সাদা হাতির অপেক্ষা—শওকত নূর

হাতিটি যখন দু’গাঁয়ের মধ্যকার ফাঁকা জায়গায় এসে হাজির হয়, তখন পড়ন্ত বিকেল। খবর পৌঁছতেই দু’গাঁয়ের লোকেদের মধ্যে তুমুল হইহট্টগোল পড়ে যায়। একই রকমের সাড়া পড়ে যায় আশপাশের পাখপাখালি, কীটপতঙ্গ, ছোট ছোট প্রাণীদের মধ্যেও।

বন অধ্যুষিত দুই গাঁ। লোকেদের মধ্যে সবসময় ঝগড়া ফ্যাসাদ লেগেই থাকত। এ কাজে তারা মধ্যবর্তী ফাঁকা জায়গটিকে ব্যবহার করত। সমবেত হয়ে তারা পরস্পরকে আঘাত করত। প্রায়ই খুন যখম ছিল সাধারণ ব্যাপার। সেদিনও ঝগড়ার উদ্দেশ্যেই তারা জায়গাটিতে দৌড়েছিল। হাতিটিকে দেখে দু’দল দু’দিকে থমকে দাঁড়ায়- উত্তরে উত্তর গাঁ বাসী, দক্ষিণে দক্ষিণ গাঁ বাসী। ভীষণ অবাক তারা। এমন বড় ও সুন্দর হাতি তারা আগে কখনো দেখেনি। যেমন চমৎকার গায়ের গড়ন, তেমন সুন্দর ধবধবে সাদা রঙ, অপূর্ব সুন্দর দুটি দাঁত, নজর কাড়া দু’চোখের মায়াবী দৃষ্টি। এক কথায় অপূর্ব অসাধারণ এক হাতি।

ঝগড়া ভুলে বিস্ময়ে দাঁড়িয়ে থাকে দু’গাঁ বাসী। চমৎকার দৃশ্যের জন্ম দিয়েছে হাতি। সে অত্যন্ত শান্তভাবে শুঁড় নামিয়ে দাঁড়ানো। উত্তর দক্ষিণ – দু’পাশ থেকে এক ঝাঁক করে নানা রঙবেরঙের পাখি পর্যায়ক্রমে ওঠানামা করছে তার পিঠে। ওপরে পতঙ্গ উড়ছে; আশপাশের গাছপালায় জড়ো হয়েছে বানর কাঠবিড়ালি জাতীয় অগণিত প্রাণী। তারা উপভোগ করছে হাতির সাথে রঙিন পাখিদের খেলাটি। এসব দেখে লোকেরা এত মুগ্ধ যে পরস্পরের প্রতি ক্রোধ ভুলে যায় তারা।

একসময় তারা দেখতে পায় তাদের সাথে তাদের ছোট ছোট ছেলেমেয়েরাও এসে যোগ দিয়েছে। তাদের নিয়ে হাতির দিকে এগিয়ে যেতে থাকে তারা। কাছাকাছি হতেই পাখিরা উড়ে গিয়ে স্থান করে দেয় ওইসব ছেলেমেয়েদের। বড়দের সাহায্য নিয়ে তারা দল বেঁধে হাতির পিঠে ওঠে। একবার ওঠে উত্তর গাঁয়ের ছেলেমেয়ের দল, আরেকবার দক্ষিণ গাঁয়ের ছেলেমেয়ের দল। ভীষণ আনন্দ পেতে থাকে তারা।

একটা সময় বড়রাও দল বেঁধে পালাক্রমে উঠতে থাকে হাতির পিঠে। একবার উত্তর গাঁয়ের বড়রা, আরেকবার দক্ষিণ গাঁয়ের বড়রা। তারা এত আনন্দ পেতে থাকে যে খেলাটি খেলতে গিয়ে সময়ে নিজেদের মধ্যকার শত্রুতা পুরোপুরিই ভুলে যায় । রীতিমত পরস্পরের ঘনিষ্ট বন্ধুতে পরিণত হয় তারা। প্রতিদিন পড়ন্ত বেলায় দল বেঁধে তারা ওই ফাঁকা জায়গাটিতে এসে হাজির হয়। হাতি ও প্রতিবেশী গ্রামবাসীদের সাথে বন্ধুত্ব করে মুগ্ধতা নিয়ে সন্ধ্যায় তারা ঘরে ফেরে। এভাবেই কাটতে থাকে তাদের দিন।

হঠাৎ একদিন দু’গাঁয়ের লোকেদের মধ্যে তুমুল শোরগোল পড়ে যায়। সবার অলক্ষ্যে হাতিটি চিৎ হয়ে বনের পাশের গর্ত-কাঁদায় পড়ে গেছে।  এমনই খবর এসেছে সাতসকালে। দলবদ্ধ গর্তের দু’পাশে জড়ো হয়  দু’গাঁয়ের লোক। হাতি উদ্ধারে দলবদ্ধ সর্বশক্তি প্রয়োগ করে তারা। হাতিটির দু’পা রশিতে বেঁধে তাকে কাঁদার উত্তর পাড়ে ওঠাবার প্রাণপণ চেষ্টা করতে থাকে উত্তর গাঁয়ের যত লোক। যদি ওঠাতে পারে তবে তারাই হবে হাতি উদ্ধারকারী বিজয়ী দল, মহান দল। অন্যদিকে হাতিটির অপর  দু’পায়ে রশি বেঁধে তাকে একই রকম শক্তি প্রয়োগে কাঁদার দক্ষিণ পাড়ে টেনে তোলার প্রাণপণ চেষ্টা চালায় দক্ষিণ গাঁয়ের যত লোক। যদি ওঠাতে পারে তবে তারাই হবে হাতিবান্ধব, বিজয়ী মহান দল।

হাতি উদ্ধারে দু’দলে তুমুল প্রচেষ্টা চলে। দৃশ্য দেখতে চারদিক থেকে ব্যাপক লোকসমাগম ঘটে। থেকে থেকে তাদের হর্ষধ্বনিতে, করতালিতে মুখরিত হয় চারপাশ। প্রবল উজ্জীবিত দু’গ্রামবাসী। হাতি উদ্ধারের প্রচেষ্টা ক্রমশ প্রবল বেগ পেতে থাকে। দর্শকরাও ফেটে পড়তে থাকে চরম উৎসাহে। তারা দেখতে ভীষণ উৎসুক- কে হয় হাতি উদ্ধারকারী বিজয়ী দল, কে হয় হাতিমহান তথা হাতিবান্ধব দল। টানছে দু’দল পরম উল্লাসে সমানে সমান। দিন যায়, রাত যায়, পরবর্তী ভোর আসে, ভোর থেকে আরেক ভোর- এভাবে, চলতে থাকে।

লোকজন ক্লান্ত হয়ে খানিক জিরায়,খায়দায়, আবারও টানা শুরু করে। কিন্তু হাতি উদ্ধার হয় না। সপ্তাহ খানেকের মাথায় উত্তর গাঁয়ের ক’জন লোক মশার কাঁমড়ে অসুস্থ হলে তাদের দলটি দুর্বল হয়ে পড়ে। তৈরি হয় দু’দলে ভারসাম্যহীনতা।

এই ফাঁকে দক্ষিণ গাঁয়ের লোকেরা হ্যাচকা টানে হাতিটিকে দক্ষিণ পাড়ে তুলে ফেলে।

হাতিটি পুরোপুরি তাদেরই দখলে চলে যায়। কারণ, তারাই এখন হাতি- মহান, হাতি-বান্ধব, হাতি বিজয়ী দল। তুমুল হর্ষধ্বনিতে তাদেরই গলায় বিজয়ের মালা পরানো হয়। হাতি বিজয়ে তাদের খুশির সীমা পরিসীমা থাকে না। ওদিকে হ্যাচকা টান খেয়ে উত্তর গাঁয়ের  বেশকিছু লোক কাঁদায় পড়ে নতুন করে অসুস্থ হয়েছে। ফলে পুরো দলটিই এখন নাস্তানাবুদ বিধায় হাতির চিন্তা ভাবনা থেকে আপাতত সরে গেছে তারা।

