সা‘দ আল-আসওয়াদ আস-সুলুমী (রাঃ) – তিনি ছিলেন গরিব, গায়ের রঙ কালো। কেউ তাঁর কাছে নিজের মেয়েও বিয়ে দিতে চাইত না।
সা‘দ (রাঃ) একদিন আল্লাহর রাসূল (সাঃ)-এর কাছে দুঃখ করে বলেছিলেন,
“ইয়া রাসূলুল্লাহ! আমিও কি জান্নাতে যাব? আমি তো নীচু মাপের ঈমানদার হিসেবে বিবেচিত হই। কেউ আমাকে নিজের মেয়ে দিতে রাজি হয় না।”
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) সাহাবীদের দুঃখ বুঝতেন নিজের আপন ভাইয়ের মতো করে, নিজের সন্তানের মতো করে। তিনি তাদেরকে অনুভব করতেন অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে। তিনি এই সা‘দকে পাঠিয়েছিলেন ইবন আল-ওয়াহহাবের কাছে। সাধারণ কোনো ব্যক্তি ছিলেন না ইবন ওয়াহহাব। তিনি ছিলেন মদীনার নেতাদের একজন; কিছুদিন যাবৎ মুসলিম হয়েছেন। তাঁর মেয়ে অপরূপা সুন্দরী রমণী, রূপের জন্য বিখ্যাত। সেই ইবন ওয়াহহাবের মেয়েকে বিয়ে করার জন্য রাসূলুল্লাহ (সাঃ) সা‘দকে পাঠালেন।
নেতার মেয়ে বিয়ে করবে সা‘দের মতো একজনকে? যে তার সৌন্দর্যের জন্য এত প্রসিদ্ধ, সে হবে সা‘দের বউ? স্বাভাবিকভাবেই ইবন ওয়াহহাবের প্রতিক্রিয়া ছিল “আকাশ-কুসুম কল্পনা ছেড়ে বাড়ি যাও”… কিন্তু তাঁর মেয়ে ততক্ষণে শুনে ফেলেছে। সে বলে উঠল, “বাবা! আল্লাহর রাসূল (সাঃ) অনুরোধ করেছেন তাকে বিয়ে করার জন্য, তুমি কিভাবে তাঁকে ফিরিয়ে দিতে পারো? রাসূলের উৎকণ্ঠা থেকে আমরা মুখ ফিরিয়ে নিলে আমাদের অবস্থানটা কী হবে?” এরপর সা‘দের দিকে ফিরে বলল, “রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে গিয়ে বলে দিন, আমি আপনাকে বিবাহ করার জন্য প্রস্তুত।”
সা‘দের মন সেদিন আনন্দে পুলকিত… সে যেন খুশিতে টগবগ করে ফুটছে… রাসূলুল্লাহ (সাঃ) চারশ দিনার মোহরানায় তাদেরকে বিয়ে দিয়ে দিলেন। আলহামদুলিল্লাহ! সুবহানাল্লাহ!
সা‘দ বললেন, “হে রাসূল, আমি তো জীবনে কোনোদিন চারশ দিনার দেখিইনি! আমি এই টাকা কীভাবে শোধ করব?” নবীজি (সাঃ) তাকে বললেন, আলী, আল-নুমান ইবন আউফ আর উসমান (রাঃ)-এর কাছ থেকে দুইশ দুইশ করে মোট চারশ দিনার নিয়ে নিতে। দুজনেই তাঁকে দুইশর বেশি করে দিনার দিলেন। আলহামদুলিল্লাহ! টাকার জোগাড়ও হয়ে গেল।
এখন নতুন বউয়ের কাছে যাবেন সা‘দ (রাঃ)… মার্কেটে গিয়ে সুন্দরী বউয়ের জন্য টুকিটাকি কিছু উপহার কেনার কথা চিন্তা করলেন তিনি। মার্কেটে পৌঁছে গেছেন, হঠাৎ তাঁর কানে আসল জিহাদের ডাক—“যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়ে যাও”। সা‘দ যেখানে ছিলেন সেখানেই দাঁড়িয়ে গেলেন। আকাশের দিকে তাকালেন একবার, বললেন, “হে আল্লাহ! আমি এই টাকা দিয়ে এমন কিছু কিনব যা তোমাকে খুশি করবে।”
নতুন বউয়ের জন্য উপহার কেনার বদলে তিনি কিনলেন একটি তরবারি আর একটি ঘোড়া। এরপর ঘোড়া ছুটিয়ে চললেন জিহাদের ময়দানে, নিজের চেহারাটা কাপড় দিয়ে মুড়ে নিলেন, যেন আল্লাহর রাসূল (সাঃ) তাঁকে দেখে চিনে ফেলতে না পারেন। কারণ রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাঁকে দেখলেই তো বাড়িতে পাঠিয়ে দেবেন! সে যে সদ্য-বিবাহিত! সাহাবারা (রাঃ) বলাবলি করছিলেন, যুদ্ধ করতে আসা এই মুখঢাকা লোকটি কে? আলী (রাঃ) বললেন, “বাদ দাও, সে যুদ্ধ করতে এসেছে।”
ক্ষিপ্ততার সাথে সা‘দ যুদ্ধ করতে থাকলেন, কিন্তু তাঁর ঘোড়ায় আঘাত হানা হলো, ঘোড়া পড়ে গেল। সা‘দ উঠে দাঁড়ালেন। ঐ সময় নবীজি (সাঃ) তাঁর কালো চামড়া দেখে ফেললেন, “ইয়া সা‘দ, এ কি তুমি?!” রাসূল (সাঃ)-এর প্রশ্নের জবাবে তিনি (রাঃ) বললেন, “আমার মা-বাবা আপনার উপর উৎসর্গিত হোক, ইয়া আল্লাহর রাসূল! হ্যাঁ, আমি সা‘দ।” মুহাম্মাদ (সাঃ) বললেন, “হে সা‘দ, জান্নাত ছাড়া তোমার জন্য আর কোনো আবাস নেই।”
সা‘দ (রাঃ) আবারো জিহাদে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। কিছু সময় পর কয়েকজন বলল সা‘দ আহত হয়েছেন। রাসূল (সাঃ) ছুটে গেলেন ময়দানে। সা‘দকে খুঁজতে লাগলেন। সা‘দের মাথাখানা নিজের কোলের উপর রেখে কাঁদতে শুরু করলেন। তাঁর অশ্রু গড়িয়ে গড়িয়ে সা‘দের মুখের উপর এসে পড়ছিল। তাঁর (সাঃ) চোখ বেয়ে নেমে আসছিল অঝোর ধারা।
একটু পর রাসূলুল্লাহ (সাঃ) হাসতে শুরু করলেন, আর তারপর মুখ ফিরিয়ে নিলেন।
আবু লুবাবা (রাঃ) নামের একজন সাহাবি তাঁকে দেখে বিস্ময়ে বললেন, “হে রাসূলুল্লাহ (সাঃ), আমি আপনাকে এমনটি কখনো করতে দেখি নি…” আল্লাহর রাসূল (সাঃ) বললেন, “আমি কাঁদছিলাম কারণ আমার প্রিয় সঙ্গী আজ চলে গেল! আমি দেখেছি সে আমার জন্য কী ত্যাগ করল আর সে আমাকে কত ভালোবাসত… কিন্তু এরপর আমি দেখতে পেলাম তার কী ভাগ্য। আল্লাহর কসম, সে ইতিমধ্যে হাউদে পৌঁছে গেছে।”
আবু লুবাবা জিজ্ঞেস করলেন, “হাউদ কী?” রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন, “এটি হলো এমন এক ঝর্ণা যা থেকে কেউ একবার পান করলে জীবনে আর কোনোদিন পিপাসার্ত হবে না; এর স্বাদ মধুর চেয়েও মিষ্টি, এর রঙ দুধের চেয়েও সাদা! আর যখন আমি তাঁর এইরূপ মর্যাদা দেখলাম, আল্লাহর কসম, আমি হাসতে শুরু করলাম।”
“তারপর আমি দেখতে পেলাম সা‘দের দিকে তাঁর জান্নাতের স্ত্রীগণ এমন উৎফুল্লভাবে ছুটে আসছে যে তাদের পাগুলো বের হয়ে পড়ছে, তাই আমি চোখ ফিরিয়ে নিলাম।”
নবীজি অতঃপর সাহাবাদের কাছে এসে বললেন সা‘দের ঘোড়া আর তরবারি নিয়ে আসতে, সেগুলো যেন সা‘দের স্ত্রীর কাছে নিয়ে যাওয়া হয়, তাকে যেন বলা হয় এগুলো তার বংশধর। তিনি (সাঃ) বললেন, “তাকে জানিয়ে দিও, আল্লাহ তাআলা সা‘দকে জান্নাতে স্ত্রী দান করেছেন, তারা তার চাইতেও অনেক সুন্দর।”
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।