সবাই যার সুনাম করে

খোরাসান।

পারস্যের একটি প্রাচীন জেলা। বর্তমান ইরান দেশকে পারস্য বলা হতো। বলখ খোরাসানের একটি প্রসিদ্ধ শহর। সেই বলখ শহরে এক শিশুর জন্ম হয়। সাধারণ শিশু তিনি নন। অনেক গুণের অধিকারী হন এই শিশু। সুন্দর দুটো চোখ। চমৎকার দেহের গড়ন। শান্ত ও ধীর স্থির। যে শিশুর জন্মে বলখ শহর ধন্য। এই অসামান্য শিশু পরে সারা মুসলিম জাহানে মওলানা নামে পরিচিত হন। তিনি জ্ঞান সাধনার দ্বারা মুসলিম জাতির জন্য অনেক জ্ঞান গর্ভ পুস্তক লিখে গেছেন।

তাঁর নাম মওলানা রুমী। পুরো নাম মুহাম্মদ জালাল উদ্দীন রুমী। পিতার নাম মোহাম্মদ বাহাউদ্দীন। পিতা প্রথম খলীফা হযরত আবূ বকর (রঃ)-এর বংশধর। তাঁর মাতা ছিলেন আমাদের চতুর্থ খলিফা হযরত আলী (রঃ)-র বংশধর। পিতা ও মাতার দিক দিয়ে তিনি মস্ত বড়ো বংশে জন্মগ্রহণ করেন। মেধা ও চারিত্রিক গুণাবলী দিয়ে তিনি বংশের সুনাম বজায় রেখেছিলেন।

 

পিতা মাওলানা বাহাউদ্দীন তখনকার নামকরা আলিম ছিলেন। তিনি সকলের কাছে প্রিয় ছিলেন জ্ঞানী ও বুযুর্গ হিসেবে। সত্য কথা বলতে তিনি কখনো পিছপা হতেন না। এজন্য সেই সময়ে খোরাসানের সুলতানের সংগে তাঁর নানা রকম মতভেদ দেখা দেয়। আসলে জ্ঞানী লোকেরা অন্যায়ের কাছে মাথা নত করেন না। শত বিপদ এলেও যা সত্য ও ঠিক তা বলে যান।

সুলতান খাওয়ারিমজ শাহ তখন খোরাসানের শাসনকর্তা। সুলতান খুব ভালো লোক ছিলেন না। নানা রকম অন্যায় কাজ করতো। তাঁর অন্যায়ের বিরুদ্ধে কিছু লোক কথা বলতে লাগলেন। সুলতান মনে করতো তাঁর বিরুদ্ধে যাঁরা কথা বলতেন তাঁদের মধ্যে মাওলানা বাহাউদ্দীন একজন।

সুলতান খাওয়ারিজম শাহ রেগে গেলেন মাওলানা বাহাউদ্দীনের উপর। তিনি অত্যাচার করতে থাকেন। কিন্তু বাহাউদ্দীন ছিলেন আপোষহীন। তিনি নিজের সম্মান বজায় রাখার জন্য বলখ শহর ত্যাগ করলেন।

তিনি শিশু রুমীকে সাথে করে পায়ে হেঁটে বিদেশের পথে রওয়ানা হলেন। বাগদাদ, মক্কা শরীফ, মালটা, লারিন্দা প্রভৃতি শহর হয়ে অবশেষে কোনিয়া শহরে হাজির হন।

 

কোনিয়া রোমের একটি প্রাচীন শহর। ফোরাত নদীর তীরে শহরটি অবস্থিত। আলাউদ্দীন কায়কোবাদ তখন কোনিয়ার শাসনকর্তা। তিনি তাঁদেরকে সেখানে থাকার অনুমতি দিলেন। তাঁরা স্থায়ীভাবে রোমে বসবাস করতে থাকেন। সেই স্থানের নাম অনুসারে মাওলানা জালাল উদ্দীন ‘রুমী’ নামে প্রসিদ্ধি লাভ করেন।

বালক রুমী শিক্ষা জীবন শুরু হয় পিতার কাছে। সায়্যীদ বোরহানউদ্দীন ছিলেন সেকালের মস্ত বড় জ্ঞানী ব্যক্তি। তাঁর কাছেই রুমীর প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় এবং প্রথম চার পাঁচ বছর তাঁর কাছেই শিক্ষা লাভ করেন তিনি। মাত্র কয়েক বছর বয়স তাঁর। এই বয়সেই তিনি কুরআন মুখস্থ করে ফেললেন। খুবই সুন্দর ও ভক্তি সহকারে কুরআন তিলাওয়াত করতেন। কুরআন তিলাওয়াতের সময় দু’চোখ দিয়ে তাঁর অশ্রু গড়িয়ে পড়তো অনবরত। অবাক হওয়ার মতো ব্যাপার। কেবল বই পুস্তকের মধ্যেই রুমীর জ্ঞান সীমাবদ্ধ ছিলো না। রুমী বাল্য বয়সেই মুখস্ত করেছলেন অনেক হাদীস।

রুমীর বয়স যখন পাঁচ বছর তখন তাঁর বাবা মা পবিত্র হজ্জ পালনের উদ্দেশ্যে মক্কা যাত্রা করেন। সেই সময়ের তিনি মধ্যপ্রাচ্যের সব দেশ দেখার সুযোগ পান। এতে তাঁর জ্ঞান অনেক বেড়ে যায়।

শায়েখ ফরিদউদ্দীন আত্তার ফারসী সাহিত্যের একজন বড় কবি। শুধু নাম করা কবি নন, তিনি একজন দার্শনিক ও বিখ্যাত সূফী দরবেশ ছিরেন। রুমীর বয়স যখন বার বছর তখন তাঁর বাবা নিশাপুরে মায়েখ ফরিদউদ্দীন আত্তারের কাছে তাঁকে নিয়ে যান।

 

বালক রুমীকে দেখেই শায়েখ ফরিদউদ্দীন আত্তার খুব খুশী হলেন। রুমীর প্রতিভা দেখে তিনি অবাক হয়ে বললেনঃ এই বালক সারা দুনিয়ায় এমন জ্ঞানের আগুন জ্বালাবে যে আগুনে পড়ে বহু মানুষ খাঁটি সোনায় পরিণত হবে। যতদিন দুনিয়া টিকে থাকবে ততদিন তাঁর নাম মুছে যাবে না। সবাই সুনাম করবে।

সুফী দরবেশ কাকে বলে? যাঁরা আল্লাহর জ্ঞান সাধনায় সাধক হয়েছে তাঁদেরকে বলা হয় সুফী দরবেশ। শামস-ই-তাব্রিজ ছিলেন এক বড়ো সুফী ও দরবেশ। মাওলানা রুমী তাঁর কাছে আধ্যাত্মিক শিক্ষা গ্রহণ করেন। বালক রুমীর জীবনে চার জন পণ্ডিত ও জ্ঞানী ব্যক্তির আবদার সব চেয়ে বেশী। তাঁদের মধ্যে প্রথম হচ্ছেন তাঁর তাবা মোহাম্মদ বাহাউদ্দীন, দ্বিতীয় ফরিদ উদ্দীন আত্তার, তৃতীয় সায়্যীদ বোরহান উদ্দীন এবং চতুর্থ শামস-ই-তাব্রিজ।

ধর্ম নিয়ে আলোচনায় মশগুল থাকতেন তিনি। মাত্র ছয় বছর বয়স থেকে তিনি রীতিমত রোযা রাখা শুরু করেন। ছোটবেলায় খেলাধুলায় সময় কাটাতেন না। যেখানে সেখানে আড্ডা দিতেন না। সব সময় শুধু ভাবতেন আর ভাবতেন। তিনি ভাবতেন কে তিনি? কী এই পৃথিবী? কোত্থেকে এতো কিছুর আগমন? কোথায় আবার তারা ফিরে যাচ্ছে? এমনি ভাবনায় সময় কাটতো তাঁর।

মহাকবি রুমী মুসলমানদের কাছে খুবই পরিচিত। শুধু কি তাই? তাঁর লেকা মহাকাব্য মাসনুবী মুসলমানদের অত্যন্ত প্রিয় মহা গ্রন্থ।

 

মাসনুবী ফার্সী ভাষায় রচিত। সবাই নাম দিয়েছে ‘মাসনুবী শরীফ’। পৃথিবীর সবকটি সেরা ভাষায় মাসনুবীর অনুবাদ হয়েছে। প্রায় তেতাল্লিশ বছর ধরে কঠোর পরিশ্রম করে তিনি মাসনুবী শরীফ লিখেছেন। মাসনুবীর ভাষ্য সহজ-বর্ণনা ভংগী খুবই মধুর। বাংলা ভাষায় মাসনুবীর অনুবাদ হয়েছে। ইউরোপের এক নামকরা মনীষী উউলিসন তাঁর নাম। তিনি মাসনুবী শরীফ ইংরেজীতে অনুবাদ করেছেন। তিনি বলেছেন দুনিয়ার সব ধরনের মানুষেরই মাসনুবী পাঠ করা উচিত। কারণ এতে শুধু ধর্মের কথাই বলা হয়নি, এটা হচ্ছে সকল মানুষের জীবনের তত্ত্বকথা।

রুমীর মাসনুবী শরীফের একটি সুন্দর কাহিনী বলছি শোনো। অনেক অনেক দিন আগের কথা। মহা পরাক্রমশালী এক সম্রাট ছিলেন। একদিন সম্রাট মন্ত্রীদেরকে সাথে করে শিকার করতে বের হলেন। বন আর বন। সেই বনের গাছপালার ফাঁকে ফাঁকে তিনি হাঁটছেন। হঠাৎ সম্রাটের চোখে পড়লো এক সুন্দরী ক্রীতদাসী। সম্রাট সুন্দরী ক্রীতদাসীর রূপে মুগ্ধ হলেন। মুগ্ধ বাদশাহ অনেক অনেক টাকা দিয়ে ক্রীতদাসীকে মুক্ত করে নিলেন। সুন্দরী ক্রীতদাসী বাদশার সাথী হলো। বাদশাও ক্রীতদাসীকে পেয়ে খুব খুশী। কিন্তু আল্লাহর কুদরতী খেলা কে বুঝতে পারে। হঠাৎ করে ক্রীতদাসী রোগে অসুস্থ হয়ে পড়লো।

 

বাদশার অবস্থাটা কেম ছিলো একটু ভেবে দেখো। প্রবাদ আছে এক ব্যক্তির গাধা ছিলো, কিন্তু ছিলো না গাধা পালার মত কোন লোক! আবার যখন গাধা পালার লোক যোগাড় হলো, অমনি বাঘে ধরে নিয়ে গেলো গাধাটি। ছিলো একটি কলসী, কিন্তু পানি ছিলো না তাতে। পানি যখন পাওয়া গেলো, তখনই কলসিটি ভেঙ্গে গেলো। বাদশার কপালও ছিলো ঠিক তেমন।

বাদশাহ দেশ বিদেশের নামকরা ডাক্তার ডাকলেন। ডাক্তারদেরকে বললেনঃ আমার এবং ক্রীতদাসীদের-এ দুইজনের জীবন নির্ভর করছে আপনার সুচিকিৎসার উপর। যিনি আমার প্রিয় ক্রীতদাসীকে ভালো করতে পারবেন তাঁকে দেবো অনেক অনেক মণিমুক্তা।

সেখানে ডাক্তার ছিলেন অনেক। বাদশার কথায় সবাই বললেনঃ চিন্তা করবেন না জাঁহাপনা। আমরা আমাদের সকল ডাক্তারী জ্ঞান দিয়ে আপনার ইচ্ছা পূর্ণ করতে চেষ্টা করবো। আমরা এক একজন চিকিৎসা বিজ্ঞানের এক এক বিভাগে পারদর্শী। সকল রোগের ওষুধ আছে আমাদের হাতে।

