- বন্ধুরা আজ যে গল্পটি আপনাদের সামনে নিয়ে এসেছি তা নিছক কোনো কল্পকাহিনি নয়।
এই ঘটনাগুলো আমাকে পাঠিয়েছেন আলভি তামিম, যিনি স্বয়ং এই নদীর পাড়ের বাসিন্দা এবং বহু বিভীষিকার চাক্ষুষ সাক্ষী।
আলভি বলেছেন, “বরিশালের বানারীপাড়ার বুক চিরে বয়ে চলেছে সন্ধ্যা নদী। এই একটা নদী,যা শত মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে।শান্ত নদী হঠাৎ অশান্ত হয়ে লঞ্চ ডুবে ৩০–৪০ জনের বেশি মানুষ মারা যায়।
সন্ধ্যা নদী শুধু নদী নয়; এ এক অদৃশ্য দানব, যার অতল গহ্বরে লুকিয়ে আছে শত শত মানুষের প্রাণ। ।”
নদীর পাড়ে বড় হওয়ার কারণে তার নিজের চোখে দেখা এবং দাদু-পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে শোনা তিনটি হাড়হিম করা ঘটনা নিচে তুলে ধরছি। মনোযোগ দিয়ে পড়ুন, কারণ এই নদী আপনার চিন্তার চেয়েও অনেক বেশি ভয়ঙ্কর!
ঘটনা ১:(দাদুর মুখে শোনা)
সালটা ছিল ১৯৯০-এর দশকের শেষ দিক। আমার দাদুর কাছ থেকে শোনা এই ঘটনাটি সন্ধ্যা নদীর ভয়াল চরিত্রের প্রথম উদাহরণ।
সেদিন সন্ধ্যায় আমার এক দূর সম্পর্কের দাদা নদীতে মাছ ধরতে গিয়েছিলেন। তিনি পেশায় জেলে ছিলেন না কিন্তু শখের বশে প্রায়ই যেতেন। হঠাৎ তিনি লক্ষ করলেন নদীর জল অস্বাভাবিকভাবে ফুঁসছে এবং অসংখ্য মাছ পানির ওপর লাফিয়ে উঠছে যেন তারা কোনো এক বিপদ থেকে পালিয়ে যেতে চাইছে। লোভ সামলাতে না পেরে তিনি মাছ ধরার জন্য জলে নামলেন।
কিন্তু নামার মুহূর্তেই ঘটে গেল সেই অলৌকিক কাণ্ড!
দাদা অনুভব করলেন কিছু একটা অদৃশ্য ও প্রচণ্ড শক্তিশালী হাত তাঁর পা দুটোকে শক্ত করে চেপে ধরে নিচের দিকে টেনে নিচ্ছে। তাঁর মনে হলো যেন জলের নিচ থেকে কেউ বা কিছু তাকে টেনে বালির গভীরে গেঁথে দিতে চাইছে। তিনি প্রাণপণে চিৎকার করলেন। কিন্তু সন্ধ্যার ঘন কুয়াশা এবং নদীর অদ্ভুত নীরবতা যেন তাঁর কণ্ঠস্বর গিলে নিল। চারপাশের বাতাস নিথর কিন্তু তাঁর পায়ের নিচের শক্তিটি ছিল ভয়ানক।
ভাগ্যক্রমে কাছেই থাকা কয়েকজন লোক তাঁর অস্ফুট চিৎকার এবং জলের অস্বাভাবিক শব্দ শুনতে পেয়ে ছুটে আসে। তারা এসে দেখে দাদা গলা পর্যন্ত নদীর বালু-কাদায় ডুবে আছেন, উদ্ধারের জন্য প্রাণপণে আকুতি জানাচ্ছেন। সকলে মিলে বহু কষ্টে তাঁকে ধরাধরি করে তীরে তুলে আনেন এবং দ্রুত বাড়ি নিয়ে যান।
বাড়িতে আসার পর তিনি কাঁপতে কাঁপতে সেই ভয়ানক অভিজ্ঞতার কথা জানান। তিনি বলেন, “মনে হচ্ছিল নদীর তলা থেকে এক বিশাল শক্তি আমায় চেপে ধরেছে, যার সঙ্গে লড়ার ক্ষমতা আমার ছিল না। আমি শুধু টেনে নামার অনুভব করছিলাম।”
কিন্তু নদীর অভিশাপ সেখানেই শেষ হয়নি। গভীর রাতে দাদার প্রচণ্ড জ্বর আসে। সেই জ্বর কিছুতেই কমছিল না। এবং পরদিনই, সন্ধ্যার ঠিক আগে আগে, তিনি মারা যান। সবাই বলাবলি করতে লাগল নদী নাকি প্রথমে তাঁকে ফিরিয়ে দিলেও, তার শিকারকে শেষ পর্যন্ত ছাড়েনি। অদৃশ্য সেই হাত যেন তাঁর প্রাণটাই কেড়ে নিল। এই ঘটনা আমাদের মনে নদীর প্রতি এক চিরস্থায়ী ভয় ঢুকিয়ে দেয়।
ঘটনা ২: (দাদুর স্মৃতিচারণ)
সন্ধ্যা নদীর বুক চিরে বয়ে গেছে একটি বিশাল চর, যার নাম তালা প্রসাদ। এই চরটিকে ঘিরে এলাকার মানুষের মনে এক গভীর আতঙ্ক। দিনের আলোতেও কেউ সহজে সেখানে যেতে সাহস করে না। লোকমুখে প্রচলিত এটি অতিশয় অভিশপ্ত। এখানে বহু দুর্ঘটনা ঘটেছে, বহু মানুষ প্রাণ হারিয়েছে এবং অনেকেই সেখানে গিয়ে আর কোনোদিন বাড়ি ফিরে আসতে পারেনি।
আমার দাদুর মুখে শোনা, এই ঘটনাটি ঘটেছিল আমার বয়স যখন মাত্র চার বছর।
এক দুপুরে আমার এক সম্পর্কিত দাদা তালা প্রসাদের চরে গরুর জন্য ঘাস কাটতে গেলেন। সময় গড়িয়ে দুপুর পেরোলো বিকেল গেল, তারপর সন্ধ্যা নেমে এলো তবুও তিনি ফেরেন না। পরিবারের সকলে চিন্তিত হয়ে পড়ল। যখন চারিদিকে জানাজানি হলো, ততক্ষণে নদীপথ ঢেকে গেছে সন্ধ্যার অন্ধকারে। দ্রুত একটি ট্রলার নিয়ে ১০-১২ জন মানুষ তাঁকে খুঁজতে তালা প্রসাদের দিকে রওনা হলো।
প্রায় ৫-১০ মিনিট খোঁজাখুঁজির পর, নদীর ধারে এক ভয়ঙ্কর অবস্থায় তাঁকে খুঁজে পাওয়া গেল। দৃশ্যটি ছিল হাড়হিম করা তাঁকে পাওয়া গেল উল্টো অবস্থায়! তাঁর মাথা ছিল মাটির নিচে গেঁথে থাকা আর দুটো পা উপরে, অস্বাভাবিকভাবে আকাশের দিকে তোলা। অলৌকিকভাবে তখনও তাঁর প্রাণ ছিল।
সকলে দ্রুত তাঁকে উদ্ধার করে বাড়ি নিয়ে আসেন। কিন্তু এর পরের দিনগুলো ছিল এক জীবন্ত নরক। তাঁকে সুস্থ করার জন্য বহু হুজুর-ফকির দেখানো হলো কিন্তু কেউ কোনো উপকার করতে পারল না। সবাই একবাক্যে বলল, “আল্লাহর অশেষ দয়া ছিল, আর আপনারা সঠিক সময়ে গিয়েছেন, তাই জীবিত পেয়েছেন। আর একটু দেরি হলে তাঁকে জীবিত পেতেন না।”
কিন্তু জীবনের বাকি দিনগুলো তাঁর জন্য ছিল অভিশাপস্বরূপ। তিনি আর কোনোদিন নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারেননি। একেবারে পঙ্গু মানুষের মতো বিছানায় পড়ে রইলেন। জীবিত থেকেও তিনি যেন ছিলেন সন্ধ্যার গ্রাসে। এভাবে তিন-চার মাস কষ্ট ভোগের পর তিনি অবশেষে মারা যান। তালা প্রসাদের অভিশাপ যেন তাঁকে তিলে তিলে শেষ করে দিল।
ঘটনা ৩:( নিজের চোখে দেখা)
এটি আমার নিজের চোখে দেখা এক ভয়ংকর দৃশ্য। আমি তখন ক্লাস এইটে পড়ি এবং আমার জেডিসি পরীক্ষা আসন্ন। আমি মাদ্রাসার ছাত্র ছিলাম, তাই মনোযোগ দিয়ে রাত আটটার দিকে পড়ার টেবিলে বসেছিলাম। চারপাশে তখন শীতের রাত নেমেছে।
হঠাৎ নদীর দিক থেকে ভেসে এলো এক আতঙ্কের চিৎকার: “বাঁচান! আমাদের বাঁচান!”
চিৎকার শুনে আমার চাচাতো ভাই দ্রুত ঘরের বাইরে দৌড় দিল, আমি বই রেখে সঙ্গে সঙ্গে তার পিছু নিলাম। বাইরে তখন ঘন কুয়াশা আর অন্ধকার। নদীর এপার থেকে ওপার ভালো করে দেখা যাচ্ছিল না, শুধু শোনা যাচ্ছিল পানির ঢেউয়ের এক অদ্ভুত ভয়ংকর শব্দ।
ভাইয়ের পিছু পিছু নদীর ঘাটে গিয়ে দেখলাম, এক মাঝবয়সী মহিলা কাঁপতে কাঁপতে চিৎকার করছেন। তিনি ভয়ে জ্ঞান হারানোর উপক্রম। ভিড় জমে গেলে তিনি যে কথাগুলো বললেন তা শুনে উপস্থিত সবার মেরুদণ্ড দিয়ে এক ঠান্ডা স্রোত নেমে গেল।
তিনি জানান, তিনি তাঁর স্বামী এবং নাতিকে নিয়ে নৌকায় ছিলেন। হঠাৎ মাঝনদীতে তিনি দেখলেন, কালো অস্পষ্ট কি যেন একটা তাদের নৌকার সঙ্গে সঙ্গে পানির ওপর দিয়ে হেঁটে চলেছে। এই দৃশ্য দেখে তাঁর কোলে শুয়ে থাকা নাতি ভয়ে চিৎকার করে ওঠে। ঠিক সেই মুহূর্তেই, যেন শূন্য থেকে এক প্রচণ্ড দমকা বাতাস শুরু হলো! সেই বাতাস নৌকাটিকে মুহূর্তের মধ্যে গোল চক্কর খাইয়ে ডুবিয়ে দিল। চারদিকে শুধু অন্ধকার।
কোনমতে সাঁতরে তীরে উঠে এসেছেন তিনি, কিন্তু স্বামী নেই নাতি নেই। “ওদের খুঁজে দাও,” বলতে বলতেই তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেললেন।
কিন্তু উপস্থিত সবাই তখন হতবাক। কারণ সেই মুহূর্তে আকাশে ছিল ঝলমলে তারা, নদীর পরিবেশ ছিল শান্ত। কোনো বড় ঢেউ বা বাতাসের চিহ্ন ছিল না। হঠাৎ এই বাতাস, গোল চক্কর আর অন্ধকার কোত্থেকে এলো কারো মাথায় ধরল না।
গ্রামের লোকজন দ্রুত মশাল আর টর্চ নিয়ে মহিলার স্বামী ও নাতিকে নদীতে খোঁজা শুরু করল। দুই-তিন মিনিট খোঁজার পরেই হঠাৎ জলের নিচ থেকে ভেসে উঠল এক লাশ। দৃশ্যটা ছিল এতটাই বীভৎস যে, আজও মনে পড়লে আমার শরীরের লোম দাঁড়িয়ে যায়।
লাশটি ছিল সম্পূর্ণ নগ্ন ঠাণ্ডা ও নিথর, এবং সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ছিল তার মাথাটি ছিল একদম উল্টো দিকে ঘোরানো! সেটি ছিল ওই মহিলার স্বামী, অর্থাৎ নাতির দাদা। নদীর অভিশাপের শিকার।
কিন্তু সেই নাতিকে… আমরা আর কেউ কোনোদিন খুঁজে পাইনি। সে যেন চিরতরে সন্ধ্যার গ্রাসে হারিয়ে গেল।
গ্রামের বয়স্করা বলেন, এই নদীতে যারা হারিয়ে গেছে, তাদের আত্মারা রাতে ঢেউয়ের সঙ্গে ফিসফিস করে কথা বলে। আর মাঝরাতে নদী নাকি হঠাৎ এক অস্বাভাবিক নিঃশব্দতা ধারণ করে ঠিক যেন শিকার ধরার আগে ওঁত পেতে থাকে কোনো হিংস্র প্রাণী।
সন্ধ্যা নদীর এই অভিশাপ, যেখানে শত মানুষের মৃত্যু, দাদা-নাতির করুণ পরিণতি, আর অদৃশ্য হাতের টানে ডুবে যাওয়া জীবিত মানুষের আর্তনাদ প্রতিটি ঢেউয়ের নিচে লুকিয়ে আছে মৃত্যুর এক অতৃপ্ত ক্ষুধা। এই নদী মানুষ গিলে নেয় ফিরিয়ে দেয় শুধু মৃত্যু।
এই গল্পটি শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের সাথে অনুভব করুন ভয় এবং মর্মস্পর্শী কাহিনীর গভীরতা।
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।