আগেই বলেছি নবীকে অমান্য করার ফলে কি ভয়াবহ ধ্বংস নেমে এসেছিলো আ’দ জাতির উপর। সে জাতি অহংকারী লোকেরা পৃথিবী থেকে সম্পূর্ণ বিলীন হয়ে যায়। বেঁচে থাকেন কেবল হজরত হুদ (আঃ) আর তাঁর গুটি কয়েক অনুসারী। এঁরা এবং এদের সন্তানরা অনেক দিন আল্লাহর পথে চলতে থাকেন। কিন্তু ধীরে ধীরে তাঁরা মহান আল্লাহকে ভুলে যেতে থাকে। পার্থিব মোহ তাঁদের বিপথে পরিচালিত করে। দুনিয়ার আকর্ষণ তাঁদের পরকালীন সাফল্যের কথা ভুলিয়ে রাখে। ফলে পার্থিব উন্নতির জন্যে তাঁরা নবীর পথ থেকে বিচ্যুত হয়। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় সুবিধা ভোগীরা সমাজের স্বার্থকে নিজেদের মধ্যে ভাগ বাটোয়ারা করে নেয়। এরা মহান আল্লাহকে বাদ দিয়ে ‘যেমনী নাচাও তেমনী নাচি’ ধরনের অনেক দেব দেবীর মূর্তি বানিয়ে নেয়। এভাবে একদিকে তাঁরা শিরক, কুফর ও জাহেলিয়াতের চরম অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়ে পড়ে। অন্যদিকে জৈবিক ভোগ বিলাসের জন্যে পাহাড় খোঁদাই করে প্রাচীন ভারতীয় ইলোরা অজন্তার মতো অসংখ্য মনোহরী প্রাসাদ গড়ে তোলে। এই আল্লাহ্ বিমুখ বৈষয়িক উন্নতি তাঁদেরকে চরম হঠকারি ও অহংকারী বানিয়ে তোলে। এই হঠকারী জাতির নাম কি আপনারা জানেন?
হ্যা, এদের নামই সামুদ জাতি।
সামুদ জাতির আবাস
হুদ (আঃ) এঁর সাথে আ’দ জাতির যে লোকগুলো বেঁচে গিয়েছিলেন, সামুদ জাতি তাঁদেরই উত্তর পুরুষ। পরবর্তী কালে এ বংশের কোন প্রভাবশালী নেতার নামে এরা সামুদ জাতি নামে পরিচিত হয়। প্রথমে ‘আ’দের’ ধ্বংসের পর উত্তর দিকে সরে এসে এরা নিজেদের আবাস ও বসতি গড়ে তোলে। সেকালে এদের আবাস এলাকার নাম ছিল ‘হিজর’। এ কারনে কুরআনে এদেরকে ‘আসহাবুল হিজর’ বা হিজরবাসী নামেও অভিহিত করা হয়েছে।১ (সূরা ১৫ আল হিজর” আয়াত ৮০-৮৪)। তাঁদের সেই ঐতিহাসিক এলাকার বর্তমান নাম হলো ‘ফাজ্জুন্নাকাহ’ এবং ‘মাদায়েনে সালেহ’। এ স্থানটির অবস্থান হিজাজ ও সিরিয়ার গোটা মধ্যবর্তী অঞ্চল জুড়ে।
বৈষয়িক উন্নতি ও নৈতিক অধঃপতন
সামুদ জাতির বৈষয়িক ও নৈতিক অবস্থা ছিল আ’দ জাতিরই অনুরুপ। সামুদ জাতি সমতল ভুমি আর পাহাড়ের গাত্র খোদাই করে গড়ে তোলে ভুরি ভুরি সুরম্য অট্টালিকা। এগুলোর প্রযুক্তিগত কারুকাজ ছিল খুবই উন্নত। তাছাড়া এগুলো ছিল অত্যন্ত বিলাসবহুল। ছিল ঝর্নাধারা, বাগবাগিচা, থরে থরে খেজুরের বাগান। এতো সব প্রাসাদ, মনোরম উদ্যান আর স্মৃতিসৌধ তাঁরা কেন গড়ে তুলেছিল? কুরআন বলছে ‘ফারেহীন’ অর্থাৎ তাঁরা এগুলো গড়ে তুলেছিল গর্ব- অহংকার, ক্ষমতা, অর্থ আর প্রযুক্তিগত উন্নতি দেখানোর জন্যে। ২ (সূরা ৪০ আল মুমিনুনঃ আয়াত ৮৩)
কুরআন আরো বলছে, তাঁরা সাধারন মানুষের উপর যুলুম ও শোষন করে তাঁদের দুর্বল করে রেখেছিল। গোটা জনগনের তুলনায় অল্প সংখ্যক লোকের হাতেই কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়েছিল রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় নেতৃত্ব।
মূর্তি পূজাকে তাঁরা তাঁদের ধর্ম বানিয়ে নিয়েছিল। আর মূর্তিগুলোর উপর পৌরোহিত্য করতো এসব নেতারা। দেব দেবীর মূর্তির নামেই জনগণকে করা হত শোষন। মনগড়া পূজা অর্চনা করার মধ্যেই ছিল তাঁদের যাবতীয় সুবিধা। ধর্মের মুখোশ পরেই তাঁরা আল্লাহদ্রোহীতার নেতৃত্ব দেয়।
এঁর পয়লা সুবিধা ছিল এই যে, দেব দেবীর নামে নেতাদের পক্ষে নিজেদের মনগড়া আইনই জনগনের উপর চাপিয়ে দেয়া ছিল অত্যন্ত সহজ। দ্বিতীয় সুবিধা ছিল, অসাড় দেব দেবীর পক্ষে ঠাকুরগিরি করে জনগণকে শোষণ করার পথ ছিল অত্যন্ত সুগম। তাছাড়া পুরোহিত সেজে জনগনের উপর কৃতিত্ব করা ছিল খুবই সহজ। এভাবে জনগন ছিল সমাজপতিদের দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ। অর্থাৎ জনগন ছিল সমাজপতিদের হুকুমের দাস। সমাজপতিরা ছিলো যালিম, প্রতারক আর শোষক। এই ঘুনে ধরা নোংরা নৈতিক ভিত্তির উপরই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তাঁদের শিল্প, কারিগরি ও প্রযুক্তিগত উন্নতির বাহার। বাইরের চাকচিক্য দিয়ে ঢেকে রেখেছিল তাঁদের ভেতরের কলুষতা।
আলোর মশাল নিয়ে এলেন সালেহ
এই অধঃপতিত জাতিকে মুক্তির পথ দেখানোর জন্যে মহান আল্লাহ্ সামুদ জাতির সবচাইতে সৎ ও যোগ্য ব্যাক্তি সালেহ কে তাঁদের নবী নিযুক্ত করলেন। আল্লাহর বানী আর হিদায়েতের আলো নিয়ে হজরত সালেহ আলাইহিস সালাম হাজির জনগন এবং জাতির নেতৃবৃন্দের কাছে। অত্যন্ত দরদ ভরা হৃদয় নিয়ে তিনি তাঁদের আহবান জানালেন কল্যাণ ও মুক্তির দিকে। আহবান জানালেন তাঁদের মালিক ও প্রভু মহান আল্লাহর দিকে। বললেন-
“হে আমার জাতির ভাইয়েরা, তোমরা এক আল্লাহর হুকুম পালন করো। তিনি ছাড়া তোমাদের আর কোন ইলাহ নাই। নেই কোন হুকুমকর্তা। তিনিই তো যমীন থেকে তোমাদের সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর এখানেই তোমাদের প্রতিষ্ঠিত করেছেন। সুতরাং তোমাদের অপরাধের জন্যে তাঁর কাছে ক্ষমা চাও আর তাঁর দিকে ফিরে এসো। তিনি অবশ্যই তোমাদের দাকে সাড়া দেবেন।” (সূরা ১১, হুদ আয়াত ৬১)
তাঁদের ভাই সালেহ তাঁদের আর উপদেশ দিলেন-
“তোমরা কি ভয় করবেনা? আমি তোমাদের জন্যে একজন বিশ্বস্ত রাসুল। সুতরাং আল্লাহকে ভয় করো আর আমার কথা মেনে নাও। তোমাদের বুঝাবার জন্যে আমি যে এতো কস্ট করছি, এর বিনিময়ে আমি তো তোমাদের কাছে কোন পারিশ্রমিক চাইনা। আমার পারিশ্রমিক তো আল্লাহর দায়িত্বে। তোমাদের এই সব উদ্যান, ঝর্নাধারা, ক্ষেত-খামার, বাগান ভরা রসাল খেজুর আর অহংকার প্রদর্শনের জন্যে পাহাড় গাত্রে নির্মিত বালাখানাসমূহের মধ্যে কি তোমাদের চিরদিন নিরাপদে থাকতে দেয়া হবে? সুতরাং আল্লাহকে ভয় করো আর আমার কথা মেনে নাও। এই সীমালংঘনকারী নেতাদের হুকুম মেনোনা। তাঁরা তো পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করছে। কোন সংস্কার সংশোধনের কাজ তাঁরা করছেনা।” (সূরা ২৬ আশ-শোয়ারা, আয়াত ১৪২-১৫২)
এসব মর্মস্পর্শী উপদেশের জবাবে জাতির নেতারা বললো –
“হে সালেহ, এতোদিন তোমাকে নিয়ে আমাদের কতই না আশা ভরশা ছিল। আর এখন কিনা তুমি আমাদেরকে আমাদের দেব দেবীদের পূজা উপাসনা থেকে বিরত রাখতে চাও। তোমার কোথায় আমাদের সন্দেহ- সংশয় রয়েছে।” (সূরা ১১, হুদ আয়াত ৬২)
সালেহ বললেনঃ
“ভাইয়েরা আমার, তোমরা একটু ভেবে দেখো। আমি যদি আমার প্রভূর পক্ষ থেকে প্রাপ্ত এক উজ্জ্বল প্রমানের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকি আর তাঁর বিশেষ অনুগ্রহেও ধন্য হওয়া থাকি, তবে কে আমাকে তাঁর পাকড়াও থেকে রক্ষা করবে যদি তাঁর নির্দেশের খেলাফ করি? (সূরা ১১, হুদ আয়াত ৬৩)
তাঁদের কল্যাণের পথে আনার জন্যে হজরত সালেহ তাঁদের এতো করে বুঝালেন। কিন্তু তাঁরা বুঝলোনা। তারা শলা পরামর্শ করলোঃ “আমাদের সবার মাঝে সে একজন মাত্র লোক। আমরা সবাই তাঁর অনুসরন করবো? তাহলে আমরা তো ভ্রান্তি আর অগ্নিতে নিমজ্জিত হবো। আমাদের সবার মাঝে কেবল তাঁরই উপর উপদেশ অবতীর্ণ হলো? আসলে সে মিথ্যাবাদী।”
সাধারন জনগনের মন হজরত সালেহ (আঃ) এর উপদেশে বিগলিত হচ্ছিলো। কিন্তু এইভাবে তারা জনগণকে ডেকে এনে আবার বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করলো।
নিদর্শন দেখাবার দাবী
জাতির নেতারা এবার হজরত সালেহ (আঃ) এর প্রতি এক বিরাট চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিলো। তারা বললো-
“তোমার উপর কেউ যাদু করেছে। নইলে তুমি তো আমাদেরই মতো একজন মানুষ। হ্যাঁ তবে তুমি যদি সত্য নবী হয়ে থাকো, তাহলে কোন নিদর্শন দেখাও।” (সূরা ২৬ আশ-শোয়ারা, আয়াত ১৫৩- ১৫৪)
কেউ কেউ বলেছেন, এ কথা বলে তারা একটি বড় পাথর খণ্ডের প্রতি ইঙ্গিত করে বললো- এই পাথরের ভেতর থেকে যদি গাভীন উটনী বের করে আনতে পারো, তবে আমরা তোমার প্রতি ঈমান আনবো এবং তোমার আনুগত্য করবো। তারা মনে করেছিলো, তাঁদের এ দাবী পূরন করা হজরত সালেহ (আঃ) এর জন্যে অসম্ভব। তারপর কি হলো? তারপর হজরত সালেহ তাঁদেরকে নিদর্শন দেখানোর জন্যে আল্লাহর কাছে দোয়া করলেন। তাঁর বুক ভরা আশা ছিলো, নিদর্শন দেখালে হয়তো তারা ঈমান আনবে।
আল্লাহ বললেন- “হে সালেহ, আমি উটনী পাঠাচ্ছি ঠিকই। তবে এই উটনী হবে তাঁদের জন্যে চুড়ান্ত পরীক্ষা স্বরূপ। তুমি স্থির থাকো আর তাঁদেরকে বলে দাওঃ “কূপের পানি পান করার জন্যে তাঁদের মাঝে পালা ভাগ করে দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ একদিন পুরো পানি পান করবে সেই উটনী আর একদিন পান করবে তাঁর সবাই আর তাঁদের পশুরা।” ৩ (সূরা ২৬ আশ-শোয়ারা, আয়াত ১৫৫)
আল্লাহর নিদর্শনের উটনী
ব্যাস, আল্লাহর নির্দেশে সমস্ত মানুষের সামনে পাথর থেকে উটনী বেরিয়ে এলো। হজরত সালেহ এবার উটনীর ব্যাপারে মহান আল্লাহর ফরমান তাঁদের জানিয়ে দিলেন। একটি ছোট্ট ভাষন তিনি তাঁদের সামনে পেশ করলেন –
“হে আমার জাতির ভাইয়েরা, সত্যিই আল্লাহ ছাড়া তোমাদের আর কোন ইলাহ নাই। সুতরাং তোমরা কেবল তাঁরই হুকুম পালন করো। দেখো তোমাদের প্রভূর পক্ষ থেকে তোমাদের সামনে সুস্পষ্ট প্রমান এসে পড়েছে। এটি আল্লাহর উটনী। এটি তোমাদের জন্যে চুড়ান্ত নিদর্শন। সতরাং একে স্বাধীনভাবে ছেড়ে দাও। আল্লাহর যমীনে সে মুক্তভাবে চড়ে বেড়াবে। কেউ তার বিন্দুমাত্র ক্ষতি করার চেষ্টা করো না। তাহলে চরম পীড়াদায়ক শাস্তি তোমাদের গ্রাস করে নেবে। তোমরা সে সময়টার কথা স্মরণ করো, যখন মহান আল্লাহ আ’দ জাতির উপর তোমাদেরকে স্থলাভিষিক্ত করেন এবং এমনভাবে এ ভূখণ্ডে তোমাদের প্রতিষ্ঠিত করেন যে, তোমরা মুক্ত ময়দানে প্রসাদ নির্মাণ করছো আর পাহাড় কেটে বিলাস গ্রহ করছো। সুতরাং মহান আলাহর অনুগ্রহকে স্মরণ করো। দেশে বিপর্যয় সৃষ্টিকারীদের মতো সীমালঙ্ঘন করোনা।” (সূরা ৭ আল আরাফ, আয়াত ৭৩-৭৪)
জাতি বিভক্ত হয়ে গেলো দুইভাগে
মহান নবী হজরত সালেহ (আঃ) এর আহবানে সত্য উপলব্ধি করতে পেরে জাতির কিছু লোক ঈমান আনলো। আল্লাহর পয়হে এলো। নবীর সাথী হলো। তবে এদের সংখ্যা খুবই কম। কিন্তু জাতির নেতারা এবং তাঁদের অধিকাংশ অনুসারী ঈমান গ্রহন করলোনা। এই হঠকারী নেতারা ঐ নির্যাতিত মুমিন্দের লক্ষ্য করে বললো – ‘তোমরা কি সত্যি যানো যে, সালেহ তাঁর প্রভুর রাসুল?’ (সূরা ৭ আল আরাফ, আয়াত ৭৫)
মুমিনরা বললেন –‘আমরা অবশ্যই জানতে পেরেছি এবং তাঁর প্রতি ঈমান এনেছি।’ (সূরা ৭ আল আরাফ, আয়াত ৭৫)
অহংকারী নেতারা বললো- ‘তোমরা যে বিষয়ের প্রতি ঈমান এনেছ, আমরা তা মানিনা।’ (সূরা ৭ আল আরাফ, আয়াত ৭৬)
তারা হত্যা করলো উটনীকে
দেখলেন তো, লোকগুলো কত বড় গাদ্দার। তারাই নবীর কাছে নিদর্শন দাবী করেছিলো। তারাই বলেছিল প্রমান স্বরূপ নিদর্শন দেখাতে পারলে তারা ঈমান আনবে। নবী নিদর্শন দেখালেন। তাঁদের চোখের সামনে এতো বড় ঘটনা ঘটে গেলো। আল্লাহর পক্ষ থেকে আগত নিদর্শন তাঁদের চোখের সামনে ঘুরে বেড়ায়। কিন্তু অঙ্গীকার করেও তারা ঈমান আনলোনা। আসলে সকল নবীর সমকালীন লোকেরাই এভেবে নবীর কাছে নিদর্শন দাবী করতো। কিন্তু তা দেখার পর তারা আর ঈমান আনতোনা। এ জন্যেই আল্লাহ তায়ালা আমাদের নবী হজরত মুহাম্মাদ (সাঃ) –কে বলে দিয়েছেন, তোমার বিরোধীরা যতই নিদর্শন দাবী করুক, নিদর্শন দেখার পর আর তারা ঈমান আনবেনা। ফেরেস্তা এসেও যদি বলে, এমনকি মৃত ব্যক্তিও যদি ঘোষনা দেয়, ইনি আল্লাহর নবী, তবু তারা মানবেনা। যাই হোক আসল কথায় আসা যাক।
