সুখের খোঁজে

জানি কেউ বিশ্বাস করবে না, তারপরও আমি বলে যাব যা আমার সাথে ঘটেছিল মাত্র কয়েক বছর আগে, ২০১০ সালে। ঘটনাটা হল, আমি ছিলাম একা, আমার আপন বলতে যারা ছিল সবাই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছে ২০০৭ সালের একটা ঘূর্নি ঝরে, আমি কিভাবে বেচে ছিলাম জানিনা। শুধু মনে করতে পারি, আমি পরেছিলাম একটা চর অঞ্চলে, যখন আমার জ্ঞান ফিরল দেখলাম, আমার পাশে কেউ নেই। হেলিকাপ্টারে করে একদল উদ্ধারকর্মী এসে আমাকে উদ্ধার করল। তারপর আমিও একটা জীবনের ঘূর্নিপাকে উড়ে শহরে এসে পরলাম। আমার একদিকে ছিল আপন মানুষ হারানর বেদনা অন্যদিকে কঠর পরিশ্রমের শুরু। আমাকে ভর্তি হলাম একটি কারখানায়। কারখানায় অনেক পরিশ্রম করতে হত বিনময়ে সামান্য পরিমান বেতন পেতাম আমি। তবুও ভালই ছিলাম অর্থাৎ খারাপের মধ্যে তুলনামুলক ভাল বলতে যা বুঝায় তাই।

একদিন কারখানায় কাজ করার সময় মারাত্মকভাবে যখম হলাম, আমার দুইহাতের কব্জি পুরে গেল। আমাকে ভর্তি করা হল একটা হাসপাতালে যেখানে হাজার হাজার অসহায় রোগী পরে আছে হাসপাতালের বারান্দায়। আমারও সেখানে কোন মতে একটু যায়গা হল। আমার চিকিৎসা শুরু হল পরের দিন দুপুরের পর। তার আগ পর্যন্ত আমার যে কি যন্ত্রনা হচ্ছিল তা আমি বলতে চাই না, কারন সব কিছু ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। আমি সুস্থ হয়েছিলাম ঠিকই তবে কাজ করার মত না। হাসপাতালে আমাকে কেউ দেখতে আসল না। আমি একবার ভাবছিলাম কারখানায় ফিরে যাব। কিন্তু সাহস পেলাম না, কারন আমি জানতাম আমি দির্ঘদীন কঠিন কোন কাজ করতে পারব না। আমি হাসপাতাল থেকে বের হয়ে যেদিকে ইচ্ছা হাটতে শুরু করলাম। আমার কোন উপায়ছিলনা, পকেটে সামান্য কয়টা টাকা ছিল। আমার ইচ্ছা হচ্ছিল ভাল কোন রেস্টুরেন্টে গিয়ে কিছু খেয়ে আসার যা মন চায়।

কিন্ত ভাল রেস্টুরেন্টে খেতে যাওয়া ব্যায় বহুল যা আমার পকেট বহন করতে পারবে না। তাই ফুটপাতের একটা দোকান থেকে পিঠা জাতীয় কিছু খেয়ে পকেট খালি করে ফেললাম। এখন আমি সম্পূর্ন নিঃস। সব দিক দিয়ে নিঃস। আমার কেউ নেই, পকেটে কোন টাকাও নেই। হাটতে হাটতে একটা ব্রিজের উপর চলে আসলাম। ব্রিজের নিচে পানির স্রোত আমাকে মুগ্ধ করছিল। আমি অপলক চোখে দেখতে লাগলাম প্রবাহরত পানির ভংয়ংকর স্রোত। আমি ব্রিজের পাশে গিয়ে দাড়ালাম, একদম পাশে। আমি জানি আর কয়েকমিনিটের মধ্যে আমার আপন মানুষের সাথে দেখা হবে। আমার মা আমাকে ডাল আর ভাত খেতে দেবে যা ভাল রেস্টুরেন্টের খাবারের চেয়েও সুসাদু। আমার ছোট ভাইটা আমার কোলে এসে ঝাপিয়ে পরবে আর আমার হাতের যন্ত্রনা মুহুর্তে ভুলে যাব যা হাসপাতালের চিকিৎসার চেয়েও ফলদায়ক। আমি স্রোতের দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে চোখ বন্ধ করলাম আর ঝাপিয়ে পরার জন্য প্রস্তুত হলাম।

