হেলাল সরকারের একটা পোষা কুকুর আর একটা গাধা আছে। কুকুরটা খুবই স্নেহবৎসল। বিশ্বস্তস্ন। সব সময় হেলাল সরকারের কাছাকাছি থাকে। হেলাল সরকার যেখানেই যান, প্রিয় কুকুরটাও সাথে যায়। তিনি গোসল করতে গেলে কুকুরটা পুকুরঘাটে দাঁড়িয়ে থাকে। রাতে হেলাল সরকার যে ঘরে ঘুমান, কুকুরটা সে ঘরের দরজায় বসে থাকে। অচেনা কাউকে দেখলে ঘেউঘেউ করে ডেকে ওঠে। হেলাল সরকার যখন বাড়ির আঙিনায় নিমগাছের নিচে বসে দৈনিক পত্রিকা পড়েন, কুকুরটা তখন তার পাশে ঘুরঘুর করে।
মাঝেমাঝে কুকুরটা দু’হাঁটু ভেঙে হেলাল সরকারের সামনে বসে পত্রিকার দিকে তাকিয়ে থাকে। ভাবখানা এমন যে, সেও মনোযোগ দিয়ে পত্রিকা পড়ছে। কখনো-সখনো কুকুরটা নিজের ভাষায় কথা বলে। হেলাল সরকারও যেন কুকুরটার কথা বুঝতে পারেন। মাঝে-মধ্যে উঠে গিয়ে খাবার এনে দেন কুকুরটার সামনে। খাবার পেয়ে খুশিতে লাফিয়ে ওঠে কুকুরটা। লেজ নেড়ে কৃতজ্ঞতা জানায়। অনেকদিন থেকেই কুকুরটার এসব কাণ্ডকীর্তি দূর থেকে খেয়াল করছিলো হেলাল সরকারের গৃহপালিত গাধাটা। গাধাটাকে যে হেলাল সরকার কম আদর-যত্ন করেন, তা নয়। গাধাটা যেটুকু কাজ করতে পারবে বলে মনে করেন, তার বেশি কাজ দেন না। কাজ শেষে গাধাটাকে বেঁধে রাখেন। পর্যাপ্ত খাবার দেন।
কিন্তু এতে মন ভরে না গাধার। দূর থেকে কুকুরটার আদিখ্যেতা দেখে রাগে-দুঃখে গাধাটার গা জ্বলে যায়। তার মনে হয়_ মনিব বোধহয় কুকুরটাকে বেশি ভালোবাসে। মনের দুঃখে আক্ষেপ করে বলে, এটা ঠিক নয়। হেলাল সরকার তাকে ভালো না বেসে কুকুরটাকে বেশি ভালোবাসে! অথচ সে কত পরিশ্রম করে! গাড়ি টানে। ওজনদার বোঝা বয়ে বেড়ায়। কুকুরটা এসবের কিছুই করে না। শুধু হেলাল সরকারের সামনে লেজ নেড়ে কীসব ঢং করে! লাফালাফি করে। ঘোরাফেরা করে। গাধাটা ভাবে_ আমিও যদি মনিবের সামনে গিয়ে কুকুরটার মতো আদিখ্যেতা করি, ঘোরাফেরা করি, লাফালাফি করি, তাহলে আমাকেও মনিব কুকুরটার মতো ভালোবাসবে। এই ভেবে গাধাটা তার ঘর থেকে দড়ি ছিঁড়ে বেরিয়ে গেলো। হেলাল সরকার চেয়ারে বসে চা খেতে খেতে পত্রিকা পড়ছিলেন। গাধাটা একদৌড়ে হেলাল সরকারের কাছে গিয়ে দাঁড়ালো।
আদিখ্যেতা দেখাতে লেজ নাড়লো। লেজ নাড়তে গিয়ে লেজের ধাক্কায় টেবিল থেকে চায়ের কাপটা নিচে পড়ে ভেঙে গেলো। আর চা পড়ে হেলাল সরকারের হাতের পত্রিকাটিও ভিজে গেলো। তাতেও ক্ষান্ত হলো না গাধাটা। সে সরকারের চারপাশে লাফাতে শুরু করলো। এরপর কুকুরটার মতো হাঁটু ভেঙে মনিবের সামনে বসে জিহ্বা দিয়ে মনিবের গালে আদর করতে শুরু করলো।
গাধাটার অস্বাভাবিক আচরণ দেখে অবাক হলেন হেলাল সরকার। কিছুটা ভয়ও পেলেন। তাই চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালেন তিনি। এতেও ক্ষান্ত হলো না গাধাটা। সে তার কৃত্রিম আদিখ্যেতা প্রকাশে আরও ব্যস্ত হয়ে পড়লো। গাধার কাণ্ড দেখে হেলাল সরকার ভাবনায় পড়ে গেলেন। হঠাৎ গাধাটার কী হলো! পাগল হয়ে গেলো না তো! হেলাল সরকার বিরক্ত হয়ে গাধাটাকে ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে দিতে চেষ্টা করলেন। তাকেও ধাক্কা দিল গাধাটা। ধাক্কা খেয়ে ভারসাম্য রাখতে না পেরে মাটিতে আছড়ে পড়লেন হেলাল সরকার। ভয় পেয়ে চিৎকার দিয়ে বাড়ির সবাইকে ডাকলেন তিনি। তোমরা কে কোথায় আছো, জলদি আসো। আমার গাধা পাগল হয়ে গেছে। এটাকে আটকাও।
কুকুরটাও ঘেউ ঘেউ করে বিপদের সংকেত দিলো। ডাক শুনে লোকজন ছুটে এলো লাঠিসোটা নিয়ে। লোকজনকে ছুটে আসতে দেখেও গাধাটার সুমতি হলো না। সে আগের মতোই লাফালাফি করতে লাগলো। লোকজন এসে গাধাটাকে মারতে লাগলো। মার খেয়ে গাধাটা মাঠের দিকে দে ছুট। লোকজন গাধাটাকে তাড়া করলো। একসময় গাধাকে ধরে টেনে-হিঁচড়ে বাড়িতে এনে শক্ত করে বেঁধে রাখলো। পিটুনি খেয়ে গাধা গুরুতর আহত হলো। তাই দাঁড়িয়ে থাকতে না পেরে শুয়ে পড়লো। গাধাটা ভেবে কূল পেলো না, যে কাজ করে কুকুরটা আদর পায়, সেই একই কাজ করে তাকে কেন মার খেতে হলো! ভাবতে ভাবতে গাধাটার চোখ ভিজে এলো।
সূত্র : সমকাল