সূর্যাস্তপ্রেমী—– চন্দন আনোয়ার

মা ঝারি গড়নের তিরিশ-বত্রিশ বছর বয়সের মেয়েমানুষটিকে যে কয়দিন দেখেছি, প্রতিদিনই দেখেছি লাল রঙের একটি ম্যাক্সি পরিহিত। কালো লম্বা চুলগুলি আলগোছে পড়ে থাকে পিঠের উপরে। সূর্যাস্তের কয়েক মুহূর্ত আগে দেহকে সরল রেখার মতো সোজা করে দাঁড়ায় দোতালার বারান্দা। মাথাটা উঁচিয়ে অস্তগামী সূর্যের দিকে তাকিয়ে থাকে। তখন মাথার মধ্যখানের সিঁথির রেখাটাও স্পষ্ট দেখা যায়। সায়ংকালের লাল রং মুখের উপরে পড়ে। তখন আশ্চর্য এক দৃশ্যের অবতারণা হয়। এতোটা নিঃশব্দে আর মগ্নচিত্তে সূর্যাস্ত উপভোগ করবে যে, মনে হয় কয়েক হাজার বছর ধরে মেয়েমানুষটি সূর্যাস্তের অপেক্ষা করে আসছে এভাবেই, এখানেই। আমি যুবক, হতেই পারে এই দৃশ্য দেখার লোভ; কিন্তু কোন ভদ্রলোকের স্ত্রীর দিকে চাতকের মতো তাকিয়ে থাকাটাও তো চূড়ান্ত অভদ্রতা। সামাজিক অপরাধ। এছাড়া মেয়েমানুষটি কিভাবে নেবে, এটিও ভাববার বিষয়।

আমার কাজের মেয়ে রাকিবের মা বড্ড বেশি কথা বলে। তাই ওর কথায় কান দেই না। এ কথায় সে কথায় হঠাৎ একদিন বলে, মানুষটা কি পাষণ্ড গো! অমন চান্দের মতো সুন্দর বৌডারে পিডায় হররোজ। ভেবেছি, ওর বস্তির কারো কথা বলছে হয়তো। খেয়াল করে দেখেছি, সপ্তাহে একবার, কোন সপ্তাহে দু-বার তিনবার একই কথা বলে রাকিবের মা, মানুষটা কি পাষণ্ড গো! বৌডারে খালি পিডায়। এই পর্যন্তই বলে। আমার দিক থেকে কোন সাড়া পায় না বলেই আর এগোয় না। এইদিন আমি ওর কথার প্রত্যুত্তরে বললাম, এই যুগেও মানুষ বউ পেটায়! তারপরেই রাকিবের মা যা বলে, তাতে রীতিমতো কেঁপে ওঠে শরীর। সূর্যাস্তপ্রেমী মেয়েমানুষটির বাসায় কাজ নিয়েছে এবং এ কয়দিন ধরে তার কথাই বলছে। রাকিবের মার মুখেই যাবতীয় বৃত্তান্ত শুনে জানতে পারি যে, মেয়েমানুষটির স্বামী একটি ব্যাংকে চাকরি করে। ওদের পাঁচ-ছ বছরের একটি পুত্রসন্তান। বদরাগী স্বামী নানা ছুতোনাতায় স্ত্রীর শরীরে হাত তোলে। মাঝে মাঝে খুব
মারাত্মকভাবে মারে। এরমধ্যে একবার নাকি হাসপাতাল পর্যন্ত গিয়েছিল। কেন এভাবে পড়ে মার খায়? এই প্রশ্নের উত্তরে রাকিবের মার সরল যুক্তি, মাইয়া মানুষ। একবার সাদী হয়্যা গেলে কি করার থাকে। এরমধ্যে এক ছেলের মা। এই সরল যুক্তির বিপরীতে আমি কোন যুক্তি দাঁড় করাতে পারি না।

 
এরপর সূর্যাস্তপ্রেমী মেয়েমানুষটিকে দেখার লোভ আরও বেড়ে গেল। সেদিন ছুটির দিন না হলেও কাজ অসামাপ্ত রেখে বিকেলেই বাসায় ফিরে আসি এবং সূর্যাস্তের পূর্বে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করি। প্রায় সূর্যাস্ত হতে চলছে কিন্তু তার উপস্থিতি না ঘটায় আমি যারপরনাই উত্তেজিত ও হতাশ। রাত নেমে এলে আমার কেবলি মনে হতে লাগল, মেয়েমানুষটি নিশ্চয় কলে-পড়া ইঁদুরের মতো থ্যাঁতলানো মাথা গুঁজে পড়ে আছে বিছানায়। তাই আজ সূর্যাস্ত দেখতে বেরোয়নি।
আশ্চর্য এক স্বপ্ন রাতভর তাড়া করে ফেরেক্স আমি শৈশবকালে ফিরে গেছি, এমন একটি বাড়ির ওঠোনে দাঁড়িয়ে আছি, যে বাড়িটির চারদিকে চারটে ঘর, ঘরগুলো ছনের ছাউনির, পাটকাঠির বেড়া মাটি দিয়ে লেপা। উত্তরের ঘরটি থেকে একজন মেয়েমানুষকে পেটানোর শব্দ শুনতে পাই, কানে আসে মেয়েমানুষটির আকুতিমিনতির শব্দাবলি, একটি শিশুকণ্ঠের ভয়ার্ত চিৎকারও শুনতে পাই। ঘুম ভেঙে গেলে স্বপ্নটি অসমাপ্ত রয়ে গেল। সূর্যাস্তপ্রেমী মেয়েমানুষটিকে নিয়ে বেশি ভাবার ফল এই ধরনের স্বপ্ন। বিষয়টিকে এতোটা সিরিয়াসভাবে নেয়া ঠিক হচ্ছে না। মন থেকে মুছে ফেলে স্বাভাবিক হতে হবে। এভাবে কতো মেয়েমানুষই প্রতিদিন প্রতি মুহূর্তে পাষণ্ড স্বামীর হাতে মার খায়, আমি একা তার কী প্রতিকার করব?
