সম্রাট শাহজাহান ও মমতাজের প্রেম কাহিনী বিশ্বের সাড়া জাগানো প্রেম কাহিনীগুলোর মধ্যে অন্যতম। তাদের মতো এরকম অমর প্রেম কাহিনী আরও অনেক রয়েছে। তবে সম্রাট শাহজাহান ও মমতাজের প্রেম কাহিনীটি একটি বিশেষ কারণে সাড়া জাগিয়েছে—তা হলো, মমতাজের জন্য সম্রাট শাহজাহানের বানানো বিখ্যাত সেই তাজমহল।
সময়টা ছিল ১৬১২ খ্রিস্টাব্দ। সম্রাট শাহজাহানের বয়স তখন ২০ বছর। একদিন আগ্রার বাজার দিয়ে যাওয়ার পথে হঠাৎ শাহজাহানের চোখ চলে যায় পরমা সুন্দরী এক মেয়ের দিকে। আরজুমান্দ বেগম নামের মেয়েটির বয়স ১৫। প্রথম দেখাতেই আরজুমান্দ বেগমকে ভালো লেগে যায় শাহজাহানের। পরবর্তীতে ১৬১২ খ্রিস্টাব্দের ১০ মে মমতাজের বিয়ে হয় যুবরাজ খুররমের (সম্রাট শাহজাহান) সঙ্গে। (তবে উইকিপিডিয়ায় বলা আছে, বিয়ের সময় তাদের দুজনের বয়স ছিল যথাক্রমে ১৫ ও ১৪ বছর)। এর আগে রাজনৈতিক কারণে পারস্যের রাজকন্যাকে বিয়ে করেন সম্রাট শাহজাহান। পরবর্তীতে সম্রাট শাহজাহান তার স্ত্রীর নাম পরিবর্তন করে রাখেন মমতাজ মহল। মমতাজই ছিলেন শাহজাহানের সবচেয়ে প্রিয় বেগম। উনিশ বছরের বিবাহিত জীবনে মমতাজের মোট চৌদ্দটি সন্তান হয়।
মমতাজ মহল ১৬৩১ সালে ৩৯ বছর বয়সে বুরহানপূরে ১৪তম সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে মারা যান। স্ত্রী হারানোর শোকে মুহ্যমান শাহজাহান তাঁর প্রাণপ্রিয় স্ত্রীর স্মৃতির জন্য নির্মাণ করেন ভালোবাসার এই অপরূপ নিদর্শন। স্ত্রীর মৃত্যুর পর সাত দিন সাত রাত শাহজাহান কিছু খাননি, ঘর থেকেও বের হননি। সাত দিন পর শাহজাহান বাইরে বেরোলেন—তখন তার চুলের রং ধূসর হয়ে গেছে, মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেছে।
মমতাজ আসলে শাহজাহানের কততম স্ত্রী ছিলেন, তা নিয়েও বিতর্ক রয়েছে। উইকিপিডিয়ার মতে, মমতাজ ছিলেন সম্রাট শাহজাহানের দ্বিতীয় স্ত্রী। কোথাও বলা হয়েছে তৃতীয় স্ত্রী, কোথাও বলা আছে চতুর্থ স্ত্রী। আসলে সঠিক তথ্য কোথাও নিশ্চিতভাবে পাওয়া যায় না।
পিএন অক নামের এক প্রফেসর তাঁর “তাজমহল: দ্য ট্রু স্টোরি” বইয়ে শাহজাহান ও মমতাজের প্রেম কাহিনীর সত্যতা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন। তার মতে, মমতাজ ও শাহজাহানের ভালোবাসার গল্প মূলত লোকমুখে সৃষ্ট রূপকথা। কারণ, ভারতের ওই সময়কার কোনো সরকারি নথি বা গ্রন্থে এত গভীর প্রেমের উল্লেখ নেই। তিনি আরও দাবি করেন, তাজমহল কখনোই সম্রাট শাহজাহানের আমলের নয়। নিউইয়র্কের প্রত্নতাত্ত্বিক মারভিন মিলারের করা কার্বন টেস্ট অনুযায়ী, তাজমহলের দেয়ালের বয়স শাহজাহানের শাসনামলের চেয়ে প্রায় ৩০০ বছর বেশি পুরনো।
এছাড়া ১৬৩৮ সালে এক ইউরোপীয় পর্যটক আগ্রা ভ্রমণ করেন—মমতাজের মৃত্যুর মাত্র সাত বছর পর। কিন্তু তাঁর ভ্রমণবৃত্তান্তে তাজমহলের কোনো উল্লেখ নেই।
এ নিয়ে আরও কিছু বিতর্কিত দাবি রয়েছে—যেমন, বলা হয় শাহজাহান মমতাজকে বাজারে প্রথম দেখায় পছন্দ করেন। কিন্তু আরেক মত অনুসারে, মমতাজের আগে থেকেই বিয়ে হয়েছিল এবং শাহজাহান তার স্বামীকে হত্যা করে তাকে বিয়ে করেন। মমতাজের আগে শাহজাহানের আরও তিন স্ত্রী ছিল এবং মমতাজের পরও তিনি তিনটি বিয়ে করেন। মমতাজ মারা যাওয়ার পর শাহজাহান মমতাজের ছোট বোনকে বিয়ে করেন। তাজমহলের নকশাকার ঈশা মোহাম্মদ নিজের স্ত্রীর জন্য একটি ভাস্কর্য বানিয়েছিলেন। শাহজাহানের পছন্দ হওয়ায় তার আদলে তাজমহল নির্মাণ করা হয় এবং তাকে অন্ধ করে দেওয়া হয় যাতে তিনি আর এই নকশা করতে না পারেন। বিশ হাজার শ্রমিক দিনরাত খেটে এই মহল তৈরি করেন, এবং নাকি তাদের হাত কেটে দেওয়া হয় যেন তারা আর এমন নির্মাণ করতে না পারেন।
তাজমহল যে স্থানে নির্মিত, তা আগে মহারাজা জয় সিংহের জমি ছিল। শাহজাহান আগ্রার এক প্রাসাদের বিনিময়ে ওই জমি অধিগ্রহণ করেন। ১৬৩২ সালে মমতাজের মৃত্যুর এক বছর পর নির্মাণ শুরু হয়। বিশ হাজারের বেশি শ্রমিকের প্রচেষ্টায় ১৬৪৮ সালে গম্বুজ শেষ হয় এবং ১৬৫৩ সালে পুরো কাজ সম্পন্ন হয়।
নির্মাণে ব্যবহৃত উপকরণের মধ্যে ছিল পাঞ্জাব থেকে সাদা মার্বেল, চীন থেকে সবুজ পাথর, তিব্বত থেকে নীল পাথর, শ্রীলঙ্কা থেকে নীলমণি, এবং ভারত, পাকিস্তান, পারস্যসহ বিশ্বজুড়ে আনা ২৮ প্রকার মূল্যবান পাথর। তৎকালীন সময়ে নির্মাণ খরচ আনুমানিক ৩২ মিলিয়ন রুপি বা এক মিলিয়ন ডলার ছিল বলে ধারণা করা হয়।
তাজমহল ভূমিকম্প প্রতিরোধীভাবে নির্মিত হয়—ভিত শক্ত করার জন্য অসংখ্য পাতকুয়া খুঁড়ে তা বালি, পাথর ও মাটি দিয়ে ভরাট করা হয়েছিল। নির্মাণের জন্য ব্যবহৃত ইটের তৈরি ভারা এত বড় ছিল যে শ্রমিকরা ভাঙতে বছর লেগে যেত। শাহজাহান ঘোষণা দেন যে ইট যে কেউ বিনামূল্যে নিয়ে যেতে পারবে, ফলে রাতারাতি ভারা অদৃশ্য হয়ে যায়।
প্রধান নকশাকার ছিলেন উস্তাদ আহমেদ লাহৌরি, সাথে ছিলেন আবদুল করিম মামুর খান ও মাকরামাত খান। ক্যালিগ্রাফি করেন আবদুল হক, যিনি ‘আমানত খান’ উপাধি পান।
পিএন অক দাবি করেন, তাজমহল আসলে একটি প্রাচীন হিন্দু মন্দির—‘তেজ মহালয়’। এটি ছিল শিবের মন্দির, যা জয়পুরের মহারাজা জয় সিংহের কাছ থেকে শাহজাহান দখল করে নেন। তাঁর মতে, তাজমহলের নাম, স্থাপত্য ও কিছু কক্ষের গোপনীয়তা ইঙ্গিত দেয় যে এর মূল কাঠামো শাহজাহানের আগে থেকেই বিদ্যমান ছিল।
তবে ইতিহাসবিদদের মতে, যদিও তাজমহলের কিছু প্রাথমিক কাঠামো পুরোনো হতে পারে, এর বর্তমান রূপ ও ইসলামিক স্থাপত্য শৈলী মূলত শাহজাহানের আমলেই নির্মিত। তর্ক-বিতর্ক যতই থাকুক, তাজমহল মুঘল স্থাপত্যের গর্ব, বিশ্বের সপ্তাশ্চর্যের একটি এবং Howdy, enamulভালোবাসার অনন্য প্রতীক।
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।