সাফাই অভিযান

“আরে আরে কী করছ! এইখানে এসব ভাতটাত ফেলছ কেন? জায়গাটা নোংরা করছ কেন?” পাশের বাড়ির গৃহ পরিচারিকা সীমাকে রাস্তার ধারে এঁটোকাটা ফেলতে দেখে চেঁচিয়ে উঠলেন চিরন্তন। “নোংরা আবার কোথায় করলাম! এক্ষুণি তো কুকুর, বেড়ালে খেয়ে নেবে,” সীমাও ততোধিক জোরে জবাব দিয়ে গজগজ করতে করতে চলে গেল। চিরন্তনকে নিয়ে এই এক মুশকিল হয়েছে এখন। মাস কয়েক হল রিটায়ার করেছেন, কিন্তু এনার্জি এখনও পুরো দমে, সব সময় কী করি করি ভাব। এর মধ্যে আবার কিছুদিনের জন্যে বিদেশ ভ্রমণ করে এসেছেন।

এটিই আরো কাল হয়েছে। তাঁর শহর যে কত নোংরা, বাসিন্দাদের সিভিক সেন্স কত কম তা নতুন করে বুঝতে শুরু করেছেন। তাই তিনি এখন চতুর্দিক কী করে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখা যায় সেই চেষ্টা শুরু করেছেন। এই জন্যে তিনি সবার সচেতনতা বাড়াবার চেষ্টা করছেন। উদ্দেশ্য নিজের পাড়া পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রেখে পুরো শহরের সামনে একটা দৃষ্টান্ত তুলে ধরা। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে সচতনতা তো বাড়ছেই না, উলটে মাঝেমধ্যেই পাড়াপ্রতিবেশীদের সঙ্গে তাঁর ঝামেলা হয়ে যাচ্ছে। আর এই কাজে পাশেও কাউকে পাচ্ছেন না, এমন কী তাঁর স্ত্রী রুবিকেও নয়। একদিন চা খাবার নেমতন্ন করে প্রতিবেশীদের বাড়িতে ডেকেছিলেন এই নিয়ে কথা বলার জন্যে, কিন্তু কেউ পাত্তাই দেয় নি।
“চিরন্তনদা, কোনো কাজকর্ম নেই? রিটায়ার করে আর সময় কাটছে না? তাই এসব?” “পাগল হয়েছেন? ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়াচ্ছেন? কী হবে এসব করে? আপনি কিছুই পালটাতে পারবেন না, যেরকম চলছে, চলতে দিন।” এই সব শোনা ছাড়া আর কিছুই হল না আর সবাই চলে যেতে রুবির বকুনি, “শুধু শুধু আমাকে দিয়ে এত কাপ চা করালে! কাজের কাজ তো কিছুই হল না,
লাভের মধ্যে আমার সিরিয়ালটা দেখা হল না।” “সিরিয়াল দেখাই জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য নয়। এই যে বাইরে ঘুরে এলে দেখলে কী সুন্দর পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন সব! দেখে মনে হয় না আমাদের শহরটাও এরকম হোক?” “তুমি বিদেশের সঙ্গে আমাদের তুলনা করছ? সত্যিই পাগল হয়ে গেছ তুমি! হাজার চেষ্টা করলেও তুমি রাস্তায় নোংরা ফেলা বন্ধ করতে পারবে না তা সে রোজ সকালে বাঁশি বাজিয়ে যতই জঞ্জাল নেওয়ার গাড়ি আসুক না কেন।” চিরন্তন চুপ করে যান। বিকেলে রিম্পিকে নিয়ে হাঁটতে বেরিয়েছিলেন।

 