বয়স তিরিশ পেরিয়ে গেলেও সংসার করার কথা ভাবি না। সংসারের সাথে আমার তেমন কোন বন্ধন নেই। ইচ্ছে করেই কঠিন ব্যস্ততার এক চাকরির মধ্যে ডুবে আছি। স্ত্রী, সন্তান, সংসার এসবের মোহ আমার কাছে ঘুঘুর ফাঁদ। জেনেশুনেই এই ফাঁদে পা দিচ্ছি না। সূর্যাস্তপ্রেমী মেয়েমানুষটি এই ফাঁদে পড়ে গেছে। এখন এভাবেই জীবন চলবে। একদিন বিরতি দিয়ে রাকিবের মার উপস্থিত যেদিন, সেদিন ছুটির দিন। ঘুম থেকে উঠতে ইচ্ছে করছিল না। গেটের চাবি ফেলে দরজা খুলে দিয়ে ফের বিছানায় শুয়ে পড়ি। রাকিবের মা ঘরে ঢুকেই গজগজ করতে লাগল রাগে, ক্রোধে। একজন মানুষকে উচিত শিক্ষা দেয়া তার জরুরি প্রয়োজন, কিন্তু সামর্থ্য আর শক্তিতে কুলোচ্ছে না বলে এখন মেনে নিচ্ছে অসহ্য ক্রোধ আর ঘৃণা নিয়ে। আমি বুঝতে পারি, ওর সমস্ত ক্রোধই সূর্যাস্তপ্রেমী মেয়েমানুষের স্বামীর উপরে। লোকটা আজ আবার বউ পিটিয়েছি কি না? এই প্রশ্নের উত্তরে গাঢ় শ্বাস ফেলে ছোট্ট করে জবাব দেয় রাকিবের মা, হুম। লোকটা পাগল কি না? আমার কথার প্রত্যুত্তরে ক্ষেপে ওঠে সে, পাগল! পাগল!! শেয়ানা পাগল। কিন্তু কি নিয়ে ওদের মধ্যে দ্বন্দ্ব, তুমি কি জানো কিছু? এভাবে মার খেতে হবে কেন? এ বিষয়ে কিছুই জানে না রাকিবের মা এবং মেয়েমানুষটিও মুখ ফুটে কিছু বলে না।

 
ছুটির দিনটি যে ছন্দে কাটে, কেন জানি এই দিনটা সেভাবে কাটেনি। দুপুরের খাবারের পর ঘুম আসেনি। ভীষণ অস্থির আর অবর্ণিত একটি ব্যথা অনুভব করছি বুকে ভেতরে। মনে পড়ে, ছেলেবেলায় এই ধরনের ব্যথা প্রায়ই অনুভব করতাম। ধীরে ধীরে এই ব্যথাটা হারিয়ে যায়। সূর্যাস্তপ্রেমী মেয়েমানুষটির কথা বেশি ভাবছি বলে কি না এই ব্যথার উজান। কিন্তু এখানে আমি কি করতে পারি। ধরে নিলাম, তার জন্যে আমার মধ্যে একটা গভীর সহানুভূতি জন্ম নিয়েছে। আমি তাকে এই নরক-পরিস্থিতি থেকে মুক্ত করতে চাই। তাকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে চেষ্টা করতে পারি। এইজন্য প্রথমে তার সাথে আলাপ করা প্রয়োজন। কিন্তু আমি তার কে? সে এই বিষয়টি নিয়ে আমার সাথে শেয়ার করতে আসবেই বা কেন? তারপর ধরা যাক, আমি মেয়েমানুষটির স্বামীর কাছে জানতে চাই, কেন সে এমন নির্দয়ভাবে তার স্ত্রীকে পেটায়? এই পেটানোর পেছেনে তার কি যুক্তি আছে? কিন্তু সে মানুষটি কি স্বভাবের, তার ক্ষমতা কতোদূর এর কিছুই তো আমার জানা নেই। আর তার স্ত্রীকে সে পেটাবে, আমি বলার কে? সামাজিক দায় অথবা মানবিকতা অথবা নারীর অধিকার ইত্যাদি যে কোনো একটি প্রসঙ্গ টেনে তার মুখোমুখি দাঁড়ানো যায় বটে, কিন্তু তার পরিণাম কি হতে পারে তা ভেবেও আমি বিচলিত। এই ভাবনাগুলো যতোক্ষণ ধরে ভাবছি, বুকের অবর্ণিত ব্যথাটা কিছুটা কমে এসেছিল। এখন ধীরে ধীরে সেই ব্যথাটা উজানে। এই ব্যথাটাকে আমি চিরতরে ভুলে যেতে চাই বলে আমি আমার শৈশবকে মনে করি না। কেন আমি মেয়েমানুষটির কথা এতো ভাবছি, ভাবনার সাথে সাথে বুকের ব্যথাটা উজিয়ে ওঠে কেন, এই দু-য়ের সাথে আন্তঃযোগটাই বা কোথায়, এসব ভাবনার অবসান হওয়া দরকার। সূর্য পশ্চিম আকাশে হেলে পড়েছে কেবল, আমি এরমধ্যেই দু-বার বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছি। সূর্যাস্তপ্রেমী মেয়েমানুষটির মুখে অস্তগামী সূর্যের লাল আলো পড়ে যে অসাধারণ দৃশ্যের অবতারণা হয়, সেই দৃশ্য আজ কি হিসেবে ধরা দেয় তাই দেখার ইচ্ছা থেকে উৎকণ্ঠিত। উৎকণ্ঠার অবসান ঘটিয়ে অবশেষে মেয়েমানুষটি বারান্দায় এসে দাঁড়ায়, পরনে সেই লাল রঙের ম্যাক্সি, মাথার এলোমেলো চুলগুলো পিঠের উপরে ছেড়ে দেওয়া, নীলাভ রঙের একটি ওড়না ইউ-আকৃতি হয়ে বুকের উপরে পড়ে আছে আলগোছে। অত্যন্ত শান্ত ও ধীর পায়ে সে যখন ঘর থেকে বারান্দায় আসে, তখনি আমার চোখে চোখ পড়ে। আমার উৎকণ্ঠা মুহূর্তের মধ্যে মিলিয়ে যায়। ধীরে ধীরে সূর্যাস্তের সময় ঘনিয়ে আসে। মেয়েমানুষটি তার স্বভাবসুলভ ভঙিমায় সূর্যাস্তের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ আমার দিকে তাকিয়ে মাথা ঝাঁকিয়ে মুখে মৃদু হাসির রেখা টেনে কিছু একটা অভিব্যক্তি প্রকাশ করে বলে মনে হয়। সম্ভবত; আমার অতিরিক্ত তাকানোর ফলাফল হিসেবে এমন একটি অভিব্যক্তি প্রকাশ করে যে, আমার তাকে কিছু বলার আছে কি না? কিছু বলার তো অবশ্যই আছে। কেন এভাবে মার খাচ্ছেন? আম, বড়ই, লিচু ইত্যাদি লোভনীয় কিছু চুরি করে পকেটে ঢুকিয়ে নেওয়ার পরে গাছের মালিক দেখে ফেললে বালক যেমন বিব্রত হয় এবং পালানোর জন্য পথ খোঁজে, আমার বাস্তব পরিস্থিতি তাই দাঁড়াল।

 
