
ইসলামের ইতিহাসে এমন অনেক শাসকের কথা শোনা যায়, যারা রাতের বেলায় ছদ্মবেশে জনগণের দুঃখকষ্ট ও অভাব-অভিযোগের খবর নিতেন। এ কাজ করতে গিয়ে তাদেরকে নানা রকম বিপদ-আপদ ও সমস্যায় জড়িয়ে পড়তে হতো। একাদশ শতাব্দিতে এ রকম একজন শাসক ছিলেন সুলতান মাহমুদ গজনভী। তিনি ছিলেন পারস্য, আফগানিস্তান, পাকিস্তান এবং ভারতের উত্তরাঞ্চলের শাসক। সুলতান মাহমুদ প্রায়ই ভিক্ষুক, দরবেশ কিংবা শ্রমিকের বেশ ধরে ঘুরে বেড়াতেন আর জনগণের খোঁজখবর নিতেন।
এভাবে ঘুরে বেড়াতে গিয়ে একবার একটা মজার ঘটনা ঘটে। আমরা সেই ঘটনাটিই প্রচার করেছি। গল্পটি মাওলানা রুমির মসনবী থেকে নেয়া গল্পটির নাম ‘সুলতান মাহমুদের দাড়ি’। সুলতান মাহমুদ এক রাতে বাদশাহী পোশাক ছেড়ে শ্রমিকের পোশাক পড়ে গজনী শহরে বের হলেন। কিছুদূর যাওয়ার পর তিনি দেখতে পেলেন ৪/৫ জন মানুষ জটলা পাকিয়ে ফিসফিস করে আলাপ করছে। সুলতান মাহমুদ বুঝতে পারলেন তারা চুরি করার ফন্দি আঁটছে। কিন্তু তাদেরকে কিছুই বললেন না তিনি। পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় চোরের দল সুলতানের পথরোধ করে দাঁড়ালো এবং তাদের একজন সুলতানকে উদ্দেশ করে বলল: ‘‘এ্যাই কে তুমি? কোথায় যাচ্ছো?’’
চোরের কথা শুনে সুলতান দাঁড়িয়ে গেলেন। এরপর বললেন-
সুলতান: ‘‘আমি তোমাদের মতই একজন মানুষ। তবে তোমাদের কাজে আমি নাক গলাব না আর তোমরাও আমার কাজে বাধা দিও না।’’
চোর: ‘‘বেশ ভাল কথা। আমাদেরও বেশি কথা বলার সময় নেই। তার চেয়ে বল পকেটে কত টাকা আছে।’’
সুলতান: ‘‘পকেটে যদি টাকাই থাকত তাহলে এতরাতে শহরে না বেড়িয়ে ঘরে বসে শান্তিতে ঘুমাতাম। এখন তো আমি টাকার খোঁজেই বের হয়েছি।’’
চোর: ‘‘বাহঃ বাহঃ তুইও দেখছিস আমাদের মত ফন্দি-ফিকিরে আছিস। তুই যদি চালাক-চতুর হয়ে থাকিস তাহলে আমাদের সঙ্গে হতে পারিস। আমরাও তোর মতই বেকার। তাই পরামর্শ করছিলাম আজ কোথায়, কিভাবে চুরি করা যায়। তো এ কাজে তোর কি কোনো অভিজ্ঞতা আছে?’’
সুলতান মাহমুদ জীবনে আর কখনো এ ধরনের চোর-বাটপারের পাল্লায় পড়েননি। তাই তার ইচ্ছে হলো ওদের সঙ্গী হওয়ার। কারণ ওদের সম্পর্কে বিস্তারিত জানা দরকার। তাই তিনি বললেন: ‘‘আমি কি করতে পারব তা বলতে পারছি না, কারণ আগে কখনো এ কাজ করিনি। তবে কাজটা তেমন কঠিন বলে মনে হচ্ছে না।’’
চোর: ‘‘এতো সহজ মনে করিস না। আমরা প্রত্যেকেই কোনো না কোনো গুণের অধিকারী। এসব গুণ ও বুদ্ধি দিয়ে আমরা বিপদ থেকে রক্ষা পাই।’’
সুলতান: ‘‘তাই নাকি! বলো তো তোমাদের কার কি বিশেষ গুণ আছে?’’
চোর: ‘‘আমার গুণ হলো- আমার শ্রবণশক্তি। যখন কুকুর ঘেউ ঘেউ করে তখন আমি জানি কি বলতে হবে।’’
অন্যজনের বৈশিষ্ট্য হলো-তার চোখ। রাতেও অন্ধকারেও যদি সে কাউকে দেখে তাহলে দিনের আলোতে তাকে ঠিকই চিনতে পারে। তৃতীয় চোরের বৈশিষ্ট্য হলো-তার হাত। হাত দিয়ে সে সহজেই ঘরের দরজা জানালা খুলতে পারে। চতুর্থ চোরের গুণ হলো তার নাক। সে মাটির গন্ধ শুঁকেই বুঝতে পারে যে, সেটি সোনার দোকান নাকি কাপড়ের দোকান? আর পঞ্চম চোরের বৈশিষ্ট্য হলো- সে দেয়াল টপকানো কিংবা বাড়ীর ছাদে উঠার জন্য এমনভাবে রশির হুক নিক্ষেপ করতে পারে যেন হুকের কাঁটা ঠিকভাবে বিঁধে যায়। তখন আমরা সবাই রশি বেয়ে সহজেই উঠে যেতে পারি।
চোরদের গুণের কথা শুনে সুলতান মাহমুদ অবাক হয়ে গেলেন। চোরদেরও যে এত গুণ থাকতে পারে তা তার জানা ছিল না। সাথীদের গুণ বর্ণনা করার পর চোরের সর্দার বলল: ‘‘আমাদের কথা তো শুনলে। এখন বল- তোর এমন কি গুণ আছে যা আমরা কাজে লাগাতে পারি।’’
সুলতান: ‘‘তোমাদের যেসব গুণ আছে তা চুরি করতে গিয়ে ধরার না পড়া পর্যন্ত কাজে লাগবে। কিন্তু যদি কোনো কারণে ধরা পড়েই যাও, তাহলে আমি যা জানি তা খুব কাজে লাগবে।’’
চোর: ‘‘তাই নাকি! বল্ তো, তোর মধ্যে এমন কি গুণ আছে যা ধরার পড়ার পর কাজে লাগবে?’’
সুলতান: ‘‘আমার গুণ হলো আমার দাড়ি। কোনো অপরাধী যদি পুলিশ, চৌকিদার এমনকি জল্লাদের হাতেও ধরা পড়ে তাহলে আমি দাড়িতে নাড়া দিলেই সঙ্গে সঙ্গে মুক্তি!’’
চোর: ‘‘তাই তাকি! বড়ই অদ্ভুত গুণ তোর! তুই ঠিকই বলেছিস, আসলে তোর গুণই আমাদের মধ্যে সেরা গুণ। তোর দাড়ির হাজার প্রশংসা। তাহলে আর দেরি নয়, সবাই চলো কাজে নেমে পড়ি।’’
এই বলে সবাই মিলে ডান পাশের রাস্তা ধরে সামনের দিকে এগিয়ে চলল। কিছুদূর যেতেই একটা কুকুরের ঘেউ ঘেউ ডাক শোনা গেল। এ সময় কানের গুণবিশিষ্ট চোরটি জানালো- ‘‘কুকুরগুলো বলছে যে, আমাদের মধ্যে একজন মহান ব্যক্তি আছেন।’’
এ কথা শুনে চোরেরা বলল- ‘‘কুকুর মনে হয় আমাদের নয়া দোস্তের কথাই বলছে।’’
এরপর চোরের দল একটা বাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়াল। তারা প্রত্যেকেই নিজ নিজ গুণকে কাজে লাগিয়ে ওই বাড়ি থেকে সোনা-রূপা ও মূল্যবান জিনিসপত্র চুরি করল। চুরি শেষে তারা সব মালামাল নিয়ে চলে এল শহরের বাইরে এক পরিত্যক্ত বাড়িতে। রাত প্রায় শেষ হয়ে আসায় তারা চুরির মালামাল ভাগাভাগি না করে সেখানেই পুঁতে রাখল।
