সুখপুরের টুকি——তামান্না হাফিজ

 

‘হাসতে হবে সুখে দুঃখে,
হাসি থাকতে হবেই মুখে,
নেচে, গেয়ে, হেসে, কেশে,
দুঃখ ভাগাও পাথাল দেশে।
গোমড়া করা মুখটা যার,
গর্দানটা যাবে তার।’

এই জাদুর গানটা যে পারবে সেই সবচেয়ে সুখী। আজকে সুখপুরের টুকি আর থমথম পুরের রাজার গল্পটা বলব তোমাদের। সুখপুরের সবাই ভীষণ সুখী। কারণ সবাই হাসতে জানত। আর সারা দিন ‘হাসতে হবে সুখে দুঃখে… গান করত। তাই তাদের মনের দুঃখগুলো জাদুর মত হাসির সাথে বের হয়ে যেত। এই সুখপুরের শেষ মাথায় থাকত ছোট্ট মেয়ে টুকি। সারা দিন খিল খিল করে হাসত সে।

সুখপুরের পাশে ছিল একটা ইয়া বড় একটা প্রাচীর। ওপাশে কি ছিল সুখপুরের মানুষ জানত না, কেউ যেতেও পারত না এত বড় প্রাচীর টপকে। আসলে কী ছিল জান? ওপারে ছিল থমথম পুর। থমথম পুরের কেউ হাসতেই জানত না। সবাই ছিল গম্ভীর, থমথমে। রাজা ছিল সবচেয়ে থমথমে।

একদিন, টুকি খেলতে খেলতে সেই ইয়া বড় প্রাচীরের কাছে চলে গেল। প্রাচীরের নিচের দিকে একটা ফাটল। ‘ওপাশে কী?’ টুকি ভাবল। ‘একটুখানি উঁকি দিলে কিছু হবে না!!’ টুকি প্রাচীর ফাটল গলে ওপাশে চলে গেল। ‘আরে, এটাতো আরেকটা নতুন দেশ। কিন্তু মানুষগুলো এমন কেন? কারো মুখে হাসি নেই, সবার গালগুলো ফোলা ফোলা, চোখগুলো গোল্লা গোল্লা! সবার এই গোমড়া, গাল ফোলা মুখ দেখে টুকির পেট ফেটে হাসি এল।

‘… হা হা হা … হি হি হি …হো হো হো …’ হসিটার চেপে রাখতে পারল না টুকি। থমথম পুরের সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকল। গোমড়া মুখের আবার অবাক চাহনি… এই দেখে টুকিটা আর জোরে হাসতে লাগল। ‘… হা হা হা হা …হি হি হি হি…হো হো হো হো…।’

এবার টুকির হাসি দেখে, আশপাশের গোমড়া-অবাক মুখো মানুষগুলো পেটে কেমন যেন সুড়সুড়ি শুরু হল। সুড়সুড়িটা আস্তে আস্তে গলা দিয়ে নাকের কাছে চলে আসল। একি, মেয়েটার মত ওদের ও হাহা-হিহি করতে মন চাইছে! ‘হাহা-হিহি’ অসুখটা মনে হয় ওদেরও ধরল, এটা কি ভয়ংকর রোগ রে বাবা! এই নতুন অসুখ তার কথা আগে তো কোন দিন শুনেনি কেউ।। এই কি বিপদ! আর মেয়েটাও তো থামছেই না। টুকিকে ধরে সবাই রাজার কাছে নিয়ে গেল, রাজাই মেয়েটাকে উচিত শিক্ষা দেবেন।

থমথম পুরের রাজা ছিল সবচেয়ে থমথমে, সবচেয়ে গম্ভীর, আর সবচেয়ে গাল ফোলা। আর রাজার এই সবচেয়ে গোল্লা গোল্লা চোখ দেখে টুকির আরও পেট ফেটে হাসি পেল। এবার সবচেয়ে জোরে হেসে ফেলল টুকি।’ … হা হা হা হা হা …হি হি হি হি হি …হো হো হো হো হো…।’

এবার তো আর হাসি থামেই না। রাজা গোল্লা গোল্লা চোখগুলো আরও গোল্লা গোল্লা করে টুকির দিকে তাকিয়ে থাকল। একে তো কঠিন সাজা দিতে হবে রে। এ কোনো জটিল রোগ নিয়ে এলো এই মেয়ে! রাজা হঠাৎ টের পেলেন, তার পেটে কেমন যেন সুড়সুড়ি লাগছে। রাজা একটু নড়েচরে বসলেন। সুড়সুড়িটা আস্তে আস্তে গলায়, তারপরে নাকে এসে খুব জোরে খোঁচা দিচ্ছে।

কী হল কে জানে, রাজারও টুকির মত ‘হাহা-হিহি’ করতে মন চাচ্ছে। অসুখটা কি রাজাকেও ধরে গেল নাকি? এখন কি হবে? রাজা চোখ শক্ত করে বুজে ফেলল, গালে বাতাস ভরে, দম আটকে হাহা-হিহি টা পেটের ভেতর বন্ধ করে রাখল। রাজার এই দশা দেখে এবার টুকি হেসে মাটিতে গড়াগড়ি খেতে লাগল। রাজা আর নিজেকে সামলে রাখতে পারল না। জোরে জোরে, ভুরি দুলিয়ে, মাথা ঝুলিয়ে… হা হা হা হা হা …হি হি হি হি হি … হো হো হো হো হো…’ করে হেসেই উঠল। সে কি আওয়াজ হাসির। রাজা যতই চেষ্টা করছেন হাসি থামাতে, হাসি ততোই জোরে আসছে।

রাজার এই দশা, বাকি সবার কথা আর কি বলবো! রাজাকে দেখে এবার সবাই তো হেসে কুটিকুটি। সে এক মজার দৃশ্য। অনেক হাসা হাসি র পরে একসময় থামল সেই হাসির মেলা। সবার চোখে পানি এসে গেছে। হাসতে হাসতে রাজা টুকির কাছে জানতে চাইল এটা কেমন অসুখ? যে অসুখ সবার মন ভাল করে দিল! টুকি আবার দাতগুলো বের করে হেসে বলল, কে বলেছে তোমাদের এটা অসুখ? এটাই তো সুখ।

‘সুখ পুরেতে থাকি সবাই
হাসা হাসি সুখে…
এর নাম যে হাসি ও ভাই
সবার মুখে মুখে…’

রাজা মহা খুশি, এতদিন কোথায় ছিল এই হাসি? সুখে থাকতে হলে, হাসতে হবে গাল ভরে। রাজা আদেশ দিলেন, এখন থেকে, কেউ গোমড়া মুখে থাকতে পারবে না।

‘হাসতে হবে সুখে দুঃখে,
হাসি থাকতে হবেই মুখে,
নেচে, গেয়ে, হেসে, কেশে,
দুঃখ ভাগাও পাতাল দেশে।
‘গোমড়া করা মুখটা যার,
গর্দানটা যাবে তার।’

এর পর থেকে থমথম পুরে আর কোনো দুঃখ রইল না। থমথম পুরের মানুষগুলো দুঃখকে জয় করতে শিখে গেল। রাজা থমথম পুরের নাম বদলে রাখল খিলখিল পুর। আর দুই দেশের মাঝে কোনো দেয়াল রইল না।

তোমরাও কখনও গোমড়া মুখে থেকো না কিন্তু। মুখটা গোমড়া হলেই ‘হাসতে হবে সুখে দুঃখে…’ গেয়ে, নেচে, খেলে, খিলখিলিয়ে দুঃখকে ভাগিয়ে দেবে। মনে যেন থাকে কথাটা?

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

সম্পর্কিত পোস্ট

দুঃখিত!