নারীজীবনের এ কি ট্রাজেডি! এর থেকে মুক্তি কি কোনদিনই পাবে না ওরা? সূর্যাস্তপ্রেমী মেয়েমানুষটির কথা ভেবে মধ্যরাত পার হয়ে গেল। রাতের শেষ প্রহরে ঘুমাচ্ছন্ন হতেই সেই দুঃস্বপ্নটা ভর করে চোখে। আজকের দুঃস্বপ্নটা আরো ভয়ঙ্কর, মেয়েমানুষটিকে দেখিনি, ছায়া দেখেছি শুধু, সেই ছায়াটিকে গরু পেটানোর লাঠি নিয়ে তাড়া করছে আর একটি পুরুষ ছায়া। উঠোনের ঠিক মধ্যে যে স্থানটিতে দাঁড়িয়ে আছি আমি, তার পাশ দিয়ে মেয়েমানুষটি দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করে। কিন্তু বাড়ির উঠোনের মধ্যেই ঘূর্ণিপাক খায়। শেষ পর্যন্ত আর নিজেকে রক্ষা করতে পারেনি। উঠোনে বেঁধে রাখা ছাগলের দড়ির সাথে পা আটকে পড়ে গেলে। সামনে এসে দাঁড়াল পুরুষ ছায়াটি। এই দৃশ্যগুলি কেন দেখছি আর দেখার পরে পরেই বুকের অবর্ণিত ব্যাথাটা এমন মারাত্মকভাবে উজানে ঠেলে ওঠে কেন, তার আমি কিছুই বলতে পারি না। এই বিষয়টাকে আর বেশিদূর এগোতে দেয়া ঠিক হবে না। সকালে মার খেয়ে বিকেলেই যে মানুষটি এমন ঠোঁট টেনে মৃদু হাসি উপহার দিতে পারে, সে নিশ্চয় স্বামীর হাতে মার খাওয়াটাকে খুব বেশি আমলে নেয় না। তার নিজের কোন একটা দুর্বল দিক আছে নিশ্চয়। তা না হলে এ যুগের কোন শিক্ষিত মেয়ে এভাবে মার খায় নাকি? অবশ্য আমার এইসব ভাবনা নিতান্তই গা-বাঁচানোর জন্যেও হতে পারে।
এদিন রাকিবের মা আসতে বেশি দেরি করে। আমার বেরিয়ে যাবার তাড়াহুড়া দেখে ও নিজে থেকেই বলে, দেরি হয়্যা গেল। ওই আপা আজ বিছানাগত। কালকের মারে আজকে শরীরে আগুনের মতো জ্বর আইছে। জ্বরে শরীর পুইড়া যাইবো যেন। আমার বেরিয়ে যাবার তাড়াহুড়ায় মারাত্মক ছেদ পড়ে। সম্পূর্ণ অবচেতন মনে হঠাৎ বলে ফেলি, আমার কিছু করার আছে। আমি এভাবে নিজেকে বাঁচিয়ে চলতে পারি না। কিন্তু কি করার আছে, তাই ভাবতে পারছি না। বুকের অবর্ণিত ব্যথা সমস্ত বুকে ছড়িয়ে পড়লে আমার পক্ষে আর দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব হয় না। রাকিবের মা কখন কাজ শেষ করেছে এবং সদর দরজা খোলা রেখে বেরিয়ে গেছে, টের পাইনি। হঠাৎ সিদ্ধান্ত নিয়ে বসি, আজ আর কোথাও বের হচ্ছি না। প্যান্ট-শার্ট খুলে লুঙ্গি পরে বিছানায় লুটিয়ে পড়ে বুকের অবর্ণিত ব্যথাটাকে চেপে ধরার জন্য বালিশ বুকের নিচে দিয়ে ডানাভাঙা পাখির মতো দুই হাতে দু-দিকে ছড়িয়ে উপুড় হয়ে পড়ে থাকি। এই ব্যথাটা আমার মৃত্যুর কারণ হতে যাচ্ছে কি না, তাই ভেবে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ি। এরই মধ্যে কয়েকবার চেকআপ করার পরেও ব্যথার কোন প্রকার কারণ নির্দেশিত না হওয়ায় আমি যারপরনাই ভীত-সন্ত্রস্ত। স্বামীর পাশবিক নির্যাতনে মেয়েমানুষটির শরীরে আগুনজ্বর, এই সংবাদটির সাথে আমার বুকের অবর্ণিত ব্যথাটির মিতালি হয়ে গেল কিভাবে এবং এর পেছনে কি রহস্য আছে আমি তার অনুসন্ধান করতে শুরু করি। জীবনের কোন একটি পর্বে এই ধরনের কোন ঘটনা দ্বারা আমি আক্রান্ত হয়েছিলাম কি না, এই ধরনের অনুসন্ধানে আমি তেমন কিছু উদ্ধার করতে পারি না। বুকের ব্যথা ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে এলে লক্ষ করি, আমার শরীরের ঘামে বিছানা ভিজে জবজব। এমন দুর্বল হয়ে পড়েছি যে, যেন মুগুর দিয়ে পিটিয়ে শরীরের হাড়-মাংস সব গুড়া করে ফেলেছে।

 
টানা দু-দিন রাকিবের মার অনুপস্থিতি আর আমার বুকের ব্যথার বাড়াবাড়িতে এখন সবকিছুই লণ্ডভণ্ড। সম্পূর্ণ ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে একঠায় দাঁড়িয়ে থাকি বারান্দায়। আমি লক্ষ করেছি, বারান্দায় এসে দাঁড়ালে আমার বুকের ব্যথা কিছুটা হলেও স্তিমিত হয়। সূর্যাস্তপ্রেমী মেয়েমানুষটি এখন কেমন আছে, জানার জন্য ভীষণ উদগ্রীব। রাতের খাবারের জন্য বাসা থেকে বেরোবার সময় একবার ভেবেছি, ওই ফ্লাটের কাউকে জিজ্ঞেস করা যায় কি না, মেয়েমানুষটি এখন কেমন আছে? কিন্তু এটা একান্ত ঘরোয়া একটি ব্যাপার এবং মেয়েমানুষটি যে স্বামীর হাতে মার খেয়ে জ্বরে আক্রান্ত এ কথা কেউ না জানতে পারে। তখন ভারী বেকায়দায় পড়তে হবে।
তিনটি রোগাপাতলা রুটি আর ঠাণ্ডা সবজির তরকারি রাতের খাবার। একটি রুটি খেতে পারি, বাকি দু-টি রুটিই ফ্রিজে রেখে শুয়ে পড়তে গিয়ে দেখি, বিছানার চাদরটি এখনো ভেজা। চাদর পাল্টে নতুন একটি চাদর বিছিয়ে লাইট নিভিয়ে জিরো পাওয়ারের হলুদ বাল্ব জ্বালিয়ে শুতে যাচ্ছি এবং মাথা বালিশের উপরে রেখেছি মাত্র, ঠিক তখনি মনে হলো, নারীকণ্ঠের কেউ একজন ডাকছে আমাকে। রাত প্রায় এগারোটা, এতো রাতে রাকিবের মা আসবে কি? কে ডাকতে পারে? হন্তদন্ত হয়ে উঠে লাইট জ্বালিয়ে বুঝতে পারি, এ আমার নিতান্তই অবচেতন মনের ভুল। এই ধরনের ভুল ছেলেবেলা খুব ঘটত। সবসময়ই মনে হতো আমার পেছনে কেউ হাঁটছে, পেছন থেকে কেউ একজন ডাকছে। রাত হলেই মনে হতো, নারীকণ্ঠের কেউ মমতাজড়ানো কণ্ঠে আমাকে ডাকে, তখন আমার ঘুম ভেঙে যেত এবং আতঙ্কে কেঁদে উঠতাম দেখে নানি বলতেন, ভয় পাস ক্যানো? তোর মা তোরে ডাকে? তোর মা কবরে থেকে তোরে ডাকে। তুই ভয় পাস না। আমার এই ভয় তাড়ানোর জন্যে ইউনুস কবিরাজের মাদুলি কোমরে বেঁধে দিয়েছিলেন। সেই মাদুলির দাগ এখনও আছে। বুকের অবর্ণিত ব্যথাটার মতো এই পিছুডাকটাও বড়ো হয়ে যাবার পরে হারিয়ে যায়। এতো বছর পরে কি আমি সেই ডাক শুনছি। নাকি পাশের ফ্লাটের মেয়েমানুষটাকে তার স্বামী এখন পেটাচ্ছে। অসহায় হয়ে আমাকে ডাকছে সাহায্যের জন্যে। রাতের শব্দ জোরে হয়। ওই ফ্লাট থেকে মেয়েমানুষটির ডাক শোনারই কথা। বিছানা থেকে উঠে গিয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখি, ওই ফ্লাটের দো-তালায় মানুষের কোন সাড়া শব্দ নেই। বিছানায় শোবার পরে মনে হলো, আমার মা কেমন ছিল? মার স্মৃতি বলতে, অত্যন্ত ক্ষীণকায় অস্পষ্ট একটি ছায়াছবি ছাড়া কিছুই মনে পড়ে না। মার কোন ছবিও ছিল না। নানিদের বাড়ির পেছনের বাঁশঝাড়ের পারিবারিক কবরস্থানে মার যে কবরটি, সেখানে ছেলেবেলায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মায়ের ছবি আঁকতাম। নানি বলতেন, একটি ছবিও নাকি মার মতো হয়নি। নানির বর্ণনামতে, মা শ্যামলা ছিলেন। বেশি লম্বা ছিলেন না। বিয়ে হয়েছিল মাত্র ১৬ বছর বয়সে। রোগ-শোকের বালাই ছিল না। শুধু সেই জ্বরের ধকলটা কাটিয়ে উঠতে পারেননি। মনে মনে সূর্যাস্তপ্রেমী মেয়েমানুষটির প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই। তার জন্যে এতো বছর পরে মার কথা ভাবছি। এবং আকস্মিক এই সিদ্ধান্তও নিয়ে ফেলি যে, কাল-পরশু গ্রামে যাব।
ঠিক কত রাতে চোখে ঘুম এসেছে মনে নেই। কিংবা আদৌ আমি ঘুমিয়েছি কিনা সে কথাও ভাবছি। রাতভর ওই দুঃস্বপ্নটার মধ্যে ডুবে ছিলাম। সুবিন্যাস্ত ভয়ার্ত দৃশ্যের যে দুঃস্বপ্নটা দু-দিন ধরে ধারাবাহিক নাটকেরর মতো চলছে আজ তার তৃতীয়পর্ব এবং শেষপর্ব বোধহয়। যথারীতি আমার শৈশব চোখ আর আতঙ্কিত মন নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি উঠোনে। যথারীতি দরজা-জানালা বন্ধ একটি ঘর, ঘরের ভেতরে একজন মেয়েমানুষের আর্তচিৎকার। পুরুষ কণ্ঠে শুয়োরের গোঙানির শব্দ। ঘরের ভেতরে যেন দৌড়ের প্রতিযোগিতা চলছে। হঠাৎ ঘরের দরজা খুলে গেলে মেয়েমানুষটি তার ছায়ার আগেই লাফিয়ে পড়ে উঠোনে। পুরুষটি হোঁচট খেল। পালানোর জন্য যথেষ্ট সময় পেল মেয়েমানুষটি। কোমর থ্যাঁতলানো কুকুরের মতো হেঁচড়াতে হেঁচড়াতে শরীর টেনে উঠোনের চৌহদ্দিও অতিক্রম করতে পারেনি। পুরুষটি কয়েক মুহূর্ত লম্বা শ্বাস ফেলে নিজের নিশ্বাস স্বাভাবিক করে নেয়। অন্ধকারে হাতড়ে ম্যাচবাক্স ও আনছার বিড়ির প্যাকেট খোঁজায় ব্যয় করে কিছুটা সময়। তার কোন তাড়াহুড়া নেই, কারণ, সে জানে, পালানোর মতো জীবনীশক্তি অবশিষ্ট নেই মেয়েমানুষটির শরীরে। একটি আনছার বিড়ি পুড়িয়ে ধোঁয়া সেবনে ৫ মিনিট সময় অতিবাহিত হয়। মোবাইলের ব্যাটারি চার্জ দেবার মতো নিজেকে রিচার্জ করে নেয়। কোরবানির গরু জবাই করার ছোরাটি খুঁজে পেতে তার অসুবিধা হয় না। কারণ, পূর্ব পরিকল্পনামাফিক ছোরাটিকে বিছানার নিচে লুকিয়ে রেখেছিল। এখন রাতের চূড়ান্ত নিস্তব্ধতার কাল। ভরাপূর্ণিমা। পরিপূর্ণ চাঁদটি মাথার উপরে যেন স্থির হয়ে থেমে গেছে। উঠোনের একেবারে দক্ষিণপ্রান্তে ডুমুর গাছের