সরল ও হাতি

সরল এখন খুব খুশি । কারণ সরল ইশকুলে ভর্তি হয়েছে । বাবু সরলকে ইশকুলে যেতে দিতে চায় নি, ক্ষেতের কাজে সরল আজকাল বেশ পোক্ত হয়েছে যে। কিন্তু পঞ্চায়েত থেকে বলেছে সব ছেলেমেয়েকে ইশকুলে পাঠাতেই হবে। ইশকুলের মাইনে, বইখাতা সব নাকি গরমেন্ট দেবে । দুপুর হলে পেট ভরে খিচুড়ি খেতেও দেবে । সেই শুনে বাবু রাজি হয়েছে । এমনিতে তো সরল সেই ছোট্ট থেকে সকাল হলেই বাবুর সঙ্গে আর দাদাদের সঙ্গে ক্ষেতের কাজ করতে যায় । দুপুরে একবার বাড়ি এসে বাবুর জন্যে, দাদাদের জন্যে ভাত নিয়ে যায় । ক্ষেতের কাজে ভারি মজা । শুকনো মাটিতে নিড়ানি দাও, শুকনো পাতা মাথায় করে ফেলে এসো, ঝারি করে জল নিয়ে গাছকে চান করিয়ে দাও ।

দু’সন ভালো ধান হয় নি । সে নিয়ে গাঁয়ের সবাই খুব ভাবনা করেছিল । এবছর ভালো বৃষ্টি হয়েছে, তাই এমনিও বাবুর মেজাজ ভালো আছে । প্রথমে রাজি না হলেও সব শুনে টুনে  বলল, ‘আচ্ছা, সরল ক’বছর ইশকুলে যাক না হয় । একজনের একবেলার খাওয়াটাও হবে ।‘ গরমেন্ট কে সরল জানে না । কিন্তু মনে মনে গরমেন্টকে প্রণাম করেছে সরল । গরমেন্ট নিশ্চয় একজন খুব ভালো লোক । তাই তো সরলের ইশকুলে যাবার সাধ মিটল । মাঝিপাড়ার পবন, গুলু, সোরেন আগেই ইশকুলে যাওয়া শুরু করেছে । সরলদের পাড়া থেকে সরল আর গণেশ ওদের সঙ্গেই চলে যাবে, বাবু বলে দিল । জেলেপাড়া নামোপাড়া থেকেও ক’জন ছেলে আছে । আট-দশজনের একটা দল । ইশকুল অনেক দূর । জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে আট দশ মাইল গেলে পাকা সড়ক । হাইওয়ে বলে সড়কটাকে, এখন জানে সরল । সেই হাইওয়ে ধরে আরো দু’মাইল প্রায় । তারপর দূর থেকে ইশকুল বাড়ি দেখা যায় । ইশকুলটা একটা ছোট পাহাড়ের ওপর । পাহাড়ের ঢালুতে একটা মস্ত জারুল গাছ । তার ঠিক পাশ দিয়ে এঁকেবেঁকে রাস্তা চলে গেছে, একেবারে ইশকুলের ফটক পর্যন্ত । ফটকের পাশে খেলার মাঠ, তার ওপর বালি ছড়ানো । আর ফটক দিয়ে ঢুকলেই ফুলের বাগান ।

 

লাল নীল হলুদ বেগুনী ফুলে ঝলমলে বাগানটায় ঢুকলেই সরলের মন ভালো হয়ে যায় । যাওয়ার গোটা পথটা মন ভালো করা । জঙ্গলের মধ্যে রোদ ঢোকে না, ছায়া ছায়া রাস্তা ধরে দৌড়ে দৌড়ে যায় সবাই মিলে । হলুদ সবুজ কত প্রজাপতি, বনের গাছে গাছে কত পাখির ডাক । গাছের পাতায় নানারকম সবুজ, হালকা সবুজ, ঘন সবুজ, হলুদ ছোপ ছোপ সবুজ, কালচে সবুজ । জোরে জোরে বাতাস বয়, রাশি রাশি পাতা গাছ থেকে টুপটাপ পড়তে থাকে মাথায়, মুখে । সবাই মিলে খোলা গলায় হাসে । বেশি জোরে হাসা, কথা বলা বারণ । বনদেবতা রাগ করবেন । বনের মধ্যে এক জায়গায় খোলা একটুখানি জায়গা আছে । সেখানে রোজ সরলরা একটুক্ষণ বসে । ঠিক মুখোমুখি একটা লেবুগাছ, তার পাতার নিচে মস্ত আটকোণা মাকড়সার জাল । সেই জালে রোদ্দুর পড়ে কেমন সোনালি চিকচিকে রঙ হয়, সেইটা রোজ দেখে সরল । খুদে খুদে জানোয়াররা ঘুরে বেড়ায়, মেঠো ইঁদুরগুলো সরলদের দেখে লুকিয়ে পড়ে । একটু জিরিয়ে নিয়ে আবার হাঁটে সরলরা । পাকা রাস্তায় ওঠার ঠিক আগে একটা বড় শিমুল গাছ । সেই গাছটার ডালে বোলতারা মেটে রঙের মস্ত চাক বেঁধেছিল । গণেশের বড়জ্যাঠা একদিন বাঁশের আগায় মশাল বেঁধে সেই চাকে আগুন ধরিয়ে দিল । জ্বলতে জ্বলতে চাকটা মাটিতে পড়ল, আর কত কত বোলতা সেই আগুনে পুড়তে লাগল, রাগে আওয়াজ করতে করতে চারদিকে উড়তে লাগল । সরলদের সবার হাতে বড় বড় পাতাসুদ্ধ ডাল ধরিয়ে দিয়েছিল জ্যাঠা আগেই । ওরা সমানে সেই পাতাগুলো নিজেদের চারদিকে ঘোরাচ্ছিল । নইলে বোলতার হুল । বাব্বা ! ফুলে ঢোল হয়ে যাবে, সেই সঙ্গে ব্যথা । সেই চাকভাঙা মধু নিয়ে সন্ধেবেলা সরলদের পাড়ায় কত হুল্লোড় হল । দুদিন ধরে সরলদের গ্রাম থেকে কেউ ইশকুলে যাচ্ছে না । একটা বুনো হাতি এসেছে । কদিন আগে সরলদের পাশের ক্ষেতে এসে সব ধান খেয়ে চলে গেছে । প্রতিবছরই হাতি এসে ফসল খেয়ে যায় ঠিকই, কিন্তু হাতিদের আসার সঙ্গে গ্রামবাসীদের একটা অলিখিত বোঝাপড়া আছে । পরবের আগে কোনোদিন এ গ্রামে হাতি আসে নি । এবার হাতি শুধু আগে আগে আসে নি, প্রায় আট দশজনের ক্ষেতের ধান নষ্ট করেছে, ধান খেয়েছে, রাগে ক্ষেত মাড়িয়ে দিয়েছে । খবর পেয়ে তীরধনুক, মশাল, ক্যানেস্তারা, পটকা নিয়ে ছুটে গেল সবাই । তখন হাতি পালিয়ে গেল । কি রাগ, কি ভয়ানক চিৎকার, গোদা গোদা পায়ে সব ধান মাড়িয়ে দিয়ে চলে গেল ।

 

 

কি ভাগ্যি, সরলদের ক্ষেতের ধানে সেদিন পা পড়ে নি হাতির । সেই থেকে সারাদিন ধরে, সারারাত জেগে গ্রামসুদ্ধ লোক ক্ষেত পাহারা দিচ্ছে । মশালের আগুনে হাতি ভয় পায়, পটকার আওয়াজেও ভয় পেয়ে পালায় । শুধু একদিন ক্যানেস্তারা বাজাতে বাজাতে সিধুজ্যাঠা বনের কাছ পর্যন্ত চলে গেছিল, সেদিন হাতিটা রেগে গিয়ে সিধুজ্যাঠাকে তাড়া করেছিল । আর একদিন পবনের ছোট ভাইটাকে শুঁড়ে তুলে আছাড় দিয়েছিল, ভাগ্য ভালো প্রাণে বেঁচে গেছে, হাত ভেঙে পিঠের হাড় ভেঁঙে সদরের হাসপাতালে ভর্তি রয়েছে । সবাই বলছে, ‘হাতিটা পাগলা হয়ে গেছে ।‘ পঞ্চায়েত অফিস থেকে কেরোসিন দিয়েছে, পটকা দিয়েছে । গাঁয়ের লোক গিয়ে বনদপ্তরে হাতির নামে নালিশ লিখিয়ে এসেছে ।

