এক.
আমার রাতে ঘুম ভাঙল। সারা ঘরে সবুজ রঙা ডিমলাইটের আবছা আলো। আমাদের পুরাতন ঘড়িটা টিকটিক করে সময় গুনে চলেছে। ঘুম ভাঙ্গার সাথে সাথে আমি পাশে হাত দিলাম। মা পাশে নেই। আমার আবছা আলোতে মনে হতে লাগলো,দূরে কিছু একটা নড়ে উঠল। মায়ের উপর রাগ হল অনেক। আমার বয়স সবে ৬-এ পড়েছে। রাতে ঘুমানোর আগে আমি বিছানার নিচে একবার খুজে নেই,কিছু আছে নাকি। আমি জানি রাতে কিছু একটা উঠে আসবে বিছানার নিছ থেকে,আমি জানি না,আমি অনেক চিৎকার দিব,আমাদের পুরনো বাড়ির প্রতিটা কড়িকাঠ জানি চমকে উঠবে। অনেক গরম লাগছে তাও আমি কাঁথাটা আরেকটু তুলে দিলাম। এমন সময় এলো শব্দটা। প্রায় প্রতিদিন শুনি। আমি জানি না,আমাদের এই পুরনো বাড়ির বাইরে কি অনেক দূর পর্যন্ত খালি হয়ে উঠেছে কিনা,আমার রোমগুলো খাড়া হয়ে উঠে। আমি জানি এই বিশ্বে এখন আমি ছাড়া কেউ নেই,কাঁথাটা তুলে নিলাম,আমি ডুব দিলাম।
আমি ওর নাম জানি না। ও জলকন্যা,আমাদের মত ওর কোন পা নেই। আমি ওর সাথে খেলি। আমি যখন ভয় পাই,ও আমাকে সাহস দেয়,সব কিছুর মাঝে আমি ওকে দেখে সাহস নিই। আমি ওকে অনেক বার জিজ্ঞাসা করেছি ওর নাম কি। কেন জানি বলে না। আমি ও জানতে চাইনি। ওর কাজ আমাকে সাঁতার শিখানো। আমি জল ভয় পাই,ও আমাকে গভীর জলে টানে। আমি ওকে জড়িয়ে ধরে থাকি,আমি জানি সূর্যের আলো পড়ে ওর শরীর উজ্জ্বল রুপালি রঙে ঝলসে উঠবে। আমার চোখ বন্ধ করে থাকাই ভালো।
দুই.
ঘুম ভাঙ্গার পর অনেকটা সময় যায় আমার মানিয়ে নিতে। আমি আয়নার সামনে দাড়িয়ে থাকি,বারান্দায় এক জায়গায় হেটে বেড়াই,তারপর চুলাতে পানি বসিয়ে কফি বানাই,ভয়ানক কালো কফি খেলে ঘুম যেন ভয়ে ভেগে যায় এমন। কিছুতেই কিছু হয় না,আর মাত্র ২টা পরীক্ষা আমার এইচএসসি শেষ হবে। কেমিস্ট্রি ভয়ানক ভয় পাই, কিছুই পড়া হয়না মনে হয়। আমি সোফাতে হেলান দিয়ে শুয়ে সকালে আলতো রোদ দেখি। এমন সময় আমার খোলা খাতার দিকে চোখ যায়, অসংখ্য আকিবুকি। সাথে সাথে মাথায় সেই ভোঁতা ব্যাথাটা শুরু হয়। ভারী কণ্ঠস্বর। মাথায় হাত দিয়ে বসে থাকি। একসাথে দুই দিকে
মন দেওয়া খুব কঠিন কাজ। আমি একদিকে রাসায়নিক বিক্রিয়া দেখি,আরেকদিকে আরেকজন অদ্ভুত অদ্ভুত কথা বলেই যাচ্ছে। আমি জানি সে সত্যি না, কিন্তু তার কথা আমি অগ্রাহ্য করতে পারি না। সে অন্ধকার অতীত দেখতে ভালবাসে, নোংরা আনন্দ নিতে চায় বারবার। আমি জানি না, কি করলে মুক্তি পাবো,আমি জানি সে সত্যি না। আমি হেটে বেড়াই,হাটতে হাটতে আমি ক্লান্ত হই তাও সে আমাকে ছাড়ে না। আমি প্রথম দিকে চাইতাম কানে হাত দিয়ে তাকে অগ্রাহ্য করতে। সে হাসে। ও জানে ওর বাস আমার মাথার ভেতর,আমি জানি আমার মুক্তি নেই,কিছুতেই নেই।
পরীক্ষা হলে বসে আমি বুঝতে পারলাম অধিকাংশ জিনিস আমার জানা,কিন্তু কিছু লিখতে আমি মন দিতে পারছি না। আমি জানি এর শেষ কোথায়,আমি জানি একদিন এই কণ্ঠস্বর আমাকে গ্রাস করবে। আমি আলাদা কেউ থাকবো না। ছোটবেলায় কোন একটা গল্পে পড়েছিলাম,এটাই হয়। ট্র্যাজেডি,জীবনের আসল গন্তব্য।
তিন.