কিন্তু ডাক্তাররা শত চেষ্টা করেও রোগীকে আর ভালো করতে পারলেন না। সুন্দরী ক্রীতদাসী প্রায় মর মর অবস্থা। বাদশার চোখে পানি। তিনি দেখলেন এক একটি ওষুধ দেওয়ার পর সৃষ্টি হয় এক একটি রোগ। সবাই ভেবে অবাক! কিন্তু কেন এমন হলো বলতে পারো? ডাক্তাররা ক্রীতদাসীর চিকিৎসা করতে গিয়ে ভুলে গিয়েছিলেন আল্লাহর নাম। তাঁরা ছিলেন অহংকারী। তাঁরা তাঁদের নিজেদের গর্বে এতই মত্ত ছিলেন যে একবারও বললেন না ইনশাআল্লাহ। আর তোমরা জান আল্লাহ অহংকারীকে পছন্দ করেন না।

ডাক্তারদের ওষুধে কোন কাজ হচ্ছিলো না বাদশাহ তা বুঝতে পারলেন। কারণ বাদশাহ ছিলেন খুবই আল্লাহভক্ত। আল্লাহর রহস্য সম্পর্কে ছিলেন তাঁর জ্ঞান।

 

তাই বাদশাহ খালি পায়ে ছুটে গেলেন মসজিদে। মসজিদ আল্লাহর ঘর। সেখানে সবাই সমান। বাদশাহ অনুতপ্ত হলেন এবং হু হু করে কেঁদে উঠলেন। তাঁর চোখের পানিতে জায়নামায ভিজে গেল। কিছুক্ষণ কাঁদার পর বাদশাহ মুনাজাত করলেন আল্লাহর দরবারে। বাদশাহ দু’হাত তুলে আল্লাহর দরবারে কাঁদতে কাঁদতে এক সময় ঘুমিয়ে পড়লেন। ঘুমের মধ্যে বাদশাহ স্বপ্নে দেখলেন, একজন পরহেজগার লোক বাদশাহকে বলছেনঃ হে বাদশাহ, আল্লাহর দরবারে তোমার মুনাজাত কবুল হয়েছে।

সকাল বেলায় বাদশাহ দেখলেন এক পরহেজগার হেকিম তার দেহলীযে উপস্থিত। প্রেমিক বাদশাহ হেকিমকে জড়িয়ে ধরে আলিঙ্গন করলেন।

হেকিম সুন্দরী ক্রীতদাসীর সাথে আলোচনা করলেন তার রোগ সম্পর্কে। হেকিম বাদশাকে বললেনঃ ক্রীতদাসীর মানসিক রোগ হয়েছে। অন্য কোন ওষুধে তাঁর রোগ ভালো হবে না। ক্রীতদাসীর ইচ্ছামত তার মনের চিকিৎসা করার পর সুন্দরী ক্রীতদাসী ভালো হয়ে উঠলো। প্রেমের কারণেই সুন্দরী ক্রীতদাসী অসুত্থ হয়ে পড়েছিলো। আধ্যাত্মিক প্রেমকে বুঝানোর জন্য রুমী এরূপ প্রেমের উল্লেখ করেছেন তাঁর লেখা মাসনুবী শরীফে। মাসনুবী শরীফের জন্যই লোকেরা তাঁকে উপাধি দিলো বিশ্বপ্রেমিক। সবাই বলে তাঁকে বিশ্ব প্রেমিক রুমী।

বিশ্ব প্রেমিক রুমী কবি হিসেবে পরিচিত হলেও আসলে তিনি ছিলেন মহাসাধক ও সুফী। এ কারণে মুসলমারনা অত্যন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে তাঁর নাম করে।

তোমরাও বড় হয়ে এই মহা সাধকের জীবনী পড়বে।

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

দুঃখিত!