সাদা রঙের কালো কীট—মহাসিন মহী

সারা পাড়াজুড়ে সবার মুখে মুখে একই কথা, কেন মারবে? মারার কি দরকার, বউ ভাল না লাগলে তালাক ঠুকে দিক তবেই তো ঝামেলা চুকে যায়। এ নিয়ে বার দুই দরবারও হল ছেলে পক্ষ আর মেয়ে পক্ষতে মিলে। কিন্তু কোন সমাধান  নাই, কারণ যখন সবাই এসে জড়ো হয় তখন আর নুরুমিয়া আর উপস্থিত থাকেনা। অথছ কেউ কিছু বললে ওর ওই এক স্বভাব- বউ পেটাবে। পাড়ার কেউ কেউ ইয়ার্কি মেরে বলে- ওই নুরু তুই তো খুব পারিস পেটাতে ভায়ে, আমার গোয়ালের বলদটা বেশ বেড়েচে একদিন সময় করে আয় দিকি একটু ফোঁস ফোঁস করা কমিয়ে দিয়ে যা। বলে আর নুরুকে দেখিয়ে সবাই হো-হো করে হাসে। দেখে নুরুর কান্না পায়। সবাই তাকে নিয়ে তামাসা করে, ইয়ার্কি মারে, রাগে শরীর জ্বলে যায়। তখন ঘরে ঢুকে বউকে বলে তোর জন্যে আমাকে সবাই টিটকায়, ঢেমনি মাগী তুই গলায় দড়ি দিয়ে মরতে পারিস না। নুরুর গালি শুনে বউটা ভয়ে চুপসে থাকে, কথা বলে না।

এতকিছুর জন্যে নুরুকে যতনা যন্ত্রনা পোহাতে হয় তার তিন গুন সহ্য করতে হয় সিরাজ মিয়াকে। সিরাজ মিয়া তারই বড় ভাই। এলাকায় বেশ তার জানাশোনা। দু-দু’বার ইউনিয়ন পরিষদে নির্বাচন করে ফেল পড়েছে। ফেল মারলে কি হবে, তার দাপটের বাহাদুরি কিছুতেই ফেল পড়েনা। একটি রাজনৈতিক দলের বড় নেতাও তিনি। বেশ নাম ডাক। পোশাকে বাহদুরি পারফিউম মেখে যখন পথ ধরে হাটতে থাকে তখন সবাই সালাম করে, সমীহ করে। কেউ কেউ হাতের আঙ্গুল উচিয়ে বলে- দ্যাখ দ্যাখ সিরাজ মিয়া যায়। এলাকার সভা সমিতিতে ডাক পড়ে, দলের মিটিং এ ডাক পড়ে, স্কুলের প্রধান অতিথি হয়, গাঁয়ের রাস্তা ঘাট উদ্বোধন করে। আর এসব সভা সমিতিতে গিয়েই তাকে এমন একটি অনাকাঙ্খিত প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়। বড়রা বলে, সিরাজ তোমার ঘরের ভেজালটা মিটাচ্চনা কেন, এতে তোমার ইমেজ নষ্ট হচ্ছে। সিরাজ নিরুপায়ের মত শোনে যেন এই একটি ক্ষেত্রে তার কিছুই করার নেই। এরই মাঝে কেউ কেউ সিরাজের বুদ্ধির তারিফ করে বলে, সিরাজ আমারে কত বুদ্ধিমান, আর বলেই কি সবই হল শিক্ষার গুন। দেখ মানুষ শিক্ষিত হলে কি হয়, তার ছোট ভাই দু কলম না শিখেই বিয়ে করে কি এক ঝামেলা পাকিয়েছে, এখন না পারছে বউ চালাতে, না পারছে নিজেকে সামলাতে। অথছ সিরাজ আমাদের বিয়ের নাম পর্যন্ত মুখে তুলেনি এখন অবধি। এসব সাফাই শেষ করে কৌশলে বলে ফেলে- সিরাজ বিয়ে শাদি কর এবার, এভাবে একা একা আর কত? সিরাজ তখনও চুপ থাকে, মনে হয় মুখ নিচের দিকে নামিয়ে মনে মনে হাসে।