আমি জানি না,এই গাছটার মধ্যে কি আছে। কিন্তু ইদানিং আমি গাছটার মাঝে থাকি। সকালে আসি,সন্ধ্যার আলো মিলালে ফেরত যাই। আমি জানি আমাদের মাঝে অর্থপূর্ণ আলোচনা হচ্ছে,আমি জানি সে আমার দুর্বলতা নিয়ে কথা বলছে,আরও বলছে সবাই দুর্বল,কিন্তু আমাদের একটা ধারণা আছে…
চার.
মেয়েটা সামনে বসে আছে। অনেক ক্ষণ ধরে কথা বলছে আমি শুনছি বলে মনে হচ্ছে না। আমি মেয়েটার তিলটা দেখছি। নিজের বয়ঃসন্ধির এই সময়টা নাকি মেয়েদের অনেক ভালো লাগে। আমি জানি মেয়েটা আমাকে ভালবাসে,আমি আরও জানি ভালবাসা বলতে কিছু আছে বলে আমি মনে করিনা। তাও আমার ভাবতে ভালো লাগছে,ভালবাসা জিনিসটা খারাপ না। আমি এখন মেয়েটাকে কল্পনা করছি নলকূপের ঠাণ্ডা পানির মত,সাথে সাথে সকালের কোমল রোদের মাঝে সামনের পুরো ধানক্ষেত আমার সামনে স্পষ্ট হয়ে যায়। আমি বুঝতে পারি,আমার মানুষের সাথে যোগাযোগের অবস্থা দিনদিন খারাপ হচ্ছে। আমি হেসে বললাম,ওডেসিয়াসেসের এক দ্বীপে আটকে থাকার কাহিনী জানো? সে কিছু একটা মন দিয়েই বলছিল মনে হয়,অবাক হয়ে তাকায়। আমি অন্য দিকে তাকিয়ে থাকি,আমি বুঝতে পারছি আমার মাথা আস্তে আস্তে কেমন জানি একটা প্যাঁচের মাঝে দিন দিন আটকে যাচ্ছে। আমি হেসে বললাম,কি যেন বলছিলে?
পাঁচ.
আমার চোখে সবকিছু ঝাপসা হয়ে আসছে। আমার হাত অবশ হয়ে আসছে আমি জানি। আমি ওর পায়ের নিচে আস্তে করে আকিবুকি করে চলেছি। সূর্যের চিহ্ন,একটা দ্বীপ যেখানে কখনো সূর্য অস্ত যায়না।
আমার চোখ আরও ঝাপসা হয়ে আসছে,ইচ্ছা হচ্ছে আরও উপরে উঠি,আর আমি জানি একটা সময় আর আমার মাঝে কোন চেতনা থাকবে না। কেন জানি মনে হতে লাগলো,হয়তো এমনটা আর কখনো আসবে না। আমি ওকে জড়িয়ে ধরবো,ওকে চুমু খেয়ে ওর ঠোঁট কামড়াবো,ওকে ধরে রাখব অনেক কাছে,হতাথ করেই ও বুঝে যাবে,কেন এমন হচ্ছে,সবকিছু কতটা অর্থহীন।
ছয়.
আজ ও সকালে অবেলায় ঘুম ভাঙল। গলা থেকে রক্ত ঝরছে। মুখটা রক্তের নোনতা স্বাদে কেমন যেন হয়ে আছে। আমি জানি সময় কমে আসছে,আমি নিজেও জানি না আর কতটা সময় আছে…কতটা অর্থহীন সবকিছু। তাও আমি আমার জীবনকে গুছিয়ে কাটানোর কত চেষ্টা করে যাচ্ছি। ভার্সিটির সকালের ক্লাসের সময় হয়ে এসেছে। আর দেরি করা যাবে না।
সাত.
জলপরী বলেছিল,এমন-ই হবে তারপর আমরা একদিন মিশে যাবো,আমাদের কেউ আলাদা করতে পারবে না।
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।