কিন্তু এখনও পাগলা হাতিকে ধরা যায় নি । ফরেস্টার বাবুরা এসে বন্দুক নিয়ে আকাশে গুলি ছুঁড়ে, ক্যানেস্তারা বাজিয়ে হাতি খেদিয়ে দূরের জঙ্গলে পাঠিয়ে দিয়ে যায় । কোথায় লুকিয়ে থাকে হাতি কে জানে, ফরেস্টারবাবুরা চলে গেলেই এসে গাঁয়ে ঢোকার রাস্তার মুখের অর্জুনগাছের ডাল ভেঙে দিয়ে যায় । খুব বুদ্ধি হাতির । মুন্ডাপাড়ার দিকে লোকজন পাহারা দিচ্ছে,  হাতি মাঝিপাড়ার দিক দিয়ে এসে তান্ডব করে যায় । কদিন আগে কার্তিকদের ঘরের চাল উপড়ে দিয়ে গেছে । একদিন রাস্তার ওপর একটা গরুর গাড়ি উলটে দিয়েছে । দিন নেই, রাত নেই, কখন হাতি আসবে সেই ভয়ে গ্রামসুদ্ধ লোক অস্থির । ছোট বাচ্চারা পর্যন্ত বাড়ির বাইরে বেরোতে ভয় পাচ্ছে । মুখে মুখে গল্প ঘুরছে । সেই যেবার বাদনা পরবের পরে মাঝিপাড়ার অমন জোয়ান ছেলেটাকে হাতি মেরে ফেলেছিল । এই তো গত বছর পাশের গাঁয়ের মোহন টুডুর একমাত্র কচি ছেলেটাকে শুঁড়ে করে আছড়ে মেরে ফেলেছিল । দেখেশুনে গাঁয়ের সবাই ঠিক করেছে, এখন আর সরলদের ইশকুলে গিয়ে কাজ নেই । কখন হাতি তাড়া করবে কে জানে । বুনো হাতি এমনিই ভয়ঙ্কর, তার ওপর এ হল পাগলা হাতি ।

 

 

একেবারে মাড়িয়ে দিয়ে চলে যাবে ।   ইশকুলে যাওয়া হচ্ছে না বলে সরলের খুব মনখারাপ । কত মজা হয় ইশকুলে । গরমেন্ট শুধু বইখাতা দেয় নি, ড্রয়িংবই ড্রয়িংখাতা আর রঙপেন্সিলও দিয়েছে । সেই খাতায় ইশকুলে বসে কত ছবি আঁকে সরল । বাড়িতে বসে বসে এত ছবি এঁকেছে সরল যে ড্রয়িংখাতার সব পাতা শেষ । ইশকুলে গেলে তবেই তো আর একটা ড্রয়িংখাতা পাবে ! তাছাড়া ভূগোল ক্লাসটার জন্যেও মনখারাপ করে । ভূগোল সবচেয়ে ভালো লাগে সরলের । মাস্টারমশাই কি সুন্দর দেশ বিদেশের গল্প বলেন । একটা লম্বা রঙচঙে কাগজ দেখিয়ে যেদিন বলেছিলেন, ‘এই দ্যাখ, এইটা হল আমাদের দেশ’; সেদিনের কথাটা স্পষ্ট মনে আছে সরলের । দেশ মানে ভারত, সেইটা আগে থেকেই জানত । কিন্তু ভারত যে ওই কাগজটাকে বলে সেইটা জেনে তো সরল অবাক । তারপর মাস্টারমশাই বললেন, ‘এইটাকে মানচিত্র বলে ।‘ সেই মানচিত্রে নাকি ভারতের সব জায়গার নাম আছে । একেবারে ডান দিকে দেখিয়ে বলেছিলেন, ‘এই যে এইটা গঙ্গা, এই হল আমাদের পশ্চিমবঙ্গ .. আর এই দ্যাখো পুরুলিয়া, এইখানেই আমাদের কুলহি গ্রাম ।‘ অনেক খুঁজেও কুলহি নাম দেখতে পায় নি সরল, তখন মাস্টারমশাই বুঝিয়েছিলেন, কাছাকাছি কোনো বড় জায়গার নাম দিয়ে বুঝতে হবে । সব ছোট ছোট জায়গার নাম তো থাকে না, শুধু রাজধানী বা বড় শহরের নাম থাকে । আর কোনো জায়গায় যদি কোনো দর্শনীয় জিনিস থাকে কিংবা কোনো স্মরণীয় ঘটনা ঘটে, তাহলে সেই জায়গার নাম থাকে । ইস, সরলদের গ্রামে যদি একটা স্মরণীয় ঘটনা হত ! আর এখন তো ইশকুলেই যাওয়া হচ্ছে না । খুব মনখারাপ করে সরলের । সাত দিনেও কোনো সুরাহা হল না । আজ সকালে ক্ষেতে যাবার নাম করে বেরিয়েছে সরল ।