বেশ ক’দিন পার হয়ে গেছে। হাতিটি এখন আর আগের সে  হাতি নেই। আমুল পাল্টে গেছে সে। ভীষণ রোগা হয়ে শরীর শুকিয়ে অর্ধেক হয়ে গেছে। গায়ের সুন্দর রঙটা নষ্ট হয়ে রোদে পুড়ে যাবার মতো কালচে হয়ে গেছে। তার একটা দাঁত ভেঙে গেছে। চোখে নেই  মায়াবী দৃষ্টি। ভীষণ দুর্বল সে। কিছু খেতে চায় না, নড়াচড়াতেও সমস্যা। একবার শু’লে সহজে  আর উঠতে চায় না। জোর করে ওঠাতে হয়। এক ভোরে লোকজন তাকে ওঠাতে গিয়ে অনেক প্রচেষ্টাতেও ব্যর্থ হয়। কিছুতেই ওঠে না সে। অবশেষে লোকজন পরীক্ষা করে দেখতে পায়, সে বেঁচে নেই। মৃত।

হাতির শোকে দক্ষিণ গাঁয়ের লোকেরা ভীষণ বিহ্বল হয়ে ওঠে । কী করে তারা পুষিয়ে নেবে এমন হাতি হারাবার ক্ষতি? অস্থির হয়ে তারা নানা পথ খোঁজে, নানা পরিকল্পনা আাঁটে। অবশেষে হাতির হাট থেকে তারা নতুন এক হাতি কিনে আনে। কিন্তু সে হাতি খুবই সাধারণ; কিছুতেই হারানো হাতির বিকল্প হতে পারে না। মানুষ, পশুপাখি, কীটপতঙ্গ কেউই তার ধার ঘেঁষে না।

লোকজন আসল হাতির পরিবর্তে মাটি দিয়ে বিশাল এক কৃত্রিম হাতি বানিয়ে ধবধবে সাদা রঙ করে। কিন্তু না, এবারেও কেউ এর প্রতি আকৃষ্ট হয় না। লোকজন বসে থাকে না; নিত্য নতুন হাতি বানায়, পরীক্ষা নিরীক্ষা করে। কিন্তু সবই বৃথা, নিষ্ফল। শেষ পর্যন্ত তারা মাথা থেকে হাতির ধারণাটি মুছে ফেলে।

দু’গাঁয়ের লোকেরা ধীরে ধীরে আগের মতো হতে থাকে । সেই ঝগড়া ফ্যাসাদ, খুনখারাবি আবারও তাদের নিত্য সঙ্গী হয়ে দাঁড়ায়। বিকাল হলে শিশুরা এখন কোথাও না বেরিয়ে মুখ ভার করে ঘরের মধ্যে বসে থাকে। কেউ কেউ  আনমনে কাগজে  হাতির ছবি আঁকে।

এখন  শুধু গাঁয়ে গাঁয়ে নয়, একই গাঁয়ের লোকেদের মধ্যেও ফ্যাসাদ কাগে, খুন-জখম হয়।

কিন্তু লোকেরা এমনটি কিছুতে চলতে দিতে চায় না। তারা ভাবে এবং ব্যক্ত করে, সেই হাতি থাকার দিনগুলোই তাদের জন্য ভালো ছিল। তারা তখন ধৈর্যশীল ছিল, পরস্পরের জন্য অপেক্ষা করত, পরস্পরকে সুযোগ দিত। সুখে ছিল তারা।

অবাক হয়ে তারা শুধু সেই হাতিটির কথাই ভাবে। কল্পনা করে, হাতিটি যদি আবারও তাদের মধ্যে ফিরে আসত! সেটি যদি নাও হয় – হুবহু তেমনি অন্য কোন হাতি। কিন্তু কবে আসবে সেই দিন, তারা তা জানে না। তাদের চোখেমুখে এখন শুধুই সাদা হাতির অপেক্ষা!

( ডিসেম্বর, ২০১৮)

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

দুঃখিত!