রিম্পি ওনাদের পাশের বাড়ি থাকে, বছর তিনেকের মেয়ে। রিম্পি আর তার দাদা রিকি চিরন্তন আর রুবির খুব ন্যাওটা। রিম্পি তো বেশীরভাগ সময় ওনাদের বাড়িতেই থাকে। জেম্মা ছাড়া আর কারুর ক্ষমতা নেই তাকে খাওয়ানোর! রিম্পির হাতে একটা টফি ছিল। সেটা মুখে দিয়ে কাগজটা ছুঁড়ে ফেলতে যাচ্ছিল, চিরন্তন বারণ করলেন। “কেন? সবাই তো ফেলে,” রিম্পির পালটা প্রশ্ন। “সবাই ঠিক করে না। আমরা কি আমাদের বাড়ির ভেতর যেখানে সেখানে কাগজটাগজ ফেলি? ফেলি না তো। তেমনি রাস্তাঘাটেও ফেলা ঠিক নয়,” চিরন্তন রিম্পিকে বোঝাবার চেষ্টা করেন, “আমাদের বাড়িঘর যেমন আমরা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখি তেমন আমাদের আশপাশ রাস্তাঘাটও রাখতে হবে। ফেলে দেবার মতো জিনিস শুধুমাত্র ডাস্টবিনেই ফেলতে হয় বুঝেছ?” রিম্পি কী বুঝল কে জানে, টফির কাগজটা মুঠোর মধ্যেই রেখে দিল, রাস্তায় ফেলল না।
পার্কে রিম্পিকে দোলনা দুলিয়ে নিয়ে ফিরে আসছেন এমন সময় রাস্তা জুড়ে কতগুলো গরু। চিরন্তন বিরক্ত হলেন। গরুগুলো হরেন বলে একটা লোকের। পার্কের কাছেই থাকে, ওর দুধের ব্যবসা। গরুগুলো বেশীরভাগ সময়েই ছাড়া থাকে।

ওদের জন্যে পার্কের ভেতরটাও নোংরা হয়। কাছেই হরেনকে দেখতে পেয়ে চিরন্তন তাকে ডাকলেন, “হরেন, তোমার গরুগুলোকে এরকমভাবে ছেড়ে রেখো না। দেখো বাচ্ছাদের পার্কটা কী রকম নোংরা করেছে।” “গরু আবার কী নোংরা করবে বাবু? গোবরের কথা কইছেন? গোবর তো ভালো জিনিস বাবু। গোবরে কুনো দোষ নাই,” হরেনের উত্তর। চিরন্তন কিছু বলার আগেই মুখ খুলল রিম্পি, “তোমার গরুরা কিছুই জানে না। ওরা রাস্তাতেই হিসি করে, পটি করে।” “খুকুমণি কিন্তু ভালো কইছে বাবু,” হরেন একগাল হেসে বলে, “কিন্তু খুকুমণি ওদের তো তোমার মতো সোন্দর বাথরুম নাই, তাই রাস্তাতেই করে।” আরো কথা বাড়ার ভয়ে চিরন্তন তাড়াতাড়ি রিম্পিকে নিয়ে বাড়ি ফিরে এলেন। লক্ষ্য করলেন রিম্পি টফির কাগজটা বাড়িতে বেসিনের নীচে রাখা ওয়েস্ট পেপার বিনেই ফেলল। চিরন্তন খুশী হলেন। এই সময় রিকি হাজির। রিকিকে দেখে বলা নেই কওয়া নেই রিম্পি দিল এক চিমটি কেটে। “তুই কেন আমাকে চিমটি কাটলি? ঠিক আছে, আমি তোকে চকোলেট দেব না, একাই খাব,” বলে রিকি চকোলেটটা মুখে পুড়ে কাগজটা জানলা দিয়ে ছুঁড়ে ফেলল। ব্যাস আর যায় কোথায়! রিম্পি তারস্বরে চেঁচিয়ে উঠল, “তুই বাগান নোংরা করছিস কেন? ঠিক জায়গায় কাগজ ফেলতে পারিস না?” ওর বলার ঢং এ রিকি থতমত খেয়ে গেল। এমনিতেও রিকি বোনের থেকে ছ’বছরের বড়ো হলেও বোনকে বেশ সমঝে চলে। কারণ তার বোন যে কখন কোথায় কী বলে বসবে তার কোনো ঠিক ঠিকানা নেই! এর আগে দু একবার বন্ধুদের সামনে ওর মার কাছে বকুনি খাওয়ার কথা বলে প্রেস্টিজ একেবারে পাংচার করে দিয়েছিল। চিরন্তন কিন্তু খুব খুশী হলেন। তাহলে আশা এখনও আছে। এরাই তো ভবিষ্যত দেশের। এরা চেষ্টা করলে হবে।

তিনি রিকিকে বললেন, “রিকি, তোর এপাড়ার সব বন্ধুবান্ধবদের একদিন আমাদের এখানে জড়ো করতে পারবি? ছুটির দিন সকালে কী কোনো দিন বিকেলবেলা? যেদিন তোদের আঁকার ক্লাস কি পড়তে যাওয়া টাওয়া নেই। তোদের জন্যে একটা দরকারি কাজ আছে।” “কেন পারব না জেঠু? আমি আজই ফোনে কয়েকজনকে বলে দেব। তাছাড়া কাল তো মাঠে দেখাই হবে। কী কাজ জেঠু?” “সে তখন বলব। তুই আগে সবাইকে নিয়ে তো আয়।” রুবি এতক্ষণ চুপচাপ সব দেখছিলেন, রিকি চলে যেতে বললেন, “বাচ্ছাগুলোকে কেন এসবের মধ্যে জড়াচ্ছ?” “ছোটোবেলা থেকেই অ্যাওয়ারনেস তৈরী করতে হয়, বুঝেছ? তবেই এরা বড়ো হয়ে দায়িত্বশীল নাগরিক হতে পারবে।” রবিবার বেলা এগারোটা নাগাদ পাড়ার বেশীরভাগ ছোটোরা চিরন্তনের বাড়িতে জড়ো হল। তারা সবাই খুব উত্তেজিত কারণ এই প্রথম কেউ ওদের কোনো দরকারি কাজের জন্যে ডেকেছে। ওদের পছন্দসই খাবারদাবারও রয়েছে। ওরা খেতে খেতে চিরন্তনদের বিদেশ ভ্রমণের সিডি দেখল। দেখে তো মুগ্ধ। “এগুলো দেখতে এত ভালো লাগছে কেন বল তো? কারণ সব কী রকম পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন দেখ। পার্কগুলো দেখ কী সুন্দর,” বললেন চিরন্তন। “আর আমাদের পার্ক? হরেনকাকুর গরুর গোবরে ভর্তি,” বলে উঠল দিয়া। “জেঠু, আমাদের খেলার মাঠে তোমার বন্ধুরা হাঁটতে যায়, ওই ঘোষজেঠুরা। ওরা হাঁটার পর মাঠে বসে মাঝেমাঝেই তেলেভাজা খায় আর ঠোঙাগুলো মাঠে ফেলে নোংরা করে,” এবার অভিযোগ অভির। “এই জন্যেই তো তোদের ডেকেছি। তোদের এই সচেতনতাই তো বাড়াতে হবে। সবাইকে বোঝাতে হবে যে যেখানে সেখানে নোংরা ফেলা চলবে না,” চিরন্তন বললেন। “কিন্তু আমাদের কথা কী কেউ শুনবে জেঠু? পাত্তাই দেবে না। তোমার কথাই শোনে না,” বলল জিন্টি। সে একটু বড়ো, ক্লাস এইটে পড়ে। চিরন্তনের আগের চেষ্টার কথা সে জানে। “একজন বললে হবে না, আমরা সবাই মিলে একসঙ্গে বলব। তাহলে একদিন না একদিন মানতেই হবে। আজ থেকেই আমাদের কাজ শুরু করতে হবে। কি রেডি তো আমাদের ইয়ং স্কোয়াড? আমাদের সাফাই অভিযেনের জন্যে?” চিরন্তন জিজ্ঞেস করলেন। সবাই সমস্বরে তাদের সম্মতি জানাল। কীভাবে কাজ শুরু করতে হবে সেসব বুঝে নিয়ে সবাই বাড়ি চলে গেল। এই প্রথম তাদের ওপর ভরসা করে কেউ কোনো কাজের দায়িত্ব দিয়েছে। নয়তো খালিই শুনতে হয়, “এসব ছোটোদের ব্যাপার নয়, যাও নিজের কাজ করো” ইত্যাদি ইত্যাদি। স্বভাবতই ছোটোরা খুব খুশী। দুদিন পর বাজারে চিরন্তনের সঙ্গে অভির বাবার দেখা। দেখা হতেই তিনি বললেন, “সেদিন বাচ্চাদের কী বুঝিয়েছেন দাদা? প্রাণ তো ওষ্ঠাগত! এখানে এই ফেলবে না, ওখানে ডাস্টবিনে ফেলো –