 

গাঁয়ের সব পুরুষমানুষ হয় ক্ষেতের কাছে নয় বনের দিকে পাহারায় । নদীর দিক দিয়ে বেরিয়ে এসেছে সরল । রাস্তা তো চেনাই আছে । পলাশ গাছটার পাশ দিয়ে জঙ্গলের রাস্তায় ঢুকে পড়বে । হাতি এলে কোথায় লুকিয়ে পড়বে তাও ঠিক করে নিয়েছে মনে মনে । যেমন করেই হোক, আজ ইশকুলে যাবেই । বনের মধ্যে দিয়ে অনেকখানি এক ছুটে পেরিয়ে এসে মাকড়সার জালের কাছে এসে বসল সরল । আর একটুখানি । ওই আমলকি গাছটার পাশ দিয়ে গেলেই একটা জলা, জলা পেরোলেই শালগাছের বন, সেইটা পেরোলেই শিমুলগাছ । তারপরেই বড় রাস্তা । জলার কাছ পর্যন্ত ভালোভাবেই পেরিয়ে এল । তারপরই থমকে দাঁড়িয়েছে । কালো পাহাড়ের মতো বড় হাতিটা । জল খেতে এসেছিল নিশ্চয় । জল খেয়ে হাতিদের নুন খেতে হয় । হাতিটা জলার পাশের মাটি চাটছে । সরল জানে, ওটা নোনা মাটি । ওই জলায় জল খেয়ে সব ছোট বড় জানোয়ার মাটি চাটে ।

পাগলা হাতি মাটি চাটায় ব্যস্ত, সরলকে দেখতে পায় নি । পাশেই একটা বুড়ো মস্তবড় শিশু গাছ । একটুও আওয়াজ না করে সরল তরতর করে শিশু গাছে উঠে গেল । একটা পাতাওয়ালা ডাল দেখে লুকিয়ে বসল তারপর । সেইটুকু আওয়াজেই হাতি মুখ তুলে তাকিয়েছে, ভাগ্যিস সরলকে দেখতে পায় নি । তবু কি ভেবে হাতিটা এগিয়ে এসে শিশুগাছে খুব জোরে ধাক্কা দিয়ে গেল । গাছের ডাল আঁকড়ে বসে রইল সরল । হাতি চলে যাবার পরও নামে নি । যদি হাতিটা আবার ফিরে আসে । পাগলা হাতি পলকে শুঁড়ে তুলে আছাড় দেবে । দেখতে দেখতে বেলা কাটল আরো । হাতি কাছাকাছিই আছে । মাঝেমাঝেই গাছপালার ফাঁক দিয়ে কালো শরীর দেখা যাচ্ছে । কতক্ষণ সময় কাটল কে জানে । সেই সকালে বেরিয়েছে সরল, সূর্য এখন মাথার ওপর । খিদেয় পেট চুঁই চুঁই করছে । শিশুগাছে না উঠে পাশের মহুয়া গাছটায় উঠলে ভালো হত । ছোট ছোট ফলে ও গাছটা ভরে আছে । তখন অত দিকে খেয়াল হয় নি । সরলের একটু একটু ভয় করছে । এমনিতে গাঁয়ের লোকজন এ রাস্তায় আসে, কিন্তু এখন হাতির ভয়ে কেউ আসছে না । কেউ যদি না আসে ! বাড়ি ফিরবে কি করে ! পাশের ডালে খুব ছোট একটা হনুমান, গায়ে একটু একটু লোম, কুচকুচে মুখ, পিটপিট করে তাকিয়ে কুঁইকুঁই করে বকতে লাগল সরলকে ।

 