ছায়াচ্ছন্ন একটি জায়গায় মেয়েমানুষটি হাত-পা ছেড়ে দিয়ে আকাশের চাঁদটির দিকে মুখ করে শুয়ে আছে চিৎ হয়ে। দু-চোখে দুটি অশ্র“ধারা। ছোরা হাতে পুরুষটির বের হয়ে যাবার ছায়াদৃশ্যটির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ঘুম ভেঙে গেলে আমার বুকের অবর্ণিত ব্যথাটি এমন ভয়ানকভাবে লাফিয়ে ওঠে যে, বুকের ভেতরে যেন ধারালো একটি চাকু প্রবেশ করিয়ে মোচড়ানো হচ্ছে। বুকের উপরে চিলথাবা দিয়ে বালিশ কামড়ে ব্যথাটা সহনীয় হয় বটে, কিন্তু শরীরজুড়ে মুগুর-পেটানো ব্যথা। হাত-পা অবশ, নিথর। নির্ঘুম মানুষের মতো চোখের পাতা ভারী হয়ে গেছে। ভীষণ ক্লান্তি শরীরে। বিছানা ছেড়ে উঠতে ইচ্ছে করে না। তন্দ্রাচ্ছন্ন কিছুক্ষণ থাকার পরেই রাকিবের মার কলিংবেল বেজে ওঠে।

 
টানা দু-দিন অনুপস্থিতির বলে রাকিবের মা কোন একটা অজুহাত দাঁড় করাবে নিশ্চয়। ছেলে, মেয়ে, স্বামী অথবা নিজের অর্থাৎ কারো না কারো অসুস্থতা অথবা এমন এক সমস্যা বা সংকটের কথা এতো নিখুঁতভাবে গুছিয়ে বলবে যে, অনুপস্থিতির জন্য কিছু বলার চেয়ে আরো দু-দিন ছুটি মঞ্জুর করা প্রয়োজন পড়বে। ওর সাথে পারা কঠিন। দরজা খুলে তন্দ্রালু চোখে ওর দিকে তাকিয়েই আঁতকে উঠি এবং পেছনে সরে যাই। ওর শরীর থেকে মেডিসিনের উৎকট গন্ধ মুহূর্তের মধ্যে এমন ব্যাপক ও বিশ্রীভাবে ছড়িয়ে পড়ে যে, মনে হলো, আস্তো একটা হাসপাতাল আমার সামনে। একি রাকিবের মা! তোমার শরীরে এমন বিশ্রী ওষুধের গন্ধ কেন? তোমার শরীরে মরা মানুষের গন্ধও পাচ্ছি। হাসপাতাল থেকে এসেছো নাকি? মরা টেনেছো নাকি? তোমার চোখ-মুখ ফোলা, মনে হয় দু-তিন দিন ধরে ঘুমাওনি। রাকিবের মা দপ করে বসে পড়ল মেঝেতে। দীর্ঘ ও কঠিন শ্রমে এতেটাই ক্লান্ত যে, এখনি শরীর ছেড়ে দেবে। ত্রিশ-বত্রিশ বছরের যুবতী, বুদ্ধিমতী ও স্বাস্থ্যবতী রাকিবের মা যথেষ্ট সংগ্রামী। এই শহরে একা সংগ্রাম করে একটি পরিবারকে টিকিয়ে রেখেছে। পরাস্ত মানুষের মতো যেভাবে হাত-পা ছেড়ে দিয়েছে তাতে বড় ধরনে একটা কিছু ঘটতে পারে ভেবে আমি ভয় পেয়ে গেলাম। ভয় পেলাম এই ভেবেও যে, ওর পরিবারের কারো বড়ো ধরনের কোন দুর্ঘটনা ঘটল কি না? আমি যা ভাবিনি অথবা ভাবতে পারিনি, এমন দুঃসংবাদ জানিয়ে রাকিবের মা বলে, এই খবর দেবার জন্যই এসেছে। হাসপাতাল থেকে এসেছে এবং হাসপাতালে ফিরে যাবে এখনি। হঠাৎ গোঙিয়ে ওঠে আঁচল দিয়ে মুখ ডেকে নিজেকে সংযত করে বলে, আপা মনে হয় বাঁচবো না স্যার। একবার গিয়া দেইখা আসেন। আপা মাঝেমধ্যে আপনার খোঁজখবর লইতেন। আমার কইতে বারণ করছিলেন। ওয়ার্ড ও বেড নাম্বার জানিয়ে রাকিবের মা আর দাঁড়ায়নি। ছুটে বেরিয়ে গেল। সূর্যাস্তপ্রেমী মেয়েমানুষটি মরণ-জ্বরে আক্রান্ত হয়ে এখন হাসপাতালে। মৃত্যুর সাথে লড়াইরত। সেদিনের আঘাত আর শরীর সহ্য করতে পারেনি। একবার যেতে হবে দেখতে।
রাকিবের মা বলেছিল বটে, কিন্তু এতোটা সিরিয়াস বলেনি যে, আজকেই মারা যেতে পারে। রুটিন ডিউটিগুলো শেষ করে সূর্যাস্তের ঠিক আগের মুহূর্তে যখন রিকশা নিয়ে হাসপাতালের দিকে যাচ্ছি, তখন মনে হলো, এই সময় মেয়েমানুষটির সূর্যাস্ত দেখার কথা ছিল। এখন তার জীবনসূর্য অস্তগামী। আমি হাসপাতালের গেটে পা রেখেই দেখি, রাকিবের মা বেরিয়ে আসছে একটি স্ট্রেচার ঠেলতে ঠেলতে। সাদা কাপড়ের নিচে সূর্যাস্তপ্রেমী মেয়েমানুষটির প্রাণহীন শরীর। তার প্রিয় একটি সময় এখন। আমাকে দেখেই রাকিবের মা কেঁদে ওঠে, ভাইজান, আপা আর নাই। স্ট্রেচারকে ঘিরে আর কোন মানুষ নেই, রাকিবের মা একা স্ট্রেচার ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে দেখে বিস্মিতই হলাম। অন্তত পাষণ্ড স্বামীটার তো থাকা উচিত ছিল। কিন্তু তুমি একা কেন রাকিবের মা, আর কেউ নেই, তার স্বামী কোথায়? রাস্তার উপরে দাঁড় করানো সাদা রঙের একটি মাইক্রো দেখিয়ে রাকিবের মা বলে যে, এই মাইক্রো ঠিক করে ওর উপরে দায়িত্ব দিয়ে গেছে। স্ট্রেচারের সামনে দাঁড়াতেই রাকিবের মা লাশের মুখের দিক থেকে কাপড় সরিয়ে আমাকে দেখানোর চেষ্টা করলে বাধা দেই, কিন্তু ও আমার বাধা মানেনি। লাশের মুখের ওপরে অস্তগামী সূর্যের লাল আলো পড়েছে। মনে হচ্ছে সে এখনো সূর্যাস্তের দিকেই তাকিয়ে আছে।
নানির মৃত্যুর পাঁচ বছরের মধ্যে গ্রামে আসা হলো এই নিয়ে তিনবার। কিন্তু একবারও থাকা হয়নি। সকালে এসে সন্ধ্যায় ফিরে গেছি। নানি যে ঘরটায় থাকতেন সেই ঘরটায় গ্রামের এক দুস্থ বিধবা ফরিদের মা থাকে তার ছেলেমেয়ে নিয়ে, বাকি দু-টি ঘর পরিত্যক্ত ও জরা-জীর্ণ। কেবল উত্তরের যে ঘরটায় কোন এক বুধবারের প্রত্যুষে আমি জন্মেছি, যে ঘরটায় মা আমাকে নিয়ে থাকতেন, সেই ঘরটায় কোনদিন এসে থাকতে পারি, এই ভেবে পরিষ্কার রাখার দায়িত্ব দিয়েছি ওদের। ফরিদের মা নানির খুব কাছের মানুষ ছিল। শেষ ক-বছর সে-ই নানিকে টানাহেঁচড়া করে এবং এর কৃতজ্ঞতা স্বরূপ নানিই ওকে দিয়ে গেছেন এই বাড়ি পাহারার দায়িত্ব। আমি আসছি এবং একরাত থাকছি, একথা মোবাইলে জানিয়েছি ফরিদের মাকে। ধুয়ে-মুছে যথেষ্ট পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে একরাত থাকার ব্যবস্থা ভালোই হয়। আমি এসেছি শুনে দূরসম্পর্কের মামা এসেছেন পুরনো একটি ট্রাংক হাতে নিয়ে। জংধরা ছোট্ট এই ট্রাংকটি ক্ষুদে একটি তালা দিয়ে রক্ষিত। নানি তাকে চাবি দিয়ে যাননি এবং এই কয় বছরের মধ্যে ট্রাংকটি খুলে দেখেননি জমির দলিল-দস্তাবেজ ছাড়া আর কিছু আছে কিনা। অগত্যা তালা ভাঙতে হয়। ততোক্ষণে সন্ধ্যা নেমে আসায় ঘরের ভেতরে বাতির আলো নিয়ে প্রবেশ করে ফরিদার মা। মামার চোখের পাতা কেঁপে ওঠে। আমি লক্ষ করি, তিনি আমাকে কিছু বলবেন ভেবে প্রস্তুতি নিয়ে অদৃশ্য বাধার মুখে সরে এসেছেন। ট্রাংকটি সযত্নে রাখার জন্য তাকে ধন্যবাদ জানাই। দ্রুত হাত চালিয়ে ট্রাংকের কাগজ-পত্রগুলো গোছাতে গিয়ে হঠাৎ হাতে কাঁটার মতো কিছু একটা বাঁধে- নাকফুল, কানের দুল, মোটা একটা চেইন, হাতের ২টি বালা, আরো কিছু ছোটখাটো স্বর্ণালঙ্কারের একটি পুঁটলি। আমার চোখ অশ্রুসিক্ত। সে ফ অবহেলা আর গাফিলতির কারণে যে ট্রাংকটি পড়ে আছে অন্য একজনের কাছে, তার ভেতরে নানি রেখে গেছেন এই সব সঞ্চয়। জমির দলিল পেলাম মাত্র ২টা। আরো আজেবাজে কিছু কাগজ-পত্র সরিয়ে রাখতে গিয়ে হঠাৎ একটি হলুদ খাম হাতে পড়ে। খামটি খুলে চমকে উঠি। ভেতরে হাসপাতালের রিপোর্ট। ইংরেজি ক্যাপিটাল লেটারে লেখা DEATH CERTIFICATE. তার নিচে লেখা মায়ের নাম। হাতের লেখা অত্যন্ত প্যাঁচানো ঘুরানো, রিপোর্টের পাঠোদ্ধার অত্যন্ত দুরূহ, বিচ্ছিন্নভাবে কয়েকটি শব্দ ছাড়া আর কিছুই ধরে উঠতে পারিনি। এরমধ্যে injured শব্দটি একাধিকবার লেখা। আমার মুখে injured শব্দটি শুনে মামা উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে কিছু একটা বলার ভঙ্গি করে মাথা নামিয়ে নিলে আমার মনে কেমন একটা খটকা লাগে। মা, হাসপাতালে মারা গিয়েছিলেন, এ কথা আমি জানি। কিন্তু কি হয়েছিল এবং কিভাবে মারা গিয়েছিল ইত্যাদি কিছু জিজ্ঞেস করলে নানি বরাবরই প্রসঙ্গটি এড়িয়ে যেতেন শুধু একটি কথা বলে মরণ-জ্বর! মা-র ডেথ সার্টিফিকেটে injured কথাটি লেখা থাকবে কেন? মা-কি কোনভাবে বড় ধরনের কোন আঘাত পেয়েছিলেন? দূরসম্পর্কের মামাটি এবার আমার মুখের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা পাঠ করবার চেষ্টা করেন। বড়ো একটা শ্বাস ফেলে বলেন, আমরা সন্দেহ করেছিলাম, তোমার বাপ…।

 
বাবার নামটি ছাড়া আর কিছুই আমার জানা নেই। তিনি কোথা থেকে এসেছিলেন, মাকে বিয়ে করে মাত্র ৪ বছর সংসার করে মায়ের মৃত্যুর দিনেই কোথায় উধাও হয়ে গেলেন, তার কোন খবরই নানি দিতে পারেননি। এমনকি, বাবার শারীরিক অবয়ব সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে বলতেন, ছোটোখাটো বেঁটে কালো ছেলেটা। নানি অনেকটা একঘরে স্বভাবের ছিলেন। তিনি বাংলা ভালোভাবে পড়তে ও লিখতে পারতেন। তার মতো আধুনিক রুচিশীলা গ্রামে তেমন কেউ ছিল না বলে চলাচলও সীমিত ছিল। মা-র জন্মের পরেই নানা টাইফয়েডে মারা গেলে অল্প বয়সেই বিধবা হতে হয়। মা নানিরই স্বভাব পেয়েছিলেন। মা- মেয়ের সংসারে তৃতীয় ব্যক্তি হিসেবে আমার বাবার আবির্ভাব ঘটে লজিং মাস্টার হিসেবে এবং মা-কে পড়ানোর জন্যই মূলত তাকে রাখা হয়েছিল। সার্টিফিকেট ও বিভিন্ন প্রয়োজনে বাবার নাম লেখাটা পর্যন্তই আমার কাছে বাবার অস্তিত্ব। এই মানুষটা সম্পর্কে জানার তেমন কৌতূহল আমার কখনোই ছিল না। সম্ভবত; তাকে দেখিনি বলে আমার এই নির্লিপ্ততা। আজ মনে হচ্ছে, মানুষটি রহস্যময় চরিত্রের ছিলেন। বাবার বাড়ি কোথায় ছিল বলতে পারেন? আপনি কি জানতেন মা কিভাবে মারা গেলেন? এই কথার উত্তর দিতে গিয়ে মামা এতোটা অপ্রস্তুত ও বিব্রত হয়ে পড়লেন কেন, আমি ভেবে পাই না। এই প্রশ্নের উত্তর যে তার জানা আছে এবং সে তা এড়িয়ে যেতে যাচ্ছে, এটি তার মুখের অবয়ব পরির্তনের মধ্যেই স্পষ্ট। এছাড়া সম্পূর্ণ অনিচ্ছায় এবং আকস্মিকভাবে বাবার কথাটি মুখ দিয়ে বেরিয়ে পড়ায় ভীষণ তটস্থ ও অস্বস্তিবোধ করছেন বোধহয়। কিন্তু এখন ফিরে যাবার উপায় নেই। আমার মুখোমুখি বসে থাকাটাও তার জন্য এখন কঠিন। কিন্তু আমি যে আমার উত্তরের কাছাকাছি চলে এসেছি এবং তার মুখ থেকে না শুনে নিবৃত্ত হচ্ছি না এই সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে এক বাক্যে শুধু বললেন, তোমার বাবার হাতে মার খেয়ে…। এই কথাটি বলেই মুখ ঘুরিয়ে নিলেন। আমি লক্ষ করি তার চোখ ভিজে উঠেছে। পরিবেশ এতোটাই শান্ত-নীরব হয়ে পড়ে যে, নিশ্বাসের শব্দটিও নিঃশব্দ। এই পরিবেশে কিছু জিজ্ঞেস করা উচিত হবে না ভেবেই জিজ্ঞেস করা হয়নি। শুধু একটি কথা না জিজ্ঞেস করে পারা গেল না, মাকে মারার কারণটা সে জানে কি না। প্রত্যুত্তর দেবার আগে দূরসম্পর্কীয় মামা মাথা নুইয়ে গাঢ় একটি শ্বাস ফেলে উঠে যাবার উপক্রম করলে আমি বলি, সব কথাই বলে ফেললেন যখন, এই কথাটাও না হয়…। শোনা ছাড়া আমার এখন কি করার আছে। মামার চোখেমুখে ফের দ্বিধা, সংকোচ, ভয়। আমি দ্বিতীয়বারের মতো অনুরোধ করি, মা-র অপরাধটি কি খুবই গুরুতর ছিল, এভাবে আহত করে মৃত্যু…। এবার মামার ফর্সা মুখের চিকনরেখাগুলো স্পষ্ট হয়ে ওঠে। চোখের পাতা ফেলেন অস্বাভাবিকভাবে। আমাকে যেন তার ভীষণ ভয়, এখন আমার কাছে থেকে পালাতে পারলেই বাঁচেন। হঠাৎ মামার এই পরিবর্তনে আমি নিজেও দ্বিধান্বিত। এতোটা দ্বিধা আর রহস্যের কিছু আছে বলে মনে হয়নি। স্বামী স্ত্রীকে পিটিয়ে হাসপাতালে পাঠানো এবং শেষে মৃত্যুর মতো মর্মান্তিক ঘটনা …। সূর্যাস্তপ্রেমী মেয়েমানুষটির লাশ দাফন হয়েছে কি না কে জানে?
দ্বিধা ও রহস্য কাটিয়ে দূরসম্পর্কীয় মামা যা বললেন, তাতে বাবার ধারণাটা সত্য কি মিথ্যা, এই প্রশ্ন উঠাই স্বাভাবিক। বাবার ধারণা মতো মা-র প্রতি তার কোন দুর্বলতা ছিল কিনা, এই কথা জিজ্ঞেস করা যৌক্তিক হবে কিনা, এবং মামা তা স্বীকার করবেন কিনা, ভাবছি। এবং এমন একটি সত্য জানার পরে আমার মধ্যে যে ধরনের প্রতিক্রিয়া হবার কথা, তা হয়নি, বরং স্বাভাবিক একটি ঘটনা বলে মনে হয়। আমাকে ঘিরে মামা-র মধ্যে যে ভয়, এবং আমি কি ভাবছি, এ কথা ভেবে নিস্তব্ধ নীরবতা, তা কাটিয়ে উঠার জন্যেই মূলত ঘুরিয়ে নেই প্রসঙ্গটিকে। কিন্তু মামা প্রসঙ্গ থেকে বের হতে অনিচ্ছুক। কিছুক্ষণ নীরবতা পালনের পরে বলেন, তোমাকে সহ্য করতে পারত না। এই প্রসঙ্গটি নিয়ে কথা বলার ইচ্ছে নেই বলে তাকে থামিয়ে দেই। মামা অস্থির হয়ে ওঠে আরো কিছু বলার জন্য, কিন্তু আমার অনাগ্রহ আর নিরাসক্তি দেখে তিনি অপ্রস্তুত কণ্ঠে বললেন, ঘটনাটা অনেক দূর…। আমি তাকে দ্বিধা ও সংকোচ থেকে বের করে স্বাভাবিক করার জন্যে বলি, মামা, আমি কিছুই মনে করছি না। আমি আপনাকে ভুলও বুঝছি না। ছেলেবেলার ঘটনা এসব। মামার চোখে-মুখে যেন অচেনা আতঙ্ক, তোমার মার কাছে কথা দিয়েছিলাম…। এবার রূঢ়ভাবে মামাকে থামিয়ে দিয়ে বলি, মামা, আমি কিছু শুনতে চাচ্ছি না, প্লিজ। ট্রাংকটা বরং আপনার কাছেই থাকুক।

 
দূরসম্পর্কী মামা বিদায় নিয়ে চলে গেলে ভাবছি, সন্ধ্যা থেকে এই সময়টা পর্যন্ত যা ঘটেছে, এর ভার বহন করার এতো শক্তি এখন কোথায় পাবো? আমার জীবনের সমগ্র অতীত এখন প্রশ্নবিদ্ধ? কঠিন প্রশ্নের মুখোমুখি পড়ল বর্তমান? ভবিষ্যৎ কেমন কাটবে এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজার উপরে নির্ভরশীল। এই প্রশ্নগুলোর উত্তর পেতে হলে এখন প্রয়োজন সেই মানুষটিকে, যে মানুষটিকে এতোকাল মোটামুটি ভালোই জেনে এসেছি। স্ত্রীর মৃত্যুশোক ধারণ করতে পারেনি বলে নিরুদ্দেশ হওয়ার জন্যে যে মানুষটি এতোকাল মহৎ মানুষ, একনিষ্ঠ প্রেমিক হিসেবেই স্বীকৃতি ছিল আমার কাছে, হঠাৎ সম্পূর্ণ পাল্টে গেল কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে। মা-কে ঘিরে ওঠা প্রশ্নটির সত্য-মিথ্যা যাচাই আমি হয়তো কোনোদিনই করতে যাব না, তারপরেও কি একটি জিজ্ঞাসাচিহ্ন স্থায়ী হয়ে গেল না? এতো বড়ো সত্যের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আমি কেমন করে এতোটা সুশান্ত! বৃহৎ আঘাতের তাৎক্ষণিক ব্যথা সামান্য। আমার অতীত অস্তিত্ব, আমার বর্তমান, আমার ভবিষ্যৎ সবকিছুই এখন থেকে নিয়ন্ত্রণ করে যাবে এইসব জিজ্ঞাসাচিহ্ন।
রাত বেড়ে প্রায় এগারোটা। আলোর দিকে তাকিয়ে আছি নির্বিকারভাবে। হালকা ঘোরের মধ্যে হঠাৎ চমকে ওঠি। আমার এই চমকে ওঠা দেখে ফরিদার মাও কেঁপে ওঠে। ওর এক হাতে খাবারের প্লেট, এক হাতে কাঁচের গ্লাসে পানি। হঠাৎ চমকানোয় যতোটা না অপ্রস্তুত, তার চেয়েও বেশি আতঙ্কিত। এই ধরনের চমকে ওঠার ঘটনা আমার জীবনে এই প্রথম। প্রবল প্রত্যয় ও আত্মবিশ্বাস আমার। সহজে বিস্মিত হই না, আবেগ-অভিমান যৎসামান্য। ফরিদার মার বয়স বড়োজোর চল্লিশ-বিয়াল্লিশ। এরিমধ্যে চেহারায় যথেষ্ট বার্ধক্যের ছাপ পড়েছে। টেবিলে খাবার রাখতে রাখতে সে বলে, অহন মেলা রাইত হয়্যা গেল। যাইবেন কবরস্থানে? আমরা রাইত হইলে ভয় পাই, বাড়ির পেছনে যাই না। কেন ভয় পায়, এই কথার প্রত্যুত্তরে সে বলে, খালি মনে হয় কেডা যেন হাঁট্যা বেড়ায়। বাতি নিয়া বাইর হইলে মানুষের হদিশ পাই না। দূরসম্পর্কীয় মামার মুখে কথাগুলি শোনার আগে এই কথাগুলো শুনলে অবচেতন মনের ভুল, এরকম মানুষের হয় বলে. যতোটা স্বাভাবিকভাবে উড়িয়ে দেয়া যেত, এখন যেন তা আর সম্ভব নয়। একজন যুবতী, যে তার এক বছরের শিশুপুত্রকে রেখে অকালে জীবন হারাল, তার আত্মা আর কোথাও গিয়ে শান্তি পাবে না। মৃত মানুষের শরীর থাকে না, কিন্তু আত্মারা তো স্বাধীন। স্বাধীন ওদের চলাফেরা।
রাতের খাবার খেয়ে শুয়ে পড়ি। বাতি নিভিয়ে দেবার পরে মুহূর্তের মধ্যে কবরের মতো নিস্তব্ধতা নেমে আসে। অন্ধকারের কফিনের ভেতরে নিথর একটি শরীর, নিশ্বাস ফেলার শব্দটিও নেই। আমি আর সূর্যাস্তপ্রেমী মেয়েমানুষ দু-জনে দাঁড়িয়ে আছি সূর্যাস্তের মুখোমুখি- তার পরণে ডুবন্ত সূর্যের মতো লাল ম্যাক্সি, হাতে সেই চিরুনি, মাথার খোলা চুল দুই কাঁধে বিভক্ত, মুখে সেই মৃদু হাসি। এতোদিন কতো কথা বলার ছিল, আজ আর কিছু কথা বলার নেই, শুধু মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া। নিথর শরীর হঠাৎ কেঁপে ওঠে দরজায় শিকল নাড়ার শব্দে। ফরিদার মা ভেবে দরজা খুলে কাউকে দেখতে না পেয়ে মনের ভুল ভাবি। মুখ ধুয়ে ফ্রেস হয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করার উদ্দেশ্যে কল পাড়ে গিয়ে মনে হলো, বাঁশঝাড়ে মানুষের হাঁটার মচমচ শব্দ। এবং ক্ষীণ একটি আলো জোনাকির আলোর মতো জ্বলছে নিভছে। ক্রমশ বাঁশ ঝাড়ের ভেতরের দিকে ধাবিত আলোটি যে জায়গায় এসে স্থির হয়ে গেল, তার কয়েক ধাপের মধ্যে মা-নানির কবর পাশাপাশি। এতো গভীর রাতে এমন অন্ধকারে বাঁশঝাড়ের ভেতরে মানুষের চলাচল কি করে সম্ভব, একথা ভাবছি দাঁড়িয়ে। ঠিক তখনি লক্ষ করি, আলোটি বাঁশঝাড়ের ভেতর থেকে বেরিয়ে কলপাড়ের দিকে আসছে, পা ফেলার মচমচ শব্দ ক্রমেই নিকটবর্তী হতে হতে কাছাকাছি চলে আসে। আমার শরীরের রক্ত চলাচল প্রায় বন্ধ। আমি ভাবতেই পারিনি দূরসম্পর্কীয় মামা এসে দাঁড়াবেন আমার মুখোমুখি। হাতে সেই ট্রাংকটি। মামা আপনি? আমার উত্তেজনা প্রকাশের শব্দ মুখ থেকে বের হবার আগেই মামা হাঁটতে শুরু করেন, আমি তার পেছনে হেঁটে ঘর পর্যন্ত পৌঁছার পরে বাতির আলোয় তার দিকে তাকিয়ে আতঙ্কিত হয়ে পড়ি। এই কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে এতো বিধ্বস্ত হতে পারে একজন মানুষ! হিংস প্রাণীর সাথে লড়াই করে কোনপ্রকারে জীবন বাঁচিয়ে ফিরে এসেছেন বলে মনে হয়। ফাঁসলাগা মানুষের মতো নিশ্বাস ফেলার চেষ্টা করছেন কিন্তু ক্রমেই নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। ট্রাংকটি খাটের উপরে ফেলে ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে গেলে আমিও পেছনে পেছনে ঘর থেকে বের হই। কিন্তু এতো ক্ষিপ্র গতিতে অন্ধকারের ভেতরে হারিয়ে গেলেন যে, আমি আর ধরতে পারিনি। কিন্তু একথা ভাবতে পারিনি, তিনি আত্মহত্যা করতে যাচ্ছেন…।
লেখক : কথাসাহিত্যিক

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

দুঃখিত!