর জন্য স্পেশাল টিফিন পাঠিয়েছে”। সৌম্য’র মনটা এক পলকে ভীষণ ভালো হয়ে যায়। শান্ত ওর ব্যাগ থেকে একটা কার্ড বের করে দেয় সৌম্য’কে। কার্ডটা ওর নিজের হাতে বানানো। তাতে লেখা, “ফর মাই বেষ্ট ফ্রেন্ড”। সৌম্য এক গাল হেসে শান্ত’কে জড়িয়ে ধরে বলে, “থ্যান্ক ইউ শান্ত। এটা ভীষণই সুন্দর। আমি সারা জীবন যত্ন করে রাখব”।
ইতিমধ্যে প্রেয়ার শেষ করে ওদের ফার্ষ্ট ক্লাস শুরু হয়ে গিয়েছে। ইংগলিশ ক্লাস। মিস ভীষণ রাগী। হোমওয়ার্ক না করলেই শাস্তি দেন। ক্লাস চলাকালীন হঠাৎ’ই শান্ত বলে ওঠে, “মিস, আজ সৌম্য’র হ্যাপি বার্থডে”। সারা ক্লাস হই হই করে সৌম্য’কে “হ্যাপি বার্থডে” উইশ করে। মিস’ও কাউকে বকেন না। সৌম্য লাজুক মুখে সবাইকে চকোলেট দেয়। মিসকেও দেয়।
দেখতে দেখতে টিফিন পিরিয়ড চলে আসে। শান্ত ওর ব্যাগ থেকে ওর মায়ের পাঠানো টিফিন বক্স’টা বের করে সৌম্য’র হাতে দেয়। সৌম্য খুলে দেখে, টিফিন বক্সে লুচি, আলুর দম আর দুটো সন্দেশ আছে। সৌম্য ভীষণ খুশী হয়ে যায়। কাকিমা ঠিক মনে করে ওর জন্যে ওর সবচেয়ে ফেভারিট খাবারটা করে পাঠিয়ে দিয়েছে। শান্ত’কে নিজের টিফিন বক্স’টা দিয়ে সৌম্য পরম তৃপ্তি’তে টিফিন করতে থাকে। শান্ত পাশ থেকে বলে, “এই শোন, আর একটা জিনিসও পাঠিয়ে দিয়েছে মা তোর জন্য”। সৌম্য এবার বেশ অবাক হয়! এরপর’ও আরো কিছু? খাবার শেষ করে বলে, “কই? দে”। শান্ত আরোও একটা টিফিন বক্স বের করে দেয় ওর হাতে। সৌম্য টিফিন বক্স’টা খুলে দেখে আর নিজেকে সামলাতে পারে না। কাকিমা ওর জন্য পায়েস করে পাঠিয়েছে। পায়েস ওর সবচেয়ে প্রিয়। অথচ বাড়ীতে সেটা কারোর মনেই নেই। বাড়ীতে কেউ ওর জন্য পায়েস করে দেয় নি। অভিমানটাকে আর চেপে রাখতে পারে না সৌম্য। শান্ত’কে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলে। তারপর একটু পায়েস খেয়ে বলে, “শান্ত, এটা আমি বাড়ী নিয়ে যাই”? শান্ত রাজী হয়ে যায়।
আজ বাবা – মা তাড়াতাড়ি বাড়ী ফিরেছে। ওর সারপ্রাইজ গিফ্ট’টা নিয়ে এসেছে বাবা। একটা নতুন কম্পিউটার। খুব জেদ করেছিল সৌম্য কিছুদিন আগে। কম্পিউটার’টা পেয়ে ও ভীষণই খুশী হয়। সব রাগ, অভিমান নিমেষে ভুলে যায় সৌম্য। ও ভাবতেই পারে নি যে, এরকম একটা সারপ্রাইজ গিফ্ট ওর জন্য আছে। নতুন কম্পিউটার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যায় সৌম্য। মায়া মাসী এসে বলে, “এটা কার টিফিন বক্স নিয়ে এসেছো”? সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ে যায় পায়েসের কথা। মায়া মাসী’র হাত থেকে ছিনিয়ে নেয় টিফিন বক্স’টা। “এটা শান্ত’র মা আমাকে দিয়েছে”, বলে খুশী মনে পায়েসটা শেষ করে ফেলে।
আজ দিনটা খারাপ কাটে নি সৌম্য’র। বরং বেশ ভালোই কেটেছে। রাতে ওরা বাইরে ডিনার করে ফিরেছে। বাবা বলেছে, পরীক্ষা শেষ হয়ে গেলে একটা বিশাল বড় পার্টি দেবে। কত্ত মজাই না হবে! কত্ত গিফ্ট পাবে, কত্ত হইচই হবে! খুশী মনে ঘুমোতে যায় সৌম্য। শুতে গিয়ে একবার নতুন কম্পিউটার’টার দিকে তাকায়। তারপরই চোখ যায় পাশে রাখা টিফিন বক্স’টায়। পার্টিতে যত মজাই হোক না কেন, আর যতই ভালো গিফ্ট পাক না কেন, কাকিমা’র হাতের ওই পায়েসের কোন তুলনা নেই। পরের বার জন্মদিনে শান্ত’র বাড়ী গিয়ে কাকিমা’র হাতে নিজের পছন্দের সব খাবার খাবে সৌম্য। মনে মনে একথা ঠিক করে, সামনের বারের জন্মদিনের অপেক্ষা নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে সৌম্য।

দুঃখিত!