চোরের সর্দার সুলতান মাহমুদসহ সবাইকে বলে দিল পরদিন রাতে মালামাল ভাগ করা হবে- সবাই যেন ঠিকসময় হাজির থাকে। এরপর সেখানে একজনকে পাহারা দেয়ার জন্য রেখে বাকী সবাই যার যার বাড়িতে চলে গেল। গজনীর সুলতান স্থানটি ভালো করে চিনে নিয়ে প্রাসাদে ফিরে এলেন।
পরের দিন রাতে সুলতানের নির্দেশে তার সেনারা ওই বাড়িতে হাজির হয়ে চোরদের হাতেনাতে ধরে ফেলল এবং মালামালসহ তাদেরকে আদালতে সোপর্দ করল। কাজী সব শুনে জল্লাদকে ডাকার হুকুম দিলেন। এ সময় সুলতান মাহমুদ বাদশাহী পোশাক পরে কাজীর দরবারের হাজির হলেন।
সুলতানকে দেখে চোখের গুণবিশিষ্ট চোরটির টনক নড়ল! সে বুঝে ফেলল, গতরাতে তাদের সঙ্গী হওয়া লোকটি স্ময়ং গজনীর সুলতান। সে কানে কানে তার সঙ্গীদের কথাটা জানিয়ে দিল। এ সময় জল্লাহ হাজির হলো। কাজী চোরদের উদ্দেশে বললেন: ‘‘তোমরা যে অপরাধ করেছ তার শাস্তি চূড়ান্ত হয়ে গেছে। এখন যদি কিছু বলার থাকে তবে বলতে পার।’’
চোর: ‘‘কাজী সাহেব! আমরা যে অপরাধ করেছি তার শাস্তি অবশ্যই মাথা পেতে নেব। কিন্তু আপনি যদি ন্যায় বিচারক হয়ে থাকেন তাহলে সবাইকে শাস্তি দিন। আমরা চুরি করার সময় ছিলাম ছয়জন। কিন্তু শাস্তি দেয়া হচ্ছে পাঁচজনকে। এটা কিছুতেই ন্যায় বিচার হতে পারে না।’’
কাজী: ‘‘তোমরা ছয়জন ছিলে তা তো আমাকে কেউ বলেনি। ঠিকাছে, তোমাদের সঙ্গে কে ছিল তার নাম বল। তাকেও শাস্তি পেতে হবে।’’
চোর: ‘‘মহামান্য বিচারক! আমাদের একটু সময় দিন। আমরা একেকজন একের গুণের অধিকারী। আমরা সবাই চুরি করার সময় নিজ নিজ গুণ কাজে লাগিয়েছি। আমাদের যে সঙ্গীকে ধরা হয়নি তার একটা গুণ আছে। এখন আমরা তার গুণটি কাজে লাগানোর অপেক্ষায় আছি।’’
কাজী: ‘‘আমি অতশত বুঝি না। আমি শাস্তি দেয়ার জন্য জল্লাদকে হুকুম দিতে বাধ্য। একমাত্র সুলতান ছাড়া আরো ক্ষমতা নেই তোমাদেরকে ক্ষমা করার।’’
চোরের সর্দার ও কাজীর কথাবার্তা শুনে সুলতান মাহমুদ মুচকি হাসলেন। চোরের দল ভয়ে বলতেও পারছিল না যে, গতরাতে স্ময়ং সুলতান মাহমুদই তাদের সঙ্গে চুরি করতে গিয়েছিলেন। এসময় এক চোর নিরুপায় হয়ে জোরগলায় বলে উঠল: ‘‘আমরা সবাই করলাম উজাড় যত গুণের হাঁড়িওগো মহান, দিন না নাড়া, আপনার গুণের দাড়ি।’’
চোরের ইঙ্গিতপূর্ণ ছড়া শুনে সুলতান মাহমুদ হেসে উঠলেন। তারপর বললেন: ‘‘চোরের দল যেহেতু অপরাধ স্বীকার করেছে এবং চুরির মালপত্র পাওয়া গেছে তাই এবারের মত ওদের মাফ করে দেয়া হোক। তবে ওদের তওবা করতে হবে যে, জীবনে আর কোনো দিন চুরি করবে না।’’
সুলতানের কথা শুনে চোরের দল তওবা করল এবং সুলতানের নির্দেশে তাদের যার যার গুণ অনুসারের তাদেরকে বিশেষ কাজে নিয়োগ দেয়া হলো।