সদাচরণ

সবার সাথে মিলেমিশে থাকা এবং সবার সাথে ভাল ব্যবহার করা ঈমানের অংশ। আর যারা মানুষের সাথে ভাল ব্যবহার করে তাদেরকে সবাই পছন্দ করে। ইসলামের দৃষ্টিতে ভাল ব্যবহার বা সদাচরণের গুরুত্ব অপরিসীম। মহানবী (সাঃ) বলেছেন, মহৎ গুণাবলীর পূর্ণতা দেয়ার জন্যই আমাকে পাঠানো হয়েছে। সদাচরণের গুরুত্ব সম্পর্কে তিনি বলেছেন, যে ব্যক্তির হাত ও মুখ থেকে অন্য মুসলমান নিরাপদ তাকেই প্রকৃত মুসলমান বলা হয়।

তো সদাচরণের গুরুত্ব সম্পর্কে আমরা একটি বিশেষ অনুষ্ঠান প্রচার করেছি। একথা সবাই স্বীকার করে যে, সুখ-শান্তি অর্জনের লক্ষ্যে দুনিয়ার মানুষ বিভিন্নভাবে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কল্পনার সুখপাখিকে খাচায় বন্দী করা সম্ভব হচ্ছে না বরং দিন দিন অশান্তি যেন বেড়েই চলেছে। এর পেছনে অবশ্য অনেক কারণ আছে। মূল কারণটি হচ্ছে, সদাচরণের অভাব। একজন মানুষ যদি অপর মানুষের প্রতি নিজ নিজ দায়িত্ব-কর্তব্য ঠিকমতো পালন করে, তাদের অধিকারের প্রতি গুরুত্ব দেয় তাহলে এত অশান্তি, মারামারি, হানাহানি, হিংসা-বিদ্বেষ থাকতো না।

পৃথিবীর শক্তিধর দেশগুলো যদি দুর্বল দেশগুলোর প্রতি সদাচরণ করতো, তাদের প্রতি জুলুম-নির্যাতন না করতো- তাহলে পৃথিবী শান্তি-সুখে ভরে যেত। অবশ্য কিছু দেশ এখনও দুর্বলদের অধিকারের পক্ষে কথা বলছে, শক্তিধরদের অন্যায়ের প্রতিবাদ জানাচ্ছে। কিছু দেশের পাশাপাশি কিছু মানুষও আছেন, যারা মানুষের মঙ্গল কামনায় সব সময় চেষ্টা চালান। তারা মানুষে মানুষে ভেদাভেদ করেন না, সবার সাথে উত্তম আচরণ করেন। এ সমস্ত মানুষ সমাজের সবার কাছ থেকে যেমন সম্মান ও শ্রদ্ধা পান তেমনি ব্যক্তি জীবনেও সাফল্য লাভ করেন।

পশ্চিমা একজন লেখক এ প্রসঙ্গে বলেছেন, উত্তম ব্যবহারকারী ও সদা প্রফুল্ল মুখমন্ডলের অধিকারী লোকের জন্য সকল দরজা খোলা থাকবে আর বদমেজাজী লোকদেরকে দরজা খোলার জন্য ডাকাতের মত আঘাত করতে হবে। ইমাম জাফর সাদেক বলেছেন, দয়া ও নম্র ব্যবহার জমিনকে অধিক ফলনশীল করে এবং মানুষের আয়ু বৃদ্ধি করে। তিনি আরও বলেছেন, মানুষের সুখের একটা দিক হচ্ছে তার অমায়িক ব্যবহার। অমায়িক ব্যবহার কেবল মানসিক প্রশান্তিই দেয় না, এর মাধ্যমে জীবনে সাফল্যও লাভ করা যায়।

বন্ধুরা, তোমরা নিশ্চয়ই জানো যে, রাসূল (সাঃ)কে অনেক বাধা-বিঘ্ন ও ষড়যন্ত্রের মোকাবেলা করে ইসলাম প্রচার করতে হয়েছে। সকল ষড়যন্ত্র, জুলুম-নির্যাতন ও বাধা-বিঘ্নকে তিনি মোকাবেলা করেছে উত্তম আচরণ দিয়ে। আল্লাহপাক এ সম্পর্কে বলেছেন, “আপনি যদি কঠোর ও নির্মম হতেন তাহলে তারা নিশ্চিতভাবে আপনার পাশ থেকে সরে যেত।” এ আয়াত থেকে সদাচরণের গুরুত্ব উপলব্ধি করা যায়। সদাচরণের কারণে মানুষ যেমন সফলতার মুখ দেখে, তেমনি তার মাধ্যমে বেহেশত লাভ করাও সহজ হয়। রাসূল (সাঃ) যেমনটি বলেছেন, আল্লাহর ভয় এবং উত্তম আচরণ আমার উম্মতকে বেহেশতে দাখিল করবে।

