সিংহাসন : আপনি কোথায় চললেন মহারাজ?
রাজা অস্থির হয়ে বললেন : জানিনা,তবে এটুকু জানি ওই গদিতে বসার যোগ্যতা আমার নেই।
সিংহাসন : একি বলছেন মহারাজ? ঈশ্বরের যোগ্যতা বিচার হয় বলে তো কখনো শুনিনি।
রাজা বিস্ময় প্রকাশ করে বললেন : কে ঈশ্বর? আমি তো একজন সাধারণ মানুষ যার ছোট্ট ভুলের খেসারত দেশ সুদ্ধ অসহায় মানুষকে দিতে হয়!
সিংহাসন : তাই বুঝি? আপনি যখন বলছেন তাই হবে হয়তো,আসলে আমি তো কখনো ঈশ্বর দেখিনি তবে লোকমুখে শুনেছি তার কথা, একই দেহে রক্ষক আর ভক্ষকের সহাবস্থানই বোধহয় আমার এই ভ্রমের কারণ।
রাজা : কার দেহে রক্ষক আর ভক্ষকের একই সাথে সহাবস্থান? তুমি কি আমাকেই কটাক্ষ করছো?
সিংহাসন : লোকমুখে শুনেছি দ্বাপর যুগে আপনার মতই এক ভীষণ প্রতাপশালী রাজা ছিলেন, একদিকে রাজনৈতিক কুটিলতা ও অন্যদিকে মোহিনী মোহন রূপ তাকে মহাকাব্যের প্রধান পুরুষ বানিয়েছিল ঠিকই কিন্তু তার ‘ভগবান’ উপাধি লাভের পিছনে ছিল ওই একটাই কারণ ‘একই দেহে রক্ষক আর ভক্ষকের সহাবস্থান’। গোবর্ধন পর্বতের আড়ালে তিনি যেমন ছিলেন বৃন্দবাসীর রক্ষক আবার কুরুক্ষেত্রের মহাযুদ্ধে, নিরস্ত্র সারথী বেসে ছিলেন তেমনি নৃশংস ভক্ষক, যার খিদের আয়ু ছিল পুরো ১৮ দিন । আপানার মধ্যেও সেই
একই গুণ প্রথম দিকে আমাকে শিহরিত করলেও শেষমেষ সর্বশক্তিমানের গুনগানই ছিল আমার বাঁচার সম্বল।
রাজা হতাশ হয়ে বললেন : মানে তুমিও আমাকে ভালোবাসো না? ভয় করো শুধু?
সিংহাসন : কি যে বলেন রাজা মশাই! সিংহাসনের আবার ভালবাসা! সে পেতে তো অনেক ভাগ্য লাগে শুনেছি!
যাকে ভালো বাসি,যার একবার ফিরে দেখবার অপেক্ষায় অনন্ত কাল ধরে একইভাবে বসে আছি, কখনো ভ্রম বশত মুহুর্তের জন্যও সে কখনো ফিরে চায়নি আমার মনি মানিক্য ভরা শরীরের দিকে, তার মোহ মায়াহীন হৃদয়,অন্তর্নিহিত প্রকৃত রাজা হওয়ার সকল গুনগুলো উপেক্ষা করে, অজানা কোনো শক্তির ধ্যান মগ্ন হয়ে আছে সেই কোন আদি অন্তহীন সময় ধরে,আর যোগ্যের অহর্নিশ প্রতীক্ষার ফলস্বরূপ আমার কপালে জোটে সব লোভী ক্ষুধার্তের দল,যাদের নিরন্তর খাই খাই দেখে আমার চোখ এখন এতটাই অভ্যস্ত যে তার ব্যতিক্রমের আশা কেউ করলে আমি আড়ালে মুখ চেপে হাসি।
রাজা : শুধু তুমি কেন! আমি নিজেই এখন আর আমাকে সিংহাসনের যোগ্য মনে করি না, তাই তো চলে যাচ্ছি, কিন্তু একটা সত্যি কথা জানতে ইচ্ছা করছে, এই ভয়ানক ভুল টা করার আগেও কি আমি যোগ্য রাজা ছিলাম না বলেই তোমার বিশ্বাস?
সিংহাসন : এই মুহুর্তে সিংহাসনে না বসে থাকলেও আপনি রাজা,যার ওপরে বসে আপনি অন্যের যোগ্যতা বিচার করেন, সে কি করে আপনার যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন করবে বলুন! তবে এটুকু বলতে পারি ক্ষনিকের জন্য হলেও কিছু মানুষের নিশ্চই মনে হয়েছিল আপনি তাদের রাজা হবার যোগ্য আর তাদের সেই মনে হওয়া যতই স্বল্পস্থায়ী হোক,সেই চরম মুহুর্তের সিদ্ধান্তই আপনাকে বসিয়ে দিয়েছিল
এই পরম কাঙ্খিত আসনে নাহলে আপনিও আরও অজস্র রাজা হবার দৌড়ে সামিল মানুষের মত, সময় শেষে আমাকে দূর থেকে দেখেই দীর্ঘশ্বাস ফেলতেন ।
রাজা পাপ বোধে বিচলিত হয়ে বললেন : শুধু একটা ভুলের জন্য সবকিছু বদলে গেল! কেন যে আমি সাড়া দিলাম এই সর্বনাশা যুদ্ধের হাতছানিতে,কেন যে সকল লাভের খেলায় ক্ষতির হিসেব টাই একেবারের জন্যও চোখে পরেনি! আসলে ভয়ঙ্কর জেতার নেশাটাই আজ আমাকে এভাবে সর্বহারা করে দিল।
সিংহাসন : আপনাকে সর্বহারা করে দিল! কি হারিয়েছেন আপনি? সিংহাসন? ব্যাস? ওটুকুই আপনাকে সর্বহারা করে দিল?
একবার ফিরে গিয়ে দেখুন সেই যুদ্ধ ক্ষেত্রে, সাদা লালের মাঝখানে মরা পঁচা গন্ধে জ্ঞান হারানোর আগে নিজের অন্তর্যামী কে জিজ্ঞ্যেস করবেন সর্বহারার মানে, এই মুহুর্তে সে উত্তর আপনি শুনেও বুঝতে পারবেন না।
রাজা : আমি আর পারছি না! এখনি আমার ভুলের প্রায়শ্চিও করতে চাই! আচ্ছা,ক্ষতিপূরণ দিলে কেমন হয়? আমি রাজকোষ ফাঁকা করে দিতেও রাজি।
সিংহাসন : আপনি কী ক্ষতি করেছেন তা জানেন কি? তা না জানলে মিথ্যা ই ক্ষতিপূরণের চিন্তায় ব্যতিব্যস্ত হচ্ছেন!
রাজা কটাক্ষ করে বললেন : বিদ্রুপ করছো? প্রাণ ফেরানোর কোনো উপায় জানা থাকলে কি আমি এখানে এভাবে বসে থাকতাম?
সিংহাসন : প্রাণ ফেরানোর উপায় নাই বা জানলেন, প্রাণ নেবার অগনিত উপায় তো জানেন, এইসব দুর্বল, অসহায়,সর্বহারাদের মরে যাওয়াই ভালো, তাদের নিরন্তর বুক চাপড়ে কান্না রাজার অস্বস্তির কারণ হলে শাস্তি পেতে হবে বৈকি! শ্বাস বন্ধ হওয়ার আগে, তাদের মধ্যে মৃত্যুভয়হীন কিছু মানুষ,শিরদাড়ার জোরে আপনার দিকে আঙ্গুল তোলার চেষ্টা করলেও তা সোজাসুজি আপনার দিকে ওঠার আগেই আপনার প্রহরীর কাটারীর কোপে মাটিতে পড়ে গড়াগড়ি খাবে। কোনো ভয় নেই আপনার, রাজার সিদ্ধান্তের বিচার হয় না পৃথিবীর কোনো আদালতে!
রাজা : তোমাকে ভালোবাসাই আমার কাল হয়েছে, যাবো ভেবেও কিছুতেই যেতে পারছি না,কোন এক অমোঘ শক্তিতে আমাকে যেন কেউ বেঁধে রেখেছে তোমার সাথে!
সিংহাসন : সেই শক্তির নাম ‘লোভ’, মহাকালের মতই সেও অন্তহীন। আপনি মিথ্যাই এত ভাবছেন,আপনার ক্ষনিকের বিচলিত মন দু এক গ্লাস সুরাপানেই শান্ত হয়ে যাবে মহারাজ!
রাজা উত্তেজিত হয়ে টেবিলে রাখা সোনার গ্লাসে সুরা ঢেলে বললেন : সত্যি বলছো? এই দুঃস্বপ্নের দায়ভার আর আমাকে বয়ে বেড়াতে হবে না বাকি জীবন? রাত্রি কাটলেই সব আগের মত হয়ে যাবে?
সিংহাসন : নিশ্চই হয়ে যাবে মহারাজ, একদম সব আগের মত, কিন্তু শুধু আপনার জীবনে!
রাজা : আর বাকি দের?
সিংহাসন : কাদের কথা বলছেন? যুদ্ধ ক্ষেত্রে পড়ে থাকা লাশ গুলো নাকি মৃতের সমান বেঁচে থাকা আত্মীয় স্বজন? নিশ্চই এদের মধ্যে কারো সব ঠিক হওয়ার আশা আপনি করছেন না মহারাজ! আর বাদ বাকিদের তো কিছু বেঠিক ই হয়নি, তাই ঠিক হওয়ার
চিন্তা টা সময় নষ্ট ব্যতীত কিছুই নয়!
সুরার নেশায় মগ্ন রাজা বললেন : মোক্ষম উপায় বাতলেছো! মাত্র ৪ গ্লাসেই অস্থিরতা টা কমেছে, লাল রঙ টা তেমনি স্পষ্ট কিন্তু সাদা রঙ টা আবছা হয়ে আসছে! আমি ভেবে পাচ্ছি না এমন নিশ্চিত ভাবে তুমি বললে কি করে? এরকম অভিজ্ঞতা কি তোমার আগে কখনো হয়েছে?
সিংহাসন : বহুবার! এই আসনে বসা রাজারা তো সেই একই ইতিহাসের বিনা ব্যতিক্রমে পুরাবৃত্তি ঘটিয়ে চলেছেন সেই প্রথম দিন থেকে।আপনার মতই তাদের ক্ষনিকের পাপবোধ দূর করতে, একরাত্রি ভরপেট সুরাপানের পর আরামায়ক বিছানাই যথেষ্ঠ ছিল,আমার দিকে ভালো করে তাকিয়ে দেখুন মহারাজ, কিছু দেখতে পাচ্ছেন?
রাজা নেশাতুর চোখে তাকিয়ে দেখলেন একের পর এক মুখ বদল হচ্ছে তার সাধের সিংহাসনে! বিস্ময়ে।,ভয়ে, উদ্ভ্রান্তের
মত সিংহাসনের কাছে দৌড়ে গিয়ে, গদির ওপরে বসে থাকা ভদ্রলোক কে বললেন, ” আপনি? জার্মান ইতিহাসের পাতায় একটা খুব চেনা ছবির সাথে আপনার মুখের আদল টা যে হুবহু মিলে যাচ্ছে বিশেষ করে আপনার এই গোঁফ টা!
একি আপনি আবার কে? আগের জন কোথায় গেলেন? আমার মাথাটা কেমন যেন গুলিয়ে যাচ্ছে! ওহ মনে পড়েছে, আপনি তো সেই ইরাকের রাজা! কিন্তু এটা তো আমার সিংহাসন,আপনারা কী করছেন এখানে? কী চান বলুন তো? আমার কথার উত্তর না দিয়ে কোথায় চলে গেলেন?
আবার নতুন মুখ! আপনি তো সেই কুখ্যাত আমেরিকার অধিপতি,আপনার হাত তো বিষাক্ত মাকড়সার জাল মশাই,পুরো পৃথিবীকে গিলে ফিলতে ক গ্লাস সুরা লেগেছিল আপনার? আমার ভিতরে খুব কষ্ট হচ্ছে যে! যদিও সিংহাসন বলছিল কাল সকালেই সব ঠিক হয়ে যাবে তবুও আমার ঘুমাতে খুব ভয় করছে, নিজের অভিজ্ঞতা হাতড়ে একটা সত্যি কথা বলুন তো,সুরা পানের পরে ঠান্ডা ঘরে স্বর্গী য় বিছানায় আপনার ঘুম একবারের জন্যও লাল আর সাদা রঙের ভয়ঙ্কর স্ম্র্তি ভাঙ্গিয়ে দেয়নি? কী হলো? কিছু বলছেন না যে?
বিশ্বাস করুন, উত্তর টা আমার জানা খুব জরুরি!
সুরা হাতে খালি সিংহাসনের সামনে বসে থাকা রাজা জ্ঞান হারানোর আগে অদৃশ্য কাউকে অস্ফুটে বললেন, “আপনি? আগের জন
কো ……”
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।