পাগল করে দিচ্ছে। আমাদের কাজের মাসি রাস্তার ধারে সব্জির খোসা ফেলেছিল বলে তো তুলকালাম করল ছেলে। তাকে দিয়ে পরিষ্কার করিয়েই ছাড়ল! নেহাত অভিকে জন্ম থেকে দেখেছে, ভালোবাসে, তাই কিছু বলে নি। আমরা তো ভয় ভয়ে ছিলাম কাজ না ছেড়ে দেয়।” চিরন্তন মুখে কিছু বললেন না, মনে মনে হাসলেন, “তির তাহলে ঠিক নিশানাতেই লেগেছে।”   জিন্টির হাতের লেখা খুব ভালো। সে একটা সাদা কাগজে সুন্দর করে লিখেছে পাড়া পরিষ্কার রাখতে কি কি করণীয়। তার অনেকগুলো ফটোকপি করান হয়েছে। বিকেলবেলা বাড়ি বাড়ি সেগুলো বিলি করতে বেরোল ইয়ং স্কোয়াড। যে বাড়িটা থেকে শুরু করল সেটা অবিনাশ দত্তর, পাড়ায় যিনি বদমেজাজি দত্ত বলে পরিচিত। ছোটোরা পারতপক্ষে ওনার ধারে কাছে ঘেঁষতে চায় না। ওনার বাড়ির দোতলা থেকে রোজ সকালে জঞ্জাল বোজাই একটা প্লাস্টিকের প্যাকেটের পুঁটলি পাশের এক চিলতে ফাঁকা জমিতে ছুঁড়ে ফেলা হয়। হাজার বারণ সত্ত্বেও কোনো ফল হয় নি। চিরন্তনের সঙ্গে তো এই নিয়ে একদিন কথা কাটাকাটি পর্যন্ত হয়ে গেছে। জিন্টি এদের মধ্যে সবচেয়ে বড়ো। সাহস করে সেই আগে এগিয়ে গেল। সঙ্গে বৃষ্টি আর সায়ন, পাড়ায় যাদের ডাকাবুকো বলে বেশ নাম আছে। ডোরবেল বাজান হল, দরজা খুললেন আর কেউ নয়, স্বয়ং অবিনাশদাদু। পাড়ার এতগুলো কচিকাঁচাকে একসঙ্গে দেখে তাঁর ভুরু কুঁচকে গেল। জিন্টির বুক দুরদুর করছিল।

কিন্তু সে মিষ্টি হেসে একটা কাগজ অবিনাশদাদুর হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, “দাদু, আমরা ঠিক করেছি আমাদের পাড়া পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখব, রাস্তাঘাটে নোংরা থাকবে না। এর জন্যে আপনাদের সবার হেল্প দরকার। এই কাগজটায় সব লেখা আছে, প্লীজ এগুলো ফলো করবেন।” অবিনাশ কাগজটায় চোখ বুলিয়ে হেঁড়ে গলায় বললেন, “পড়াশোনা, খেলাধুলো সব ছেড়ে এসব করা হচ্ছে?” “না না পড়াশোনা আমরা ঠিকই করছি। আর খেলব কোথায় বলুন? পার্কটা আর মাঠটা কী বিচ্ছিরি নোংরা হয়ে থাকে। সেজন্যেই তো আমরা এসব করছি,” বৃষ্টি বলে উঠল। “এটা কিন্তু আপনাদের মানে সব বড়োদের পরীক্ষা ধরতে পারেন,” সায়নের সাহস বেড়ে গেছে, “আমরা নজর রাখব কে কতটা নিয়ম মানছে।” সবাই একটা বোমা ফাটার আশঙ্কা করছিল কিন্তু তার আগেই রিম্পি রিকির হাত ছাড়িয়ে সায়ন আর বৃষ্টির মাঝখান দিয়ে ওর ছোট্ট মুখটা বাড়িয়ে হঠাৎ বলে উঠল,