যেন বলছে, ‘এটা আমার বাড়ি, তুই এখানে কেন ?’ আওয়াজ শুনে হাতিটা না ফিরে আসে । সরল চোখ পাকিয়ে তাকালো । তাতে রেগে গিয়ে হনুমানটা ভেংচি কেটে দিল । খানিক পরে একটা বড় হনুমান এসে ছোট হনুমান্টাকে মুখে করে তুলে নিয়ে গেল । যাক বাবা । মা-হনুমানটা ভাগ্যিস রাগ করে নি ! আরো খানিকক্ষণ পরে কালো শরীরটার নড়াচড়া দেখতে পেল সরল । কি একটা টেনে আনছে হাতিটা । একটু করে আসছে, আর দাঁড়িয়ে পড়ে চিৎকার করছে । সে কি চিৎকার । ভয়ে সরলের নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে এল । হাতিটা খুব রেগে আছে । কি হবে এবার ? একবার মহুয়া গাছের ডালটা হাওয়ায় সরে যেতেই হাতিটাকে দেখতে পেল । একটা বাচ্চা হাতিকে টেনে আনছে । মা-হাতি একটু করে টেনে আনছে, আর বাচ্চা-হাতিটা বেজায় চিৎকার করছে । সেই শুনে মা-হাতি আরো জোরে চিৎকার করছে । বাচ্চা-হাতির পায়ে লেগেছে বোধ হয়, চলতেই পারছে না ।
আহা রে, ওর পা ভেঙে গেছে । এবার বুঝেছে সরল । মা-হাতিটা মোটেই পাগল নয় । বাচ্চার পায়ে লেগেছে বলে ওরা দুজনে দল থেকে আলাদা হয়ে গেছে । দলের সঙ্গে হেঁটে যেতে পারে নি । কেউ কাছে এলেই মা-হাতি ভাবে ওর বাচ্চাকে মারতে আসছে বুঝি, তাই তেড়ে যায় । বোধহয় সরলদের গ্রামের কাছেই ছিল এতদিন, তাই গ্রামে ঢুকে তান্ডব করত যাতে কেউ ওদিকে না যায় । হাতি খেদানোর দল এলে তাই হাতি তাড়া করত । মা-হাতি বাচ্চাকে নিয়ে ব্যস্ত আছে, সেই ফাঁকে আস্তে গাছ থেকে নেমে পড়ল সরল । তারপর এক ছুটে গ্রামে । গ্রামের লায়াবুড়ো অনেকরকম ওষুধ জানে । দিকুমাঝির ঠাকুমাও জড়ি বুটি দিয়ে অনেক রোগ সারায় । তারপর বাবুকে রাজি করিয়ে গ্রামের লোকজনকে বুঝিয়ে আনা কম ঝক্কি ! চুপি চুপি গাছের আড়াল দিয়ে হাতির কাছ পর্যন্ত পৌঁছবার আগে হাতিও টের পায়নি । কাছে গিয়েই সরল মা-হাতিটার পিঠে চড়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে শুরু করল ।

 

 

লায়াবুড়ো আর ঠাকুমা ওষুধ নিয়ে বাচ্চা-হাতির পায়ে লাগাতে বসল । ওষুধ দিয়ে মোটা কাপড় দিয়ে বাঁধা, একটু একটু করে পাতলা ওষুধ খাওয়ানো, অনেক সময় লাগল । বাচ্চা-হাতি প্রথমে ছটফট করছিল, একটু পরে শান্ত হয়ে মাথাটা মাটিতে নামিয়ে রাখল । বাবু মাথাটা কোলে নিয়ে বসল । মা-হাতি কি বুঝল কে জানে, কাউকে তেড়ে গেল না, চিৎকারও করল না, বরং চোখ বুজে সরলের আদর খেতে লাগল । লোকজন মিলে বাচ্চা-হাতিকে তুলে গ্রামে নিয়ে আসা হল । মা-হাতি সরলকে পিঠে নিয়ে শান্ত হয়ে গ্রাম পর্যন্ত এল । কতদিন ধরে বাচ্চা-হাতি ওদের গাঁয়েই থাকল তারপর । মা-হাতি জঙ্গলে থাকত, আর রোজ একবার এসে বাচ্চাকে দেখে যেত । একদিনও ক্ষেত মাড়ায় নি, কাউকে ভয় দেখায় নি ।
এদিকে আর এক কান্ড । ইশকুলে গিয়ে সরলরা যখন হাতির গল্পটা বলেছে, প্রথমে তো কেউ বিশ্বাসই করে না । তারপর মাস্টারমশাইরা ডেকে ডেকে গল্পটা শুনতে চাইলেন । হেডমাস্টারমশাইও ওদের ডেকে সব শুনলেন । কি থেকে কি হল কে জানে, একদিন টিভি থেকে খবরের কাগজ থেকে কত লোক কত ক্যামেরা সরলদের গ্রামে এসে হাজির । বাচ্চা-হাতির কত ছবি তুলল তারা । সরলের সঙ্গে বাচ্চা-হাতির ছবি তুলল । মুখের সামনে মাইক ধরে ধরে সরলের গল্পটা বলতে বলল । তারপর আরো এক কান্ড । হেডমাস্টারমশাই বাবুকে আর সরলকে সদরের বড় অফিসে নিয়ে গেলেন । সরল সাহসিকতার পুরষ্কার পাবে । সদরের অফিসের সবাই এসে বাবুকে আর সরলকে দেখতে লাগল । সরলের দিল্লী যাবার সব ব্যবস্থা হল । বাবু ভয়ে দিল্লী যেতেই চাইল না ।

 

 

তখন হেডমাস্টারমশাই সরলকে নিয়ে দিল্লী গেলেন । বড়দাদাও সঙ্গে গেল । সরলের এই প্রথম ট্রেনে চাপা । তারপর রাষ্ট্রপতির হাত থেকে যেদিন পুরষ্কার পেল, সেদিনটার কথা কোনোদিন ভুলবে না সরল । রাষ্ট্রপতি মিষ্টি হেসে সরলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন, হোটেলের ঘরে বসে সেই ছবিটা টিভিতেও দেখেছে । কত হাততালি । কত বাজনা । কত ছবি তোলা । সব স্বপ্নের মতো ব্যাপার স্যাপার । দেখতে দেখতে সরলের মাথায় একটা কথা এল । এই যে ঘটনাটা ঘটল, এটাকে কি স্মরণীয় ঘটনা বলা হবে ? ভারতের মানচিত্রে কি বেরাপোতা গ্রামের নাম উঠবে ? কিংবা সরলের ইশকুলের গ্রাম কুলহির নাম ? বড়দাদা তো কথাটা বুঝতেই পারল না, হেডমাস্টারমশাই শুনে এমন হাসতে লাগলেন যে আর কিছু জবাব দিতেই পারলেন না । গ্রামে ফিরেও অনেকদিন এমন মজা আর আনন্দে কাটল । তারপর একদিন মা-হাতি বাচ্চা-হাতিকে নিয়ে জঙ্গলে ফিরে গেল ।
গ্রামের সব ছোট ছেলেমেয়ে খুব কাঁদল, মা জ্যেঠিরা মা-হাতিকে সিঁদুর পরিয়ে দিল, বাচ্চা-হাতিকে সাদা টিপ পরিয়ে দিল । সরলেরও খুব কান্না পাচ্ছিল । আর একটা কথা নিজে নিজেই বুঝে ফেলল সরল । মানচিত্রে স্মরণীয় না-ই হোক, সরলের কাছে এই ঘটনাটা সারা জীবনের জন্যে স্মরণীয় হয়ে থাকবে । সরল বইয়ে পড়েছে, হাতিদের স্মৃতিশক্তি খুব ভালো, মানুষের থেকেও বেশি । তাই সরল জানে, হাতিরাও এই ঘটনাটা মনে রাখবে । সরল হাসিমুখে মনখারাপের চোখের জল মুছে নিল ।

আরো পড়তে পারেন...

আমার যতো ইচ্ছে |

কিছুই ভালো লাগে না, মনে হয় লেখাপড়ার নামে সবাই আমাকে বন্দি করে রেখেছে। মা বলেন,…

এবং একদিন | তাজনীন মুন

‘-মা, এমা,  দেইখা যাও আব্বায় আইজ কত্তো বাজার পাঠাইছে। সুগন্ধি চাইল রান্তে কইছে আইজ। রমিলা…

অপরিচিতা-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-১ম খন্ড

আজ আমার বয়স সাতাশ মাত্র। এ জীবনটা না দৈর্ঘ্যের হিসাবে বড়ো, না গুণের হিসাবে। তবু…