আজও জাহানাবাদে একটা মিটিং ছিল তার, সেখান থেকে ফিরতে রাত হয়ে গেল। প্রায়ই তার বাড়ি ফিরতে রাত হয়, কিন্তু আজ একটু রাত বেশিই হল। তাই সাথে একজন সঙ্গী নিয়ে কিছুটা পথ এগিয়ে নিলো। বলা তো যায়না, দিন কাল যা হয়েছে, দিন দুপুরে অহরহ মানুষ হজম হচ্ছে, শিয়াল কুকুরের খাবার হয়ে যাচ্ছে। তাছাড়া দল রাজনীতি করা মানুষ সে, ভেতরে ভয় একটু বেশিই বৈ কি! মাস্টার পাড়া পার হলেই ছোট্ট একটা ডাঙ্গা, আর ডাঙ্গাটা পার হলেই তার গ্রাম কৃষ্ণপুর। ছোট্ট এই গ্রামের শেষ পাড়াতে তার বাড়ি। আজও বাড়ি ফিরে তাকে শুনতে হল একই কাহিনী, নরু বউটাকে পিটিয়ে একেবারে আধমরা করে ফেলে রেখে সন্ধ্যা থেকে উধাও। বুড়ো মা-টা তার ছেলের বউয়ের মাথায় পানি ঢালছে আর চোখ মুছে বড় ছেলের কাছে নালিশ দিয়ে বলছে- সব লোকের বিচার করতে পারিস, নিজের লোকের পারিস না ক্যান, হোক পরের মেয়ে-ওতো মানুষ। কেউ মারে এভাবে? মায়ের চিল্লাচিল্লি শুনে পাড়ার লোকেরাও ছুটে এল- এই মধ্য রাতে। পাড়ার লোকেরা এসেও  নরুর বিরুদ্ধে  নালিশ করল। সবই শুনল সিরাজ। কিন্তু কারও কথায় কোন উত্তর করল না। তারপর সিরাজ এই মাঝ রাত্তিরে গাঁয়ের রঘু ডাক্তারের কাছে থেকে কিছু ব্যথা নাশক ঔষধ এনে মায়ের হাতে দিয়ে বউটাকে  খাওয়াতে  বলল। মা বোধহয় বউটাকে ডেকে টেনে ঔষধগুলো খাওয়ায়।

রাত ভারি হয়, নুরু ফিরেনা। আর সে ফিরবেও না দু’ তিন দিনে। হয়ত দু’তিন পরে ফিরে সংসারের ক্ষতি হয়েছে বলে বউকে গাল মন্দ করবে, তারপর আবার সব ঠিক হয়ে যাবে। বউকে ভালবাসবে, বউয়ের সাথে বসে বসে রাধবে, যেন কিছুই হয়নি দুজনার। কিন্তু দিন কয়েক পার হতে না হতেই আবার সেই আগের দশা। কেউ কেউ বলে, ওর বোধহয় মাথা খারাপ হয়েছে। কিন্তু এ নিয়ে বউটা কোন কথা বলে না, একেবারে চুপচাপ- আর এই চাপা স্বভাবের দরুনই বোধহয় বউটাকে কেউ দোষ দিতে পারে না।
সিরাজ বউটার পাশে বসে বুড়ো মাকে ঘুমাতে পাঠায়। দেখে চোখে জল আসে মায়ের, ছেলে তো যেন সোনার টুকরা। মা আত্ম তৃপ্তিতে স্বত্বির নিঃশ্বাস ফেলে ঘুমুতে যায়। রাত ভারি হলে বউটারও বুঝি হুস হয়, সেও নাড়া দিয়ে উঠে। তারপর সিরাজ গলাটা নামিয়ে বউটাকে জিজ্ঞেস করে- এখন কেমন লাগছে? বউটা কোন কথা বলেনা, সিরাজের একটা হাত চেপে ধরে চাপা গলায় হু- হু করে কেঁদে উঠে। তারপর দু’জনেই চুপ থাকে। একেবারে সুনশান নিরবতা- এই নিরবতা সিরাজের ভেতরটাতে আরও বেশি ঘা দিতে থাকে। কতক্ষণ পর সিরাজ আবার ফিসফাস করে বউটার কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে বলে- নরু জানাল কিভাবে? বউটা অনেকটা দৃঢ় স্বরে বলল, আমিই বলে দিয়েছি। তুমিই বলেছ!!! সিরাজ খেই দিয়ে উঠে আবার পরক্ষণে শান্ত হয়। তারপর সিরাজ কাঁদে, নিজের প্রতি ঘেন্নায় সারা রি রি করে উঠে তার। রুবি তুমি বলতে পারলে? কথাটা বোকা এবং অসহায়ের মত শোনাল তার মুখে। এবং রুবি নামটা নিজের মুখ দিয়ে বের করার পর নিজেই কিছুটা অবাক হয়ে গেল সে। তারপর আরাকটু রুবির কাছে সরে এসে বলল, এখন আমার বেঁচে থাকার চেয়ে মরে যাওয়াই ভাল। এতক্ষণ পর রুবি শান্ত অথচ দৃঢ়তার সাথে বলল, আমিও তাই চাই, আপনি মরুন। তারপর সিরাজ পাগলের মত প্রলাপ বকতে বকতে বেরিয়ে গেল- হ্যা আমি মরব, আমার মরণ হওয়াই ভাল, ছোট ভাইয়ের বউকে ছিঃ ছিঃ। নুরু কোথায় তুই, আয় ভাই তুই আমাকে খুন করতে না চেয়েছিলি। আয় আজ তুই আমাকে খুন কর! পাগলের মত প্রলাপ বকতে বকতে সিরাজ বের হয়ে যায় অন্ধকারের মধ্যে।

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

দুঃখিত!