“স্টার না পেলে কিন্তু আমরা পানিশমেন্ট দেব। দেওয়ালের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে।” স্কুলের আন্টিদের কাছ থেকে রিম্পির নবলব্ধ জ্ঞান এটা। ওর নার্সারি স্কুলে কোনো বিষয়ে ফুল মার্কস পাওয়াকে স্টার পাওয়া বলে। রিম্পির এই কথার পর আর কেউ দাঁড়াল না সেখানে, হুড়মুড় করে বেরিয়ে গেল। রিকি চিরন্তনকে বলল, “জেঠু, তুমি বোনকে বাদ দাও দল থেকে। এতক্ষণে বোধহয় অবিনাশদাদু বাড়িতে ফোনও করে দিয়েছে।” “তুই ঘাবড়াচ্ছিস কেন? বলেছে তো রিম্পি, তুই তো আর না। রিম্পিকে বাদ দেওয়ার প্রশ্নই নেই।” এর মধ্যে চিরন্তন নিয়মিত পুরসভায় যাতায়াত করে পার্ক, খেলার মাঠ, দু একটা ফাঁকা জমি যা পড়ে আছে সব পরিষ্কারের ব্যবস্থা করে ফেলেছেন। ততদিনে সবাই পাড়া পরিষ্কার রাখার নির্দেশাবলীও পেয়ে গেছে। দিন কয়েকের মধ্যেই ইয়ং স্কোয়াডের একটা মিছিল দেখতে পেল সবাই, হাতে প্ল্যাকার্ডে “নিজের শহর পরিষ্কার রাখুন,” “যেখানে সেখানে প্লাস্টিকের প্যাকেট ফেলবেন না,” “জঞ্জাল শুধুমাত্র জঞ্জাল ফেলার গাড়িতেই ফেলুন, আশপাশ আবর্জনামুক্ত রাখুন” ইত্যাদি লেখা। শুধু মিছিল বা কাগজ বিলি নয়, ইয়ং স্কোয়াড কাজ করাতেও পিছিয়ে নেই। যাদের বাড়িতে বাগান আছে তারা বাগান পরিষ্কার করা, গাছে জল দেওয়া এসবও করছে। একদিন দেখা গেল খেলার মাঠে বড়োদের ফেলে যাওয়া প্যাকেট, কাগজ ছোটোরা নিজেরা ঝাঁট দিয়ে পরিষ্কার করছে। বড়োরা সেদিন একটু হলেও লজ্জা পেল। পার্কে নতুন লাইট, গাছ লাগান হয়েছে, দোলনাগুলোতে নতুন রঙ হয়েছে। বাচ্চাদের উৎসাহ দেখে কে! কেউ একটা ফুল কি পাতাও ছেঁড়ে না, পারলে দোলনাগুলোও ঝাড়পোঁছ করে! হরেনের গরুদের ঢোকাও নিষিদ্ধ হয়ে গেছে। কিছুদিনের মধ্যেই উন্নতি চোখে পড়ল। বাচ্ছাদের জোরাজুরিতে তাদের বাবা মারাও আস্তে আস্তে সব মানছিলেন। অবিনাশের যদিও এসব মানার কোনো ইচ্ছেই ছিল না কিন্তু তাঁর নাতি নাতনি ইয়ং স্কোয়াডের সদস্য হয়ে যাওয়ায় মানতে বাধ্য হচ্ছিলেন। ইতিমধ্যে রিম্পিদের পাড়ার খবর সারা শহরে ছড়িয়ে পড়েছে। অনেকে দেখেও গেছে, প্রশংসাও করেছে। চিরন্তন পুরো কৃতিত্বই ইয়ং স্কোয়াডকে দেন, বলেন, “ওরাই অসম্ভবকে সম্ভব করেছে।” এর মধ্যে একদিন সারা শহরে মাইক বাজিয়ে ঘোষণা করা হল যে শহরের সব ওয়ার্ডের মধ্যে প্রতিযোগিতা হবে। সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন ওয়ার্ডকে পুরস্কার দেওয়া হবে। সব ওয়ার্ডের মধ্যেই এবার সাজসাজ রব পড়ে গেল। রিম্পিদেরই একমাত্র অত চিন্তা নেই, ওদের পাড়া তো পরিষ্কারই, ওয়ার্ডের বাকি অংশটুকুও ঠিকঠাক করতে তেমন সমস্যা হল না। হঠাৎ একদিন চিরন্তনের কাছে খবর এল যে পার্কে খুব গোলমাল হচ্ছে। তিনি তো শুনেই বেরিয়ে গেলেন। কী ব্যাপার, না পার্কে কে বা কারা একগাদা জঞ্জাল ফেলে গেছে। হরেন দেখেছে তাদের, অন্য পাড়ার কতগুলো ছেলে নাকি। ছোটোরা খেলতে এসে এসব দেখে খুব মনমরা, তাদের চেঁচামিচিতে অনেকে এসেও গেছে। সবাই খুব উত্তেজিত। হরেন বলছে, “এইগুলা অহনই অগো পাড়ায় গিয়া ফালাইয়া আস। পোলাপানগুলার খেলার জাগায় ফালাইল।