আল্লাহর উটনী স্বাধীনভাবে চরে বেড়াতে লাগলো। একদিনের সমস্ত পানিই উটনী পান করতো। তাঁদের ক্ষেত-খামারে সে অবাধে বিচরন করতো। এভাবে বেশ কিছুকাল অতিবাহিত হয়। ঈমান না আনলেও এই অলৌকিক উটের ব্যাপারে তাঁদের মনে ভয় ঢুকে গিয়েছিলো। তাই অনিচ্ছা সত্ত্বেও উটনীকে তারা অনেকদিন বরদাশত করে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা আর ধৈর্য ধরে থাকতে পারলোনা। তারা শলা পরামর্শ করলো। সিদ্ধান্ত নিল উটনীকে তারা হত্যা করবে। কিন্তু কে নেবে উটনীকে হত্যা করার দায়িত্ব? এক চরম হতভাগা এগিয়ে এলো। জাতির নেতারা তাঁর উপরে এ দায়িত্ব সপে দিলো। এক চরম ভয়াবহ পরিনতির ভয় তারা করলোনা। শেষ পর্যন্ত আল্লাহর উটনীকে তারা হত্যা করলো। এভাবে দ্রুত এগিয়ে এলো তারা নিজেদের করুন পরিনতির দিকে। তারপর কি হলো?
আর মাত্র তিন দিন
উটনী হত্যার খইবর পেয়ে, হজরত সালেহ কম্পিত হলেন। কিন্তু আফসোস, তাঁর জাতি বুঝলনা। তাঁর আর কিছুই করার নেই। তিনি দৌড়ে এলেন। তারা বললো- সালেহ, তুমি তো অংগীকার করেছিলে একে হত্যা করলে আমাদের উপর বিরাট বিপথ নেমে আসবে। কোথায় তোমার সেই বিপদ? যদি সত্যি তুমি রাসুল হয়ে থাকো, তবে এনে দেখাও দেখি সেই বিপদ। আল্লাহর নবী সালেহ এবার তাঁদের জানিয়ে দিলেন-
‘এখন তোমাদের শেষ পরিনতির সময় আর মাত্র তিনদিন বাকী আছে। নিজেদের সুরম্য প্রাসাদগুলোতে বসে এই তিনদিন ভালো করে ভোগ বিলাস করে নাও। এ এক অনিবার্য অংগীকার।”(সূরা ১১, হুদ আয়াত ৬৫)
এবার নবীকে হত্যার ষড়যন্ত্র
উটনীকে হত্যা করার পর এবার সামুদ জাতির নেতারা স্বয়ং হজরত সালেহ (আঃ)-কেই সপরিবারে হত্যা করার ফায়সালা করলো। তারা ভাবলো, সালেহই তো আমাদের পথের আসল কাঁটা। সে-ই তো আমাদের ভোগ বিলাসে বাধা দিচ্ছে। আমাদের জীবন পদ্ধতি বদলে দিতে চাচ্ছে। আমাদের ক্ষমতা হাতছাড়া করতে চাইছে। আমাদের সমালচোনা করছে। জনগণকে আমাদের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুলছে। তাঁর কারনেই তো এখন আমাদের উপর বিপদ আসার আশংকা দেখা দিয়েছে। সুতরাং তাঁর ভবলীলা সাঙ্গ করে দিলেই সব চুকে যায়। সামুদ জাতির নয়টি সম্প্রদায়ের নেতারা বসে শেষ পর্যন্ত ঐ তিন দিনের মধ্যেই নবীকে হত্যা করার চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়। তারা আরো সিদ্ধান্ত নেয়, হত্যার পরে সালেহর অলী-অভিভাবক হিসেবে যিনি তাঁর রক্তমূল্যের দাবীদার হবেন, তাঁকে বলবো, আমরা এ হত্যাকান্ডে জড়িত নই। এ ঘটনা কুরআন মাজীদে এভাবে বর্ণনা করেছে-
“শহরে ছিলো নয়জন দলপতি। তারা দেশকে অন্যায় অনাচারে বিপর্যস্ত করে তুলেছিলো। কোন প্রকার ভালো কাজ তারা করতোনা। তারা একে অপরকে বললো- আল্লাহর কসম খেয়ে অংগীকার করো, রাতেই আমরা সালেহ আর তাঁর পরিবারবর্গের উপর আক্রমন চালাবো। তারপর তাঁর অলীকে বলবো, তোমার বংশ ধ্বংস হবার সময় আমরা ওখানে উপস্থিতই ছিলাম না। আমরা সত্য সত্য বলছি।” (সূরা আন নামল ২৭ আয়াত ৪৮-৪৯)
ওদের এই ষড়যন্ত্র সম্পর্কে মহান আল্লাহ্ বলেন- “তারা একটা ষড়যন্ত্র পাকালো আর আমরাও একটা পরিকল্পনা বানালাম। যা তারা টেরই পেলোনা।” (সূরা আন নামল ২৭ আয়াত ৫০)
ধ্বংস হলো সামুদ জাতি
আল্লাহর সে পরিকল্পনাটি কী? তা হলো সামুদ জাতির ধ্বংস। আল্লাহ্ বলেন-
“এখন চেয়ে দেখো, তাঁদের ষড়যন্ত্রের পরিনতি কি হলো? আমি তাঁদের ধ্বংস করে দিলাম, সেই সাথে তাঁদের জাতিকেও। ” (সূরা আন নামল ২৭ আয়াত ৫১)
আল্লাহ্ সামুদ জাতিকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দিলেন। তাঁদের গর্ব অহংকার ও ভোগ বিলাস সব তলিয়ে গেলো। মুফাসসিরগন তাঁদের ধ্বংসের বিবরন দিতে গিয়ে বলেছেন- হজরত সালেহ যে তাঁদের তিন দিনের সময় বেধে দিলেন, তাতে তাঁদের অন্তরে ভয় ঢুকে গেলো। প্রথম দিন তাঁদের চেহারা ফ্যাকাসে হয়ে যায়। দ্বিতীয় দিন তাঁদের চেহারা লালবর্ণ হয়ে যায়, আর তৃতীয় দিনে তাঁদের চেহারা হয়ে যায় কালো। অতঃপর তিনদিন শেষ হবার পরপরই রাত্রিবেলা হঠাৎ এক বিকট ধ্বনি এবং সাথে সাথে ভুমিকম্প শুরু হয়ে যায়। বজ্রধ্বনি আর ভুকম্পনে তারা সম্পূর্ণ বিনাস হয়ে গেলো। মহান আল্লাহ্ বলেন-
“হঠাৎ বজ্রধ্বনি এসে তাঁদের পাকড়াও করলো। যখন ভোর হলো, তখন দেখা গেলো, তারা নিজেদের ঘর দোরে মরে উপর হয়ে পড়ে রইলো, যেনো এসব ঘরে তারা কোন দিনই বসবাস করেনি।”(সূরা ১১, হুদ আয়াত ৬৭-৬৮)
তাঁদের উন্নত প্রযুক্তির সুরম্য অট্টালিকা সমূহের ধ্বংসাবশেষ আজো তাঁদের অঞ্চলে শিক্ষনীয় হয়ে পড়ে আছে।
বেঁচে গেলেন সালেহ এবং তাঁর সাথীরা
তারা হজরত সালেহ- কে হত্যা করার ষড়যন্ত্র করেছিলো যে রাতে, সে রাতেই মহান আল্লাহ্ তাঁদের ধ্বংস করে দিলেন। সে ধ্বংস থেকে আল্লাহ্ পাক হজরত সালে এবং তাঁর সাথীদের রক্ষা করেছিলেন। তাঁদের নিরাপদে বাঁচিয়ে রাখলেন। মহান আল্লাহ্ বলেন-
“অতঃপর যখন ওদের দ্ধংশ হবার নির্দিষ্ট সময়টি আসলো, তখন আমরা সালেহ এবং তাঁর সাহে যারা ঈমান এনেছিল, তাঁদেরকে আমাদের বিশেষ রহমতের দ্বারা রক্ষা করলাম। সেদিনকার লাঞ্ছনা থেকে নিরাপদ রাখলাম। নিশ্চয়ই তোমার প্রভু দুর্দান্ত ক্ষমতার অধিকারী এবং মহাপরাক্রমশীল।” (সূরা ১১, হুদ আয়াত ৬৬)
সামুদ জাতি কেন ধ্বংস হলো?
সামুদ জাতি বৈষয়িকভাবে চরম উন্নতি লাভ করার পরও কেন ধ্বংস হলো? কেন তারা বিলীন হয়ে গেলো? কেন হলো তাঁদের এই অপমানকর বিনাশ? এর কারন খুব সহজ। এর কারন হলো-
১। তারা শিরকে লিপ্ত হয়েছিলো।
২। তারা এক আল্লাহর আইন ও বিধান মেনে নিতে অস্বীকার করেছিলো।
৩। তারা নবী ও নবীর পথকে প্রত্যাখ্যান করেছিলো।
৪। তারা দুষ্কৃতকারী ও দুর্নীতিবাজ নেতাদের অনুসরন করেছিলো।
৫। পরকালের তুলনায় বৈষয়িক জীবনকে তারা অগ্রাধিকার দিয়েছিল।
৬। লাগামহীন ভোগ বিলাসে তারা নিমজ্জিত হয়ে পড়েছিল।
৭। তারা সৎ নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠায় বাধা দিয়েছিল।
৮। আল্লাহর নিদর্শন দাবী করেও তা তারা প্রত্যাখ্যান করেছিলো।
৯। তারা আল্লাহর নিদর্শন উটনীকে হত্যা করেছিল।
১০। তারা আল্লাহর নবীকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র করেছিলো।
১১। তারা অহংকার ও স্বেচ্ছাচারিতার মাত্রা ছাড়িয়ে গিয়েছিলো।
কুরআনে সালেহ ও তাঁর জাতির উল্লেখ
এবার জানিয়ে দিচ্ছি কুরআনে হজরত সালেহ (আঃ) ও তাঁর জাতি সামুদের কথা কোথায় উল্লেখ আছে। হ্যাঁ, আল কুরআনে হজরত সালেহ (আঃ) এর নাম উল্লেখ আছে ৯ বার। যেসব সুরায় উল্লেখ আছে সেগুলো হলো- সূরা আল আরাফ, আয়াত ৭৩,৭৫,৭৭, সূরা হুদ, আয়াত ৬১,৬২,৬৬,৮৯, সূরা শোয়ারা, আয়াত ১৪২, সূরা নামল, আয়াত ৪৫।
আল কুরআনে সামুদ জাতির নাম উল্লেখ আছে ২৬ স্থানে। সেগুলো হলো- সূরা আল আরাফ,আয়াত ৭৩, তাওবা, ৭০, হুদ ৬১,৬৮,৬৮,৯৫, ইবরাহীম ৯, ইস্রা ৫৯, হজ্জ ৪২, ফুরকান ৩৮, শোয়ারা ১৪১, নামল ৪৫, আন কবুত ৩৮, সোয়াদ ১৩, মুমিন ৩১, হামিমুস সাজদা ১৩-১৭, কাফ ১৩, যারিয়াত ৪৩, আন নাজম ৫১, আল কামার ২৩, আল হাক্কাহ ৪,৫, বুরুজ ১৮, আল ফজর, আশ সামস ১১।
কুরআনের সুরাগুলো জানিয়ে দিলাম। সরাসরি কুরআন পড়লে আপনারা নিজেরাই এ ঘটনার আরো অনেক শিক্ষণীয় দিক জানতে পারবেন।
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।