আমি নিশ্চিত একটু পরেই আমার আপন মানুষদের সাথে দেখা হবে। আমার এতটুকুই আশা। আমি ঝাপ দিব এমন সময় কে যেন আমার হাত শক্ত করে চেপে ধরল। আমি তাকিয়ে দেখলাম, একজন দরবেশ আমার পিছনে দাড়িয়ে আছেন, তার পবিত্র সুন্দর চেহারা আমাকে ভূলাতে পারল না। আমি বললাম, আমাকে ছেড়ে দিন, আমি আর বাচতে চাইনা। এই কষ্টের পৃথিবীতে আর এক মুহুর্তের জন্য থাকতে চাই না। দরবেশ বললেন, তুমি কেন বাচতে চাওনা? তুমিকি জান না কষ্টের বিনিময়ে স্বর্গে যেতে পারবে? আমি চিৎকার করে বললাম, আমি বিশ্বাস করিনা। আমি বাচতে চাইনা। দরবেশ বললেন, আমি বাচতে চাইনা, আপনি আমার হাত ছেড়ে দিন। আমি প্রবল স্রোতের মধ্যে ঝাপ দেব। দরবেশ আমার দিকে মায়াবি দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, আমি তোমার হাত ছাড়তে পারবনা। আমি বললাম, আপনি আমার হাত ছেড়ে দিন, তানাহলে আমি জোর করে ছাড়িয়ে নেব। দরবেশ হাসলেন, বললেন, আমি হাত না ছাড়লে তুমি ছাড়াতে পারবেনা। এবার আমার জেদ বেড়ে গেল। আমি জোরে ঝাকি মেরে হাতটা ছাড়িয়ে নিলাম দরবেশের হাত থেকে।

আমি বুঝতে পারলাম না হঠাৎ এত শক্তি আমার গায়ে কিভাবে আসল। যাই হোক আমি হাত ছাড়িয়ে প্রবল স্রোতের মধ্যে ঝাপিয়ে পরলাম। ধিরে ধিরে নিস্তেজ হয়ে গেলাম। একটা সুদর্শন যুবক এসে আমাকে কোলে তুলে নিল। যুবকটির গায়ে যে সুগন্ধ আর যুবকটি যে সুন্দর, আমি এর আগে কখনও অনুভব করিনি আর দেখিওনি কিশের সাথে তুলনা দেওয়া যায় ভেবে পেলাম না, আমাকে মুগ্ধ করল। আমি তার কোলে শুয়ে আছি ছোট শিশুর মত। আমি লজ্জাও পাচ্ছিনা কারন আমার জীবনের সব কষ্টের সৃতি আমাকে লজ্জা পেতে ভূলিয়ে দিয়েছিল। আমাকে সুন্দর একটা প্রসাধে নিয়ে আসা হল, প্রসাধটি এতই সুন্দর এতই পরিপূর্ন যে তুলনার যোগ্য কিছুই পেলাম না। একনজর দেখে আমি চোখ বন্ধ করে রইলাম। একটা সুন্দর কন্ঠস্বর ভেসে এলো আমার কানে। “ও সম্মানীত অথিতী চোখ খুলে তাকাও। দেখ এখানে কি আছে আর কি নেই। এখানে তুমি সব কিছুই পাবে যা তুমি চাইবে। এখন তুমি চোখ খোল…. ও সম্মানীত অথিতী। আমি চোখ খুলে যা দেখলাম সত্যিই বিশ্বাস যোগ্য না আমার কাছে। আমি দেখলাম সুন্দর প্রসাধের অভ্যান্তরে আমার সব আপনজন সিংহাসনে বসে আছে। আমার মা সিংহাসন থেকে নেমে আমার কাছে ছুটে এলেন, বললেন, আমরা কত চিন্তিত ছিলাম যে তুই পৃথিবীতে কেমন আছিস।

ছোট ভাইটা দৌড়ে আমার কোলে এসে ঝাপিয়ে পড়ল। বাবা কাছে এসে আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। আমি কান্না চেপে রাখতে পারলাম না। মা বললেন, কাদছিস কেনরে বাবা, আজকেতো সব চেয়ে আনন্দের দিন আমাদের। আমি মায়ের কথা মত হাসতে লাগলাম কিন্তু আমার চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পরছিল। মা বললেন, কি খেতে চাস বল, এখানে যা খেতে চাবি তাই পাবি। আমি বললাম, মা আমি তোমার হাতে ডাল ভাত খেতে চাই। মা আমাকে ডাল ভাত এনে দিলেন। আমি খুব মজা করে খেতে শুরু করলাম। এত স্বাধ আমি এর আগে কোনদিন কোন খাবারে পাইনি। আমি এত আনন্দে ছিলাম, আমার চার পাশে অসংখ্য চাকর আমার হুকুমের অপেক্ষায় থাকছে দিন রাত, আমি উড়ন্ত সিংহাসনে বসে আছি, সিংহাসন চলছে মহাশূন্য ভেদ করে, দেখতে লাগলাম গ্রহ উপগ্রহ নক্ষত্র উড়ন্ত পরিদের দল, সে কি এক সুন্দর মুহুর্ত বর্ননা করে শেষ করা যাবে না, কত সময় কেটে গেল আমি টের পেলাম না। সময়ের দিকে একটুও খেয়াল ছিল না আমার। জানি কেউ আমার কথা বিশ্বাস করবেনা , সবাই আমাকে পাগল বলবে। তারপরেও আমি বলে যাব যা ঘটেছিল আমার সাথে। যাকে পাব তার সাথে আমি আমার মনের কথা বলে যাব আর স্বপ্ন দেখতে থাকব দিবা স্বপ্ন যা আমি এর আগে কখনই দেখেনি।

দেখার কথা কখনও ভাবতেও পারিনি। কারন আমাদের জীবনটা অর্থাৎ সীডরের আগের জীবনটা ছিল স্বপ্নের মতই সুন্দর, আনন্দের। হঠাৎ করেই ঝরটা শুরু হল একদিন সন্ধ্যার পর। আমার যখন জ্ঞান ফিরল, যখন আমায় হেলিকাপ্টারে করে আমাদের এলাকায় নিয়ে আসা হল, দেখলাম অসংখ্য লাস পরে আছে এখানে সেখানে, সবাই কান্না কাটি করছে। কিন্তু এত লাশের মধ্য থেকেও আমার আপন জনের লাশগুলো খুজে পেলাম না। এখন কেউ যদি আমাকে পাগল বলে আমি মেনে নেব তারাই ঠিক। কারন পাগল হবার মত কিছু একটা ঘটেছিল আমার সাথে। কিন্তু পাগলের কথা কেইবা বিশ্বাস করবে? তবুও আমি বলে যাব আমার সাথে যা ঘটেছিল, কেউ শুনুক আর না শুনুক। স্বর্গে মা বাবা আর ভাইয়ের সাথে খুব ভাল কাটছিল আমার। কিন্তু আমি সময় সম্পর্কে অজ্ঞ ছিলাম, আসলে সময় জানার প্রয়োজন হত না আমার। কারখানায় কাজ করার সময় খুব বেশি সতর্ক থাকতে হত আমাকে। একটু দেরি হলেই বকুনি শুনতে হত, বেতন কাটা যেত। কিন্তু স্বর্গে তা হয়না। তাই সময়ের ব্যাপারে সতর্ক হওয়ারও কিছু নেই।