বান্দরের পাল!” অবিনাশ হেঁড়ে গলায় চেঁচাচ্ছেন, “হরেন তুই ছেলেগুলোর নাম বল। তারপর আমি দেখছি।” ইয়ং স্কোয়াডেরও তাই মত, এখনই ওদের পাড়ায় যাওয়া হোক। চিরন্তন সবাইকে শান্ত করলেন, বললেন, “না আমরা এসব কিচ্ছু করব না। বড়ো জোর আমরা ওদের বলতে পারি যে এসব করা ঠিক নয়।” উনিই সব পরিষ্কার করে আবার সব ঠিক করার ব্যবস্থা করলেন। দেখতে দেখতে প্রতিযগিতার দিন এসে গেল। বিচারকের দল সব ওয়ার্ড ঘুরে ঘুরে দেখলেন। ফলাফলও ঘোষণা করা হল। ইয়ং স্কোয়াডের প্রত্যাশা মতো তাদের ওয়ার্ডই প্রথম পুরস্কার পেল। চিরন্তন পার্কে একটা ছোটো অনুষ্ঠান করলেন ইয়ং স্কোয়াডকে পুরস্কৃত করার জন্যে। ইয়ং স্কোয়াডের সব সদস্য হইহই করতে করতে স্টেজে উঠল। তাদের আনন্দ দেখে কে! এই সঙ্গে স্কোয়াডের সর্ব কনিষ্ঠ সদস্য রিম্পিকে একটি বিশেষ পুরস্কার দেওয়া হল। সে নাকি একটি অসম্ভব কাজ করেছে যদিও সেটা সর্বসমক্ষে প্রকাশিতব্য নয়। কিন্তু যেটা সবার সামনে বলা যাবে না সেটার প্রতিই সবার কৌতূহল থাকে। তাই সংবাদ সংগ্রহে বিলম্ব হল না। জানা গেল সাফাই অভিযানের সব কিছুই ঠিকঠাক চলছিল। কিন্তু একটা জিনিস কিছুতেই বন্ধ করা যাচ্ছিল না বা বলা ভালো বন্ধ করার কোনো চেষ্টাই করা যায় নি। পাড়ারই এক ভদ্রলোক যাতায়াতের পথে রোজই রিম্পিদের বাড়ির উলোদিকে ইয়ে করেন। এরকমই এক দিন রিম্পি খেলছিল চিরন্তনদের বাড়িতে। এই কাণ্ড দেখে সে চেঁচিয়ে বলল, “জেঠু তুমি কি গরু? তোমার বাড়িতে বাথরুম নেই, তাই তুমি রাস্তায়…….”

ইত্যাদি ইত্যাদি। ভদ্রলোক মুখে তো কিছু বললেন না কিন্তু ভেতরে ভেতরে বিলক্ষণ চটলেন। কিন্তু ওইখানে ওই কম্মোটি করাও বন্ধ করতে হল। চিরন্তনের মতে একেও যদি অসাধ্য সাধন না বলি, তাহলে আর কাকে বলব!

বিল্লুর দস্যিপনা

মধুমক্ষী পালন প্রকল্প

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *