‘এই হাসি শোন!’
কথাটা শুনেই হাসি থমকে দাঁড়ায়। সাহসী মেয়ে হলেও ভয়ও যে কিছুটা পায়নি তা বলা যাবে না। হাসি এদিক ওদিক তাকায়। কেউই নেই। শুধু একটি বিড়াল। কটমট চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে। ডাকল কে? ভুল শুনেছি হয়তো, এ ভেবে হাসি ঘরের দিকে ফেরে। দুপা এগোয়, আবার ডাক,
‘কানে যায় না, শোন!’ এবার ধমক।
হাসি আবার এদিক ওদিক তাকায়, কেউ কোথাও নেই। বিড়ালটা এখনও দাঁড়িয়ে আছে, তাকিয়ে আছে হাসির দিকে। হাসিও এবার তাকায় বিড়ালটির দিকে। বিড়াল কথা বলে ওঠে!
‘হ্যাঁ আমিই ডাকছি।’
বিড়াল কথা বলছে! হাসি স্বপ্ন ভেবে নিজের গায়ে চিমটি কাটে। ব্যথা তো পেলো, তার মানে সে স্বপ্ন দেখছে না। হাসি ভয় পায়। এতো রাতে সে একা, একটি বিড়াল তার সাথে কথা বলছে, চারপাশে বনজঙ্গল। যে কারও ভয় পাওয়ারই কথা। ও, বলাই তো হয়নি। হাসি স্কুলের ছুটিতে গতকালই নানুর সাথে নানুর বাড়ি বেড়াতে এসেছে। রাতে একাই বের হলো টয়লেটে যেতে। আমাদের হাসি আবার খুব সাহসী। যাইহোক বের হয়েই তো এই কা-। বরফ হয়ে বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে হাসি। আস্তে আস্তে প্রশ্ন করে,
‘বিড়াল কথা বলে কিভাবে?’ বিড়ালের সাথে সাথে উত্তর,
‘কিভাবে আবার মুখ দিয়ে।’ বিড়ালটার চোখেমুখে বিরক্তি।
এবার হাসিও বিরক্ত হয়। সে হালকা ধমক দিয়ে বলে,
‘বিড়াল কি কথা বলতে পারে নাকি! কথা তো বলে মানুষ! আর…আর…আর তোতা পাখি আর ময়না পাখি।’
ক্লাস ফাইভে পড়লেও, আমাদের হাসি কিন্তু খুব বুদ্ধিমান, অনেক কিছু জানে সে। যা বলছিলাম। হাসির ধমক খেয়ে বিড়ালটা একটু নরম হয়, বলে,
‘আমি বিড়াল না…’
কথা শেষ হওয়ার আগেই মাঝখানে হিহি করে হেসে ওঠে হাসি, হাসতে হাসতে বলে,
‘না না তুমি বিড়াল না তুমি তো হাতি।’ আবার হাসি।
‘চুপ! একদম চুপ!’ বিড়ালটা গর্জে ওঠে।
থমকে যায় হাসি। হাসিকে চুপ হতে দেখে বিড়ালটি যেন একটু খুশি হয়। সে আবার বলা শুরু করে,
‘কথার মাঝখানে কথা বলবি না। আমি বিড়াল না।’
হাসি এবারও কিন্তু হাসে, তবে মুচকি হাসি। বিড়ালটি বলে যায়,
‘আমার নাম দামোদর। আমি ভূত।’
ভূত শুনেই হাসি অবাক হয়। এর আগে কখনও সে ভূত দেখেনি। বিড়াল দেখেছে অনেক, বিড়ালই যে ভূত সেটা সে আগে জানতো না তো! কেউ সেটা তাকে বলেওনি। নানু যে ভূতের গল্প বলে, সেখানে তো ভূত হয় দেখতে বিশাল, তার বড় বড় দাঁত, ইয়া বড় বড় নখ এবং দেখতে ভয়ঙ্কর। এটা আবার কেমন ভূত, তার নাম আবার দামোদর? বিড়াল বলে যায়,
‘আজ থেকে ২শ বছর আগে আমি মারা গিয়েছিলাম। আমার বাড়ি ছিল কলকাতায়।’ কলকাতার কথা হাসি শুনেছে, হাসি জানে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মও কলকাতায়।
‘আমি ছিলাম এক ডাকাত দলের সর্দার’ দামোদর বলে যায়,
‘আমি মারা যাই এক ইংরেজ পুলিশের গুলিতে। তারপর আমি ভূত হয়ে ফিরে আসি।’
এবার হাসির পালা, সে প্রশ্ন করে,
‘কিন্তু তুমি বিড়াল হলে কি করে?’
দামোদর ধীরে ধীরে বলে,
‘ভূতদের পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে হলে একটি কারও ওপর ভর করতে হয়। অনেক খোঁজাখুঁজি করে আমি কোন ভাল মানুষ পেলাম না, যার ওপর ভর করা যায়। শেষে বাধ্য হয়ে একটি বিড়ালের ওপরই আমাকে ভর করতে হয়।’
হাসির খটকা লাগে, বলে,
‘তুমি নিজে ডাকাত হয়ে ভাল মানুষ খুঁজতে গেলে কেন?’
দামোদর বলে,
‘অনেকে বেঁচে থাকতে ভাল থাকে, মরার পর মন্দ ভূত হয়ে ফিরে আসে, আবার অনেকে বেঁচে থাকতে মন্দ থাকে, মরার পর ভাল ভূত হয়ে ফিরে আসে। মরার পর আমি ভাল ভূত হয়ে যাই, তাই ভাল মানুষ খুঁজতাম।’
সবাই বলে হাসি নাকি খুব ভাল মেয়ে। হাসি তাই ভয়ে ভয়ে দামোদরকে প্রশ্ন করে,
‘তুমি কি এখনও ভাল মানুষ খুঁজে বেড়াচ্ছো নাকি?’
‘না, আর খুঁজে লাভ নেই। আমরা ভূতেরা একবার এক রূপ ধারণ করে ফেললে, আর কোনদিন অন্য রূপ নিতে পারি না।’ দামোদরের উত্তরে হাসি নিশ্চিন্ত হয়। সে জানতে চায়,
‘আচ্ছা তুমি আমার নাম জানলে কিভাবে?’
দামোদর বলে,
‘আমরা ভূতেরা সব জানি। আমি এও জানি তুই ভাল মেয়ে এবং বুদ্ধিমান।’
হাসি খুশি হয়। হাসি আসল কথায় আসে,
‘তুমি আমার কাছে কেন এলে বলো তো?’ দামোদর কাঁচুমাচু হয়ে ফিসফিস করে বলে,
‘আমার না ভীষণ ক্ষিদে পেয়েছে, বিড়াল হওয়ার পর ক্ষিদেটা বেড়ে গেছে। তুই কি আমাকে…’ দামোদর কথা শেষ করে না। হাসি বুঝে দামোদর খাবার চাচ্ছে। একটি কথা তার খুব জানতে ইচ্ছে করছে। সে প্রশ্ন করে,
‘আমি তো শুনেছি ভূতেরা যাদু দিয়ে সব করতে পারে, তাহলে তুমি কেন যাদু দিয়ে খাবার এনে খাচ্ছো না?’
দামোদর দুঃখ নিয়ে বলে,
‘সত্যি আমরা ভূতেরা সব পারি, তবে আমরা নিজেদের প্রয়োজনে কিছু করতে পারি না। আমি যাদু দিয়ে অনেক খাবার আনতে পারি ঠিকই, কিন্তু সে খাবার আমি খেতে পারবো না। বুঝেছিস?’
হাসি বুঝেও চিন্তায় পড়ে। খাওয়াদাওয়া তো শেষ সেই কখন। এতো রাতে দামোদরের জন্য খাবার সে কোথায় পায়? হাসি দামোদরকে দাঁড়াতে বলে, ঘরে ঢোকে। ঘরে কিছুই নেই। রান্নাঘরের কোণায় পড়ে আছে কিছু মাছের কাঁটা। দামোদর বিড়াল হয়েও বিড়াল না, তাকে কি কাঁটা খেতে দেয়া ঠিক হবে? কিন্তু উপায়ও তো নেই। সে কাঁটাগুলো একটি থালায় নিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসে। হাসির লজ্জা লাগছে। কিন্তু দামোদর কাঁটাগুলো পেয়ে খুব খুশি হলো। খুব আয়েশ করে দামোদর ভূত কাঁটাগুলো এক নিমিষে শেষ করে ফেলল। খেয়েদেয়ে সে মহা খুশি। বলল,
‘তোকে অনেক ধন্যবাদ হাসি, আমি অনেক খুশি হয়েছি তোর ওপর। তুই এখন আমার কাছে যা চাইবি তাই পাবি। বল কি চাস?’
আমাদের হাসি দামোদরের কাছে কিছু না চেয়ে বলল,
‘আমি তো তোমাকে কিছুই খাওয়াতে পারিনি। আর কারও উপকার করে বুঝি তার কাছে কিছু চাইতে হয়? আমার সব আছে, আমার কিছুই চাই না, শুধু…’ হাসি কথা শেষ করে না।
দামোদর প্রশ্ন করে,
‘শুধু কি হাসি বল, বল না?’ হাসি বলে,
‘আমার কোন বেস্ট ফ্রেন্ড নেই। তুমি আমার বেস্ট ফ্রেন্ড হবে?’
‘বেস্ট ফ্রেন্ড, সেটা আবার কি?‘ দামোদর বেস্ট ফ্রেন্ড বুঝে না। হাসি বুঝায়,
‘বেস্ট ফ্রেন্ড মানে খুব ভাল বন্ধু।’
‘ওহ্, তাই বল। তোর খুব ভাল বন্ধু নেই, আর আমার তো বন্ধুই নেই। সুতরাং আজ থেকে আমরা একজন আরেকজনের বেস্ট ফ্রেন্ড। ঠিক আছে?’
হাসি খুশি হয়ে বলে,
‘ঠিক আছে। কিন্তু একটা শর্ত আছে।’
দামোদর শর্তটা কি জানতে চায়। হাসি হাসতে হাসতে বলে,
‘আজ থেকে আমিও তোমাকে তুই তুই করে বলবো।’
দুজনেই হেসে ফেলে। দামোদর বলে,
‘আলবাত।’
আর এভাবেই আমাদের ছোট্ট হাসির সাথে বিড়াল রূপী দামোদর ভূতের বন্ধুত্ব হয়ে যায়। এরপর থেকেই হাসির জীবনে ঘটতে থাকে মজার মজার সব ঘটনা।