আমি শুধু জানতাম, আমার সময় খুব আনন্দে কেটে যাচ্ছে। কিন্তু আনন্দটা তখনই থেমে গেল যখন অনুভব করলাম সেই দরবেশের হাত আমার হাত শক্ত করে চেপে ধরেছে। আমি পিছনে তাকিয়ে দেখলাম আসলেই দরবেশ আমার হাত ধরে আছেন। আমি ব্রিজের উপর দাড়িয়ে আছি। ব্রিজের নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে ভংয়ংকর স্রোত। এবার তার পবিত্র সুন্দর চেহারা আমাকে ভুলিয়ে ফেলল। দরবেশ আমাকে বললেন, এবার বিশ্বাস হচ্ছে তোমার? আমি মাথা নেড়ে জবাব দিলাম, হ্যা। দরবেশ বললেন, আর কটা দিন কষ্ট কর তারপর তুমি নিশ্চিত স্বর্গের স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে যাবে, তোমার আপনজনকে কাছে পাবে। দরবেশের কথার প্রতিবাদ করার সাহস হল না আমার। আমি শুধু মাথা নেড়ে জবাব দিলাম, হ্যা। দরবেশ মুহুর্তে আমার হাত ছেড়ে দিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেলেন। আমি হাটতে শুরু করলাম শহরের মধ্য দিয়ে। ভাল ভাল রেস্টুরেন্ট আমাকে আকর্ষন করলনা। আমি একটা অতিস্বাধারন রেস্টুরেন্টে গিয়ে বসলাম।

সেখানে দেখলাম ২০১৪ সালের একটি ক্যালেন্ডার টানান আছে। আমি একটি ছেলেকে জিজ্ঞেস করলাম, এখানে ২০১৪ সালের ক্যালেন্ডার টানান কেন? ছেলেটা আমার দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে রইল। আমার চেহারায় সরলতম ভাব দেখে বলল, এখনতো ২০১৪ সাল চলছে। আমি অবাক হলাম। জিজ্ঞেস করলাম, এটা ২০১০ না। ছেলেটা মাথা নেড়ে জবাব দিল, না। ছেলেটা আমাকে পাগল ভাবতে পারেনি, বরং সহজ সরল মানুষ ভেবেছিল। আমি হাটতে হাটতে কারখানায় চলে আসলাম। কারখানার লোকেরা আমাকে দেখতে পেয়ে অবাক হয়ে গেল। তারা বলল, এই চার বছর তুমি কোথায় ছিলে? আমি সবকিছু মন খুলে বলতে থাকি তা কেউ বিশ্বাস করুক বা না করুক। হয়ত তারা আমাকে পাগল ভাববে তাতে আমার কিছু আসে যায় না। কারন আমি সত্য বলতে ভালবাসি। আমি কারখানায় পুরোদমে কাজ শুরু করে দিলাম। এখন আমার আর কষ্ট লাগেনা। কারন কষ্টতো মাত্র জীবনের এই কটা দিন। তারপর আমার স্বর্গীয় জীবনের সূচনা ঘটবে। সেখানে আছে সুখ আর সুখ!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরো পড়তে পারেন...

মামুন সাহেবের মুরগি কেনা

রেজা সাহেব নিজ হাতে বাজার করতে পছন্দ করেন। তাইতো প্রতিদিন সকালে হাঁটতে হাঁটতে কাঁচা বাজারে…

ভাগ্যফল – তারাপদ রায়

রবিবারের সকালবেলা উকিলবাবু তাঁর বাইরের ঘরে বসে মক্কেলদের কাজ সারছিলেন। এমন সময়ে এক জ্যোতিষীঠাকুর এলেন।…

চোরের দশদিন, গেরস্তের একদিন

আমার ছোটবেলার দুই বন্ধু পলাশ আর টমাস। টমাস নামটির পিছনে ছোট্ট একটি কাহিনী। ওর আসল…