সত্যের জয়
হযরত আবদুল কাদের জিলানী। সবাই তাকে ডাকতো বড়পীর বলে।
বড়পীর আবদুল কাদের জিলানীর শৈশবের একটি ঘটনা। ঘটনাটি এতই চমকপ্রদ যে, আজো মানুষ শ্রদ্ধাভরে সে কথা স্মরণ করে।
তোমাদের মতই বয়স তখন তাঁর। দেখাপড়ার প্রতি দারুণ আগ্রহ। গ্রামের বাড়ির পড়া শেষ করেছেন। এখন তাঁর ইচ্ছা, বড় কোণ শহরে গিয়ে নামকরা কোণ মাদ্রাসায় পড়বে। কিন্তু তাঁর বাপ নেই। বিধবা মায়ের অভাবের সংসার। কোথায় পাবেন তিনি ছেলের পড়ার খরচ?
মা ভাবেন, এমন সোনার ছেলের আশা কি পূরণ হবে না? মানুষের কত রকম শখ থাকে। অথচ ছেলের একটাই শখ। সে অনেক পড়বে, অনেক জ্ঞানী হবে, মানুষের মত মানুষ হবে। মা দিনরাত ছেলের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবেন আর একটু করে টাকা জমান ছেলের জন্য।
একদিন আবদুল কাদের জিলানী ছাদে দাঁড়িয়ে প্রকৃতির শোভা দেখছিলেন। তিনি দেখলেন, একটি কাফেলা বাগদাদের দিকে যাচ্ছে। তাঁর অনেক দিনের শখ বাগদাদ যাওয়ার। সেখানে গিয়ে পড়া লেখা করার। তিনি নিচে নেমে মাকে আবারও তাঁর মনের কথা বললেন,
মায়ের বুক হাহাকার করে উঠল। যেখানে অন্য ছেলে পড়তে চাই না সেখানে নিজের ছেলে পড়ার জন্য উতলা, এটা কি কম সৌভাগ্যর কথা! তিনি জমানো টাকাগুলো গুনে দেখলেন সেখানে আশিটি স্বর্ণমুদ্রা আছে। টাকাটা দু’ভাগ করে এক ভাগ রাখলেন সংসার খরচের জন্য আরেক ভাগ তুলে দিলেন ছেলের হাতে। ছোট মানুষ, পথে যদি টাকাগুলো হারিয়ে ফেলে এই ভয়ে মা বগলের নিচে পকেট বানিয়ে সেখানে মুদ্রাগুলো সেলাই করে দিলেন।
মায়ের দোয়া চল্লিশটি স্বর্ণমুদ্রা নিয়ে পথে নামলেন আবদুল কাদের জিলানী। বিদায়ের সময় ছেলেকে বুকে জড়িয়ে মা বললেন, বাবা, আমার সময় আর বেশি বাকি নেই। হয়ত কেয়ামতের আগে আর আমাদের দেখা হবে না। আমার অন্তিম উপদেশ, কখনো মিথ্যা কথা বলবে না।
মায়ের এ উপদেশ বুকে নিয়ে ছেলে শামিল হলো কাফেলার সাথে।
কাফেলা এগিয়ে চললো, বাগদাদের দিকে। যেতে যেতে তারা গিয়ে পৌঁছল হামদান নামক এক জায়গায়। এলাকাটি জনমানবহীন। চারদিকে গাছপালার গভীর গঙ্গল। হঠাৎ একদল ডাকাত ঝাঁপিয়ে পড়লো তাদের ওপর। কেড়ে নিল তাদের টাকা-পয়সা,
ধন-দৌলত। লোকেরা জীবন বাঁচাতে মালসামান রেখেই পালিয়ে গেল। বালক আবদুর কাদের কি করবেন বুঝতে না পেরে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলেন। ডাকাতরা ভাবলো,
ছোট মানুষ, ওর কাছে আর কি থাকবে? সবাই ওকে রেখে লুটপাটে মন দিল। এক ডাকাত তাঁকে বলল, এই ছেলে তোমার কাছে টাকা-পয়সা কিছু আছে?
আবদুল কাদের জিলানী জবাব দিলেন, হ্যাঁ, আমার কাছে চল্লিশটি স্বর্ণমুদ্রা আছে।
বিশ্বাস হলো না ডাকাতের। বলল, কোথায় তোমার স্বর্ণমুদ্রা?
তিনি বললেন, বগলের নিচে আমার জামার সাথে সেলাই করা।
এ কথা শুনে ডাকাত তাঁকে নিয়ে গেল সর্দারের কাছে। ডাকাত সর্দার তখন লুটের মাল ভাগ-বাটোয়ারায় ব্যস্ত। সব শুনে সর্দার বললেন, জামা কেটে বগলের নিচ থেকে টাকগুলো বের করো দেখি।
জামাটি কাটা হলো। বের করে আনা হলো টাকাগুলো। শুনে দেখা গেল সত্যি সেখানে চল্লিশটি স্বর্ণমুদ্রা। ডাকাতরা ভাবলো, ছেলেটি কী বোকা! ডাকাত সর্দার বলল, তুমি আমাদের বললে কেন তোমার কাছে টাকা আছে? তুমি না বললে তো আমরা এ স্বর্ণমুদ্রার কথা জানতেও পারতাম না।
সত্যবাদী জিলানী দৃড়তাঁর সাথে বললেন, কেন বলবো না? আমার মা আমাকে মিথ্যা বলতে নিষেধ করেছেন। আল্লাহর নবী বলেছেন, মিথ্যা হল সকল পাপের মা।
আল্লাহ মিথ্যাবাদীকে ভালোবাসেন না। আল্লাহ যে কাজ অপছন্দ করেন আমি যে কাজ করতে যাব কেন? কিন্তু তুম না বললে তো এ টাকাগুলো হারাতে হতো না!
তিনি বললেন, তাতে আমার দুঃখ নেই। আমি আমার মায়ের আদেশ পালন করতে পেরেছি। আল্লাহর হুকুম পালন করতে পেরেছি, এতেই আমি খুশি। তিনি আরো বললেন, কাল হাশরের মাঠে আমাকে লজ্জিত হতে হবে না। অপমান সইতে হবে না, এরচেয়ে আনন্দের আর কি আছে?
সত্যবাদী বালকের দৃড়তায় চমকে উঠলেন ডাকাত সর্দার। তার মনে হল সে আত্মমর্যাদাহীন ও নির্বোধ একজন মানুষ। এই বালকের সমান বুদ্ধিও তার নেই। যদি থাকতো তাহলে আল্লাহর হুকুম অমান্য করে সে মানুষের সহায়-সম্পদ লুট করতে পারতো না।
হঠাৎ হায় হায় করে উঠলো ডাকাত সর্দার বলল, কে না জানে, সবাই কে একদিন মরতে হবে। মরার পর আল্লাহ যখন জানতে চাইবেন, তোমার কি লুটপাট করার জন্য দুনিয়াতে পাঠিয়েছিলাম, তখন কি জবাব দেব আমি?
ডাকাত সর্দারের মনে তোলপাড় শুরু হল। অনুশোচনায় দগ্ধ হতে লাগলো মন। তিনি চিৎকার করে বলতে লাগলেন, এই ছেলে মায়ের কথার অবাধ্য হচ্ছে না, আর মহান আল্লাহর অবাধ্য হয়ে ডাকাতি করছি? কী হবে আমাদের পরিণতি?
আবদুল কাদের বললেন, আল্লাহর কাছে তওবা করুন। আল্লাহ বড়ই ক্ষমাশীল।
তক্ষুনি বড় পীরের হাত ধরে তওবা করলেন ডাকাত সর্দার। দলের অন্যরাও তওবা করলো। তারা ওয়াদা করলো, জীবনে আর ডাকাতি করবো না। লুটপাট করবো না। আল্লাহর অবাধ্য হবো না। পাপ কাজ করবো না।
ডাকাতরা কাফেলার লোকজনকে ডেকে তাদের সব মালামাল ফিরিয়ে দিল। কাফেলা খুশি মনে বাগদদের পথ ধরলো।
এই গল্পে আমাদের শেখায়ঃ
মিথ্যা কথা বলতে নেই
পাপের পথে চলতে নেই।
থাকলে মনে খোদার ভয়
জীবনটা হয় পূন্যময়।
লেখকঃ আসাদ বিন হাফিজ।