সদাচরণের গুরুত্ব সম্পর্কে জানা গেল। তবে শুধু জানার মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে এখন থেকেই সবার সাথে সদাচরণ করতে হবে। পিতামাতা, পরিবার-পরিজন, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, প্রতিবেশী, গরীব-মিসকিন, অসুস্থ ব্যক্তি, প্রতিবন্ধী সবার সাথে উত্তম আচরণ করতে হবে। মনে রাখতে হবে এক মুসলমানের সাথে আরেক মুসলমানের সম্পর্ক ভ্রাতৃত্বের। মহান আল্লাহ্ বলেছেন, “মুমিনগণ পরস্পর ভাই ভাই।” এ বিষয়ে সূরা আলে ইমরানে বলা হয়েছে, “আল্লাহর সেই নেয়ামতকে স্মরণ কর যখন তোমরা পরস্পরে দুশমন ছিলে অতঃপর তিনি তোমাদের হৃদয়কে জুড়ে দিলেন আর তোমরা তাঁর মেহেরবাণীতে ভাই ভাই হয়ে গেলে।”

মহানবীও এ সম্পর্কে বলেছেন, “যে মহান সত্তার হাতে আমার প্রাণ তার কসম, কোন বান্দাহ ততক্ষণ পর্যন্ত মুমিন হতে পারে না যতক্ষণ না সে নিজের জন্য যা পছন্দ করে তার ভাই এর জন্যও তাই পছন্দ করবে।” একজন মুসলমানের সাথে অপর মুসলমানের সম্পর্ক কেমন হবে সে সম্পর্কে তো জানা গেল। তবে আরও কিছু বিষয় আছে যেগুলো ত্যাগ না করলে ব্যক্তি ও সমাজ জীবন সুন্দর হবে না। যেমন-মিথ্যা বলা, কপটতা, অপবাদ দেওয়া, ছিদ্রান্বেষণ, পরশ্রীকারতা, অহমিকা, জুলুম-নির্যাতন, শত্রুতা-ঘৃণা, ক্রোধ, গিবত, বিশ্বাসঘাতকতা, ঝগড়া-বিবাদ ইত্যাদি।

তাই এসব বদগুণ থেকে নিজেরা যেমন দূরে থাকার চেষ্টা করতে হবে তেমনি যাদের মধ্যে এসব দুর্বলতা আছে তাদেরকে সংশোধনের চেষ্টা করতে হবে ধৈর্য, প্রজ্ঞা, ক্ষমা ও অমায়িক ব্যবহার দিয়ে। এ সম্পর্কে এবারে একটি ঐতিহাসিক ঘটনা শুনবো। একদিন ইমাম সাজ্জাদ (আঃ) তাঁর অনুসারীদের নিয়ে এক মসলিশে আলোচনা করছিলেন। এমন সময় হাসান ইবনে মুসান্না নামে এক ব্যক্তি সেখানে উপস্থিত হলো এবং ইমামের কাছে এসে তাঁকে অপমান করতে লাগলো।

ইমাম সাজ্জাদ লোকটির কথায় কিছু মনে করলেন না। লোকটি চলে যাওয়ার পর তিনি তার অনুসারীদের বললেন, “আমি লোকটার আচরণের জবাব দিতে চাই। আপনারা চাইলে আমার সাথে আসতে পারেন।” ইমামের অনুসারীরা বললেন, “আমরা অবশ্যই আপনার সাথে যাবো যদিও আমরা চেয়েছিলাম লোকটাকে উচিৎ জবাব দিয়ে দেই। কিন্তু আপনার অনুমতি না পেয়ে তাকে কিছু বলিনি।”

ইমাম বললেন, “লোকটি আমার সাথে যে আচরণ করেছে তার জবাব আমাকেই দিতে হবে।” এই বলে তিনি তার সাথীদের নিয়ে লোকটির বাড়ীর দিকে রওনা হলেন। বাড়ীতে পৌঁছার পর ইমাম ও তাঁর সাথীদের দেখে হাসান ইবনে মুসান্না তাদের মোকাবেলা করার প্রস্তুতি নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। তাকে দেখে ইমাম সাজ্জাদ বললেন, “হে আমার ভাই! আপনি আমার কাছে গিয়ে কিছু কথাবার্তা বলেছেন। আপনি আমার সম্পর্কে যা কিছু বলেছেন তা যদি সত্যিই আমার মধ্যে থাকে, তাহলে আমি আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাচ্ছি আর আপনি আমার সম্পর্কে যা বলেছেন তা যদি আমার মধ্যে না থাকে তাহলে আমি আল্লাহর কাছে আপনার জন্য ক্ষমা চাইছি।”

ইমামের কথাগুলো লোকটির অন্তরকে নাড়া দিলো এবং সে অনুতপ্ত হয়ে বললো, “হে ইমাম! আমার ভুল ভেঙ্গে গেছে। আমি আপনার ব্যাপারে যেসব অভিযোগ করেছি সেসব দোষ থেকে আপনি সম্পূর্ণ মুক্ত। আসলে আমিই আপনার প্রতি অন্যায় আচরণ করেছি। আমাকে ক্ষমা করুন।” লোকটির কথায় ইমাম খুশী হলেন এবং তাকে ক্ষমা করে দিলেন। এ ঘটনার মাধ্যমে ইমাম তার অনুসারীদের শিক্ষা দিলেন, কিভাবে অন্যের ভুল উপেক্ষা করে তাকে ক্ষমা করে দিতে হয়।

তো আমরা সবাই অন্যদের প্রতি ক্ষমাশীল হবো এবং সবার সাথে ভাল ব্যবহার করবো তাহলেই আমাদের সমাজ শান্তি-সুখে ভরে উঠবে।

বরকতময় টাকা

ধনী ও দরিদ্র

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *