মেঘ উড়ছে আকাশে। কার্পাস তুলার মত সাদা মেঘ। এত নিচ দিয়ে মেঘটা যাচ্ছে যে ইহাবের মনে হচ্ছে এগারো তলার বারান্দা থেকে সে তা হাত দিয়ে ধরে ফেলবে। বিল্ডিংটা যদি আরো কয়েক তলা ঊঁচু হত নিশ্চিত ধরে ফেলত সে। মাঝেমাঝ কালো মেঘের পাহাড় এসে সাদা মেঘকে ঢেকে দিচ্ছে। আকাশটা কালো দেখে ইহাবের মন খরাপ হয়ে গেল। বৃষ্টি হলে বিকেল বেলার খেলাটা জলে যায়। আকাশের অবস্থা দেখে বলা মুশকিল বৃষ্টি হবে, নাকি হবে না। এ বছর বর্ষাটা আসছে দেরি করে যাচ্ছেও দেরি করে। যাই করেও যাচ্ছে না। বঙ্গমাতার গলায় পরানোর জন্য শরৎরাণী শিউলিমালা হাতে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু বর্ষার কি সেদিকে খেয়াল আছে! সে ঝরছেতো ঝরছেই।
এসব ভাবতে ভাবতে বৃষ্টিটা চলে এলো। সেকি ঝুম বৃষ্টি! পহেলা আষাঢ়ের মত সব ভিজিয়ে একাকার করে ফেলছে। বৃষ্টি দেখে ইহাবের মন যা হবার তাই হল। বারান্দার দরজাটা বন্ধ করে সে টিভি রুমে চলে গেল। টিভি রুমে বাবা টিভি দেখছেন। বর্ষার ফুলের উপর একটি প্রতিবেদন যাচ্ছিল তখন। ইহাবের বাবা মুগ্ধ হয়ে ভার্চুয়েল ফুলগুলে দেখতে লাগল। কেয়া, কদম, জুঁই, হাস্নাহেনা, গন্ধরাজসহ আরো কত প্রজাতির ফুল! ইহাব এগুলোর কোনটি দেখেছে কোনটি দেখেনি। কদম ফুলের ছবি দেখিয়ে তার বাবা জিজ্ঞেস করলেন, এগুলো কি ফুল বলতো ইহাব?
ইহাব বলল, কেন কদম ফুল!
বাবা এবার জিজ্ঞেস করলেন, কদম ফুলের ঘ্রাণ কেমন বলতো?
ইহাব বলল, আমি কি করে বলব! আমি কি কখনো কদম ফুল হাতে নিয়েছি? আমিতো শুধু বইতে দেখেছি।
বাবা আশ্চর্য হয়ে বল্লেন, কী বলো তুমি! তুমি কদমফুল কখনো সরাসরি দেখনি!
ইহাব বলল, কী করে দেখব! আমিতো কখনো বর্ষাকালে গ্রামে যায়নি! তোমরা রোজার ঈদ আর কোরবানের ঈদ ছাড়া আমাকে কখনো গ্রামের বাড়িতে নিয়েছ?
বাবা অপরাধী সুরে জবাব দিলেন, হ্যাঁ তাইতো! তোমাকে তো কখনো অন্য সময় নেয়া হয়নি। কাল সকালেই আমরা গ্রামের বাড়িতে যাব। কদম ফুল দেখব। সোঁদা মাটির গন্ধ শুঁকব।
বাপ ছেলের কথার মাঝেই ইহাবের মা এসে পড়ল রান্না ঘর থেকে। স্বামীকে ধমকিয়ে বলল, কী সব আজেবাজে বুঝাচ্ছ ছেলেকে! মাটির গন্ধ শুঁকবে! মাটির গন্ধ আবার শুঁকার কী আছে?
স্ত্রীর ধমক খেয়ে গলা নিচু হয়ে যায় ইহাবের বাবার । ইহাব খেয়াল করেছে মায়ের ধমকিতে তার বাবা শিশুর মত ছোট হয়ে গেছে। মাঝেমাঝে বাবা মায়ের এমন দৃশ্য দেখে ইহাব মনে মনে হাসে। তবে আবার ভয়েও কাজ করে মানের ভেতর। কখন বাবা রেগে জান! বাবা যখন রাগেন মা তখন থরথর করে কাঁপতে থাকে। ইহাব তখন খাটের এক কোনায় কাঁথার নিচে অথবা বারান্দায় লুকিয়ে থাকে। আজো বাবার মুড় বুঝা যাচ্ছে না। চেহারায় দু’রকমের ভাব দেখা যাচ্ছে কখন বজ্রধ্বনির মত গর্জে ওঠে। ভাবতে না ভাবতে তাই হলো।
ইহাবের বাবা তার মাকে বলল, সোঁদা মাটির তুমি বুঝবে কি? আজীবনই তো পোড়ামাটি আর চীনামাটির ভেতরে কাটিয়ে দিলে। কত করে বল্লাম ছেলেকে নিয়ে গ্রামে চলে যাই। সেখানে এখন ভালো স্কুল আছে, ছেলের খেলার মাঠ আছে, স্বাস্থ্যকর পরিবেশ আছে, বিশুদ্ধ খাবার আছে। ইহাবের মা উত্তরে বলল: কিন্তু শহরে যে সুযোগ সুবিধাগুলো আমরা পাচ্ছি গ্রামে কি তা পার? বিশেষ করে তোমার একটা ভালো চাকরি, গ্রামে গেল তুমি এটা পেতে। জবাবে ইহাবের বাবা বলল, গ্রামে গেলে এ চাকরি হয়ত পেতাম না কিন্তু আরো ভালো কিছু করতে পারতাম। উৎপাদন করতাম। চাকরির ক্ষেত্র তৈরি করতাম। তাছাড়া কিছু পেতে হলে কিছু ছাড়তে হয়। এখন যেহেতু আমরা এখানে বসবাস শুরুই করে দিয়েছি এটাই আমাদের বাসস্থান। তবে মাথায় রাখতে হবে আমাদের মূল শেকড় গ্রামে। প্রয়োজনের তাগিদে এ শহরে আমাদের অবস্থান।
পরের দিন সকাল বেলা।
ইহার এবং তার বাবা মা তিনজন মিলে গ্রামের উদ্দেশে রওনা হল। গাড়ির জানালা দিয়ে তারা সারা পথ কদম ফুল খুঁজেছে। পায়নি। গাড়ি থেকে নেমে বাড়ি যাচ্ছিল তারা তখন পুকুর পাড়ে কয়েকটি কদম গাছ চোখে পড়ল তাদের। কিন্তু গাছের কোথাও কদম ফুল নেই। মৌ সন্ধ্যার মত কদম ফুলও যেন জীবনে একবার ফুটে ঝরে যায়। ইহাবের বাবা বাড়ির লোক জনকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারল, এ বছর নাকি কদম ফোটেনি। গত কয়েক বছর এমনটি হচ্ছে।
ইহাবের বাবা কথাটি শুনে অবাক হলেন। বর্ষা কালে কদম ফোটে না! এ কেমন কথা। শহরে ফেরার সময় সারা পথ তিনি এ বিষয় নিয়ে ভাবতে লাগলেন। স্বামীর মুড অপ দেখে ইহাবের মা বল্লেন, মন খারাপ করার জন্যে তুমি আর বিষয় পাওনি বুঝি? এ সব আজগুবি বিষয় তোমার মাথায় কেন আসে? এগুলো নিয়ে তো পরিবেশবিদরা ভাববে? তুমি ভাববা দুই টাকা কীভাবে বেশি রোজগার করা যায়। ইহাবের বাবা ঠান্ডা মাথায় বুঝিয়ে দিলেন, আবহাওয়া, পরিবেশ, জলবায়ু এ সব ভালো না থাকলে মানুষের মাঝে বড় বড় রোগের জম্ম হয়। বর্তমানে মানুষের গড় আয়ু কমার এটাও একটা কারণ। একটা সময় বাংলাদেশকে ছয় ঋতুর দেশ বলা হত। আর এখন! গ্রীষ্ম আর শীত। আগামী পঞ্চাশ বছর পর হয়ত একটা ঋতুই থাকবে আমাদের দেশে। হয়ত গ্রীষ্ম, না হয় শীত। যার ফলে আমরা শুধু কদম ফুল কেন, আরো কত কিছু থেকে যে বঞ্চিত হব! তার ইয়াত্তা আছে? শুধু কদম ফুলের কথাইবা বলব কেন আম কাঁঠালের কথা ভাব। গ্রামে কোথাও একটা আম দেখছ? দেখনি। দেখবাও না। দূষিত পরিবেশের কারণে বৃষ্টি নেই। বৃষ্টি না থাকলে আম আসবে কোথা থেকে। কাঁঠাল আসবে কোথা থেকে। অতএব ফরমালিনের আম খাও, ফরমালিনের জাম খাও! এই আকাশ, এই মাটি, এই পরিবেশকে বাঁচিয়ে রাখা আমাদের সকলেরই কর্তব্য। নতুবা আমরা পরবর্তী প্রজম্মের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ থাকব।
বাবা মায়ের কথা শুনতে শুনতে ইহাব প্রায় ঘুমিয়ে পড়েছে। নাস্তার বিরতির জন্য মাঝপথে একটি অভিজাত রেস্টুরেনেটর সামনে তাদের গাড়ি দাঁড়াল। ইহাবের বাবা তাকে জাগাল। বাবা, মা, ছেলে তিনজন মিলে রেস্টুরেন্টে ঢুকল। রেস্টুরেন্টে ঢোকার পথেই সাজানো রয়েছে বিভিন্ন প্রকার মিষ্টি। ইহাব তার বাবাকে একটি মিষ্টি সন্দেশে দেখিয়ে বলল, বাবা কদমফুল! ইহাবের বাবা তাকিয়ে দেখে সাদা সন্দেশটাকে সত্যিই কদম ফুলের মত দেখাচ্ছে। তিনি সন্দেশটাকে হাত নিয়ে ছেলের মুখে পুরে দিলেন। ইহাব সন্দেশ খেতে খেতে তার বাবাকে বলল, বাবা কদম ফুল বুঝি মিষ্টি হয়! ইহাবের বাবা, মা দু’জনেই নিরুত্তর। জবাব দেয়ার যেন তাদের কোন ভাষা নেই।
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।