বিক্রমবর্মা মগধদেশের রাজা ছিল। তার মন্ত্রীর নাম ছিল বিশকুম্ভ। রাজা যত ভালো ছিল মন্ত্রী ছিল তত খারাপ। সে রাজকাছারী, সৈন্যবাহিনী প্রভৃতি রাজার বিভিন্ন দপ্তরে নিজের আত্মীয় স্বজনদের চাকরি দিয়ে ঢুকিয়েছিল। রাজার অজান্তে সে বহু দুষ্কর্ম করত কিন্তু সেই সব কুকাজের খবর যাতে রাজার কাছে না পৌঁছায় সেদিকে তার তীক্ষ্ণ নজরও ছিল। বিশকুম্ভ অতিশয় ধুর্ত হলেও ছিল প্রচন্ড পরিশ্রমী। সে দিনরাত পরিশ্রম করত আর রাজাকে চোখে চোকখে রাখত। কিছুতেই রাজাকে তাঁর রাত্রিকালীন বিশ্রামের আগে চোখের আড়াল করত না। রাজার ইচ্ছা ছিল মন্ত্রীকে পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়ে তার ইচ্ছামত, তার পরিকল্পনার মত দেশ শাসনের কাজ চালিয়ে যাওয়া। কেননা রাজা বিক্রমবর্মা নামে বিক্রম হলেও কাজের বেলায় তাঁর তেমন বিক্রম ছিল না। বরঞ্চ রাজা হিসেবে তাঁর তেমন কোন যোগ্যতা ছিল না বলা চলে।
তাই মন্ত্রীর বিরুদ্ধে আকারে ইঙ্গিতে কোন অনুযোগ এলেও রাজা তাতে কান দিত না। বহু অনুযোগ রাজার কাছে পাঠানো সত্বেও যখন কোন কাজ হল না তখন বিক্রমবর্মার শিক্ষাগুরু রামশর্মা ভাবলেন, সরাসরি রাজার কাছে মন্ত্রীর কুকাজের খবর পাঠাতে হবে। এই কথা ভেবে রামশর্মা একদিন রাজার কাছে এল। গুরুকে দেখে রাজা বিক্রমবর্মা খুব খুশী হয়ে শ্রদ্ধাভরে তাকে বসিয়ে আলাপ আলোচনা করল। তারপর কথায় কথায় গুরুর আসার উদ্দেশ্য রাজা গুরুর কাছ থেকে জানতে চাইল। জবাবে রামশর্মা বলল, “তেমন কোন কাজ নেই, একটু জানতে এসেছি দেশের হালচাল কেমন চলছে।” রাজা তৎক্ষণাৎ বলল, “গুরুদেব, আমি কিভাবে দেশ শাসন করছি তা আমি কি করে বলব। আপনি কিরকম দেখছেন তাই বলুন।” “প্রজারা তো ভালোই আছে। আমার তা মনে হয় প্রজারা তোমার সুগন্ধি বৃক্ষের ছায়ায় আছে। সুগন্ধও পাচ্ছে সব সময়।
তোমার ভালোমানুষীর সৌরভ চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে।” রামশর্মা বলল। গুরু রামশর্মার কথা রাজার কাছে হেঁয়ালির মত লাগল। রামশর্মার কথা সে পরিষ্কার অনুধাবন করতে পারল না। কিন্তু এই কথার মধ্যে যে কিছু একটা গূঢ়তত্ত্ব আছে সেটুকু বুঝল। রাজা একমুহূর্ত নীরব থেকে পরক্ষণেই বলল, “গুরুদেব, আপনি আমার চোখ খুলে দিয়েছেন।” তারপর সেইদিনই রাজা গুপ্তচরের মাধ্যমে দেশের খবর জানার চেষ্টা করলেন। জানতে পারল মন্ত্রীই সবচেয়ে বড় অপরাধ করে বেড়াচ্ছে। পরের দিনই মন্ত্রীকে তার পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হল। সন্ত্রীকে সরানোর পর প্রজাদের মধ্যে আনন্দের জোয়ার বইল।
এত ভাল প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করে রাজা বুঝল যে সে যা করেছে ঠিক করেছে। বেতাল এই কাহিনী শুনিয়ে বলল, “রাজা, এই যে কাহিনী বললাম এর মধ্যে আমার কয়েকটা প্রশ্ন করার আছে। রামশর্মা এসেছিল রাজাকে সবকিছু জানিয়ে দিতে কিন্তু সে তা না জানিয়ে শুধুু রাজার প্রশংসা করেই চলে গেল। যে গুরু মন্ত্রীর নিন্দা করতে এসেছিল সে রাজার প্র্রশংসা করে চলে গেল কেন? আর একটা প্রশ্ন, রাজাই বা রামশর্মা আসার আগে অনেকগুলো অনুযোগ পেয়েও মন্ত্রীর কাজকর্মের ব্যাপারে কোন খোঁজখবর করল না কেন? আমার এই দুটো প্রশ্নের সঠিক জবাব জানা সত্ত্বেও যদি না দাও তাহলে তোমার মাথা ফেটে একেবারে চৌচির হয়ে যাবে।” প্রশ্নের জবাবে রাজা বিক্রমাদিত্য বললেন, “রামশর্মা যে কাজে এসেছিলেন তা সফল হয়েছে। কথা অনেকভাবেই বলা যায়।
সরাসরি মন্ত্রীর বিরুদ্ধে না বলে সূক্ষ্মভাবে রাজাকে বিদ্রপ করে তিনি চলে গেলেন। এর অনেকগুলো কারন রয়েছে। প্রথম কারণ, রাজা রামশর্মার সঙ্গে গোপনে দেখা করেননি। অনেকের মধ্যে দেখা করা, কথা বলা রামশর্মার ভাল না লাগতে পারে। রামশর্মা যদি সেখানে বলতেন, “বিক্রমবর্মা তোমার সঙ্গে গোপন কিছু কথা আছে।’ তাহলে সঙ্গে সঙ্গে মন্ত্রী তার গুপ্তচর লাগিয়ে দিতো। ফলে রাজা এবং রামশর্মার মধ্যে যে কথা হতো সে কথা মন্ত্রী জানতে পারত। যে মন্ত্রী সারা দেশে কুকাজ করে বেড়াতে পারে সে যে কোন মুহূর্তে রাজাকে মেরে ফেলতেও পারে। এই বিষয়টা বুঝতে পেরে রামশর্মা রাজার প্রশংসা করে চলে গেল।
রামশর্মার ঐ একটি কথাতেই কাজ হয়েছিল। এতদিন রাজাকে মনে করা হত তার বুদ্ধি নেই কিন্তু এখন বোঝা গেল রামশর্মার কথা বোঝার মত ক্ষমতা রাজার আছে। সৌরভ ছড়িয়ে পড়ছে শুনেই রাজা বুঝে নিয়েছিলেন যে রাজার কাজকর্মের ব্যাপারে দ্রুত প্রতিক্রিয়া হচ্ছে প্রজাদের মধ্যে। তাই তিনি কালমাত্র বিলম্ব না করে দেশের কাজের খোঁজ নিলেন। খোঁজ নিয়ে গিয়ে কানে টান পড়তেই মাথা এগিয়ে এল। মন্ত্রীর স্বরূপ ধরা পড়ল।” রাজা বিক্রমাদিত্যের এই সদুত্তর শুনে বেতাল খুবই খুশী হল এবং রাজার এইভোবে মুখ খোলার সঙ্গে সঙ্গে সেই শব নিয়ে আবার ফিরে চলে গেল সেই গাছে।