সত্তর ব্যক্তি নির্বাচন

হযরত মূসা (আঃ) হযরত হারুন (আঃ)-কে বনী ইসরাইলের পথভ্রষ্টতা সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করার সময় তৌরাত লিপিবদ্ধ যে কাষ্টফলকসমূহ মাটিতে রেখে দিয়েছিলেন বনী ইসরাইলীদের গুনাহ মাফ হয়ে যাওয়ার পর তিনি তা তুলে নিলেন। এক বর্ণনায় এসেছে, হযরত মূসা (আঃ) তৌরাতের কাষ্ঠ ফলকসমূহ মাটিতে রাখার সময় ফেটে গিয়েছিল। অনন্তর আল্লাহ পাক অন্য কোন জিনিসের উপর তৌরাত লিপিবদ্ধ করে লিখে তাকে দান করেছিলেন।

পবিত্র কোরআনে এরশাদ হয়েছে-

وَفِي نُسْخَتِهَا هُدًى وَرَحْمَةٌ لِّلَّذِينَ هُمْ لِرَبِّهِمْ يَرْهَبُونَ

আর এদের বিষয়সমূহের মধ্যে হিদায়াত ও রহমত ছিল ও ঐ সব লোকের জন্য যারা নিজেদের রবকে ভয় করে। (সূরা- আরাফ)

হযরত মূসা (আঃ) বনী ইসরাইলীদের সম্মুখে তৌরাত গ্রন্থ করে বলেন যে, এ গ্রন্থ আল্লাহ প্রদত্ত কিতাব। চল্লিশ দিন তুর পর্বতে ইতিকাফ করার পর আল্লাহ তায়ালা তোমাদের হিদায়াতের জন্য এ কিতাব নাজিল করেছেন। বনী ইসরাইলীরা ছিল বক্র স্বভাবী। যে কোন ব্যাপারে তাদের বক্র স্বভাবের প্রতিফলন বার বার প্রকাশ পেয়েছে। তৌরাত পেশের ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম হল না। তারা বলেই ফেলল এটা যে আল্লাহ প্রদত্ত কিতাব তা আমরা কিতাব বিশ্বাস করব? এমনও তো হতে পারে, এ কিতাব খানা আপনি নিজে লিখে সামেন রেখেছেন আর আল্লাহ তায়ালা প্রদত্ত কিতাব বলে চালিয়ে দিচ্ছেন। তাদের এ আপত্তিকর বক্তব্য হযরত মূসা (আঃ) -এর কাছে অত্যন্ত ভারী অনুভূত হল। তাদের এ বক্তব্য শ্রবনান্তে তিনি বড়ই অস্বস্তিকর পরিবেশে পতিত হলেন এবং সমস্যার সমাধানার্থে আল্লাহ তায়ালার কাছে দোয়া করলেন। আল্লাহ তায়ালার তরফ থেকে ইরশাদ হল, হে মূসা! বনী ইসরাইল হতে নির্ভরশীল কিছু লোক বেছে নিয়ে তুর পর্বত আগমন করুন। আমি তাদেরকে আমার কথা শুনিয়ে দিব যাতে তাদের বিশ্বাস হয়ে যায় যে, এটা আমার কিতাব।

হযরত মূসা (আঃ) বনী ইসরাইলীদের আল্লাহ তায়ালার নির্দেশ জানিয়ে দিলেন। তিনি বলন, আল্লাহ তায়ালা আমাকে তোমাদের মধ্য হতে কিছু লোক নিয়ে তুর পর্বতে হাজির হতে নির্দেশ দিয়েছেন। তোমরা এখানে কয়েক লক্ষ লোক। সকলে তুর পাহাড়ে সমবেত হয়ে ভীড় না করে তোমাদের মধ্য হতে নির্ভরশীল সত্তরজন লোক বেছে নিয়ে তাদেরকে তুর পাহাড়ে উপস্থিত হওয়াকে শ্রেয় মনে করি। এতে তথায় ভীড় হবে না এবং আল্লাহ তায়ালার নির্দেশানুযায়ী কাজ হবে। তারা প্রত্যাবর্তন করে যদি এ কিতাবের সত্যতা সম্পর্কে সাক্ষ্য দেয় তবে তো একে আল্লাহর কিতাব বলে গ্রহণ করে নিতে তোমাদের আর কোন আপত্তি থাকবে না। বনী ইসরাইলীরা সকলে তার প্রস্তাব পছন্দ করল। অতঃপর হযরত মূসা (আঃ) বনী ইসরাইল হতে

এমন সত্তর জন লোক নিদির্ষ্ট করে নিলেন যারা তাদের মধ্যে সর্বাধিক নেককার এবং গো-বৎসের পূজা থেকে বিরত ছিল। তিনি খুব সতর্কতা ও সাবধানতার সাথে তাদের বাছাই করলেন-

وَاخْتَارَ مُوسَىٰ قَوْمَهُ سَبْعِينَ رَجُلًا لِّمِيقَاتِنَا

এবং হযরত মূসা (আঃ) তার কওম হতে সত্তরজন পুরুষকে আমার নির্বাচিত সময়ের জন্য নিদির্ষ্ট করলেন। (সূরা-আরাফ)

হযরত মূসা (আঃ) তাদেরকে নিয়ে তুর পর্বতের দিকে চললেন। যখন তিনি তাদের সহ পর্বতের নিকটবর্তী হলেন তখন তথায় ভূকম্পন শুরু হয়ে গেল। এতে হযরত মূসা (আঃ) বনী ইসরাইল প্রতিনিধিদের কাছে বড়ই লজ্জিত হয়ে পড়লেন। এজন্য তিনি আল্লাহ তায়ালার দরবারে আরয করলেন-

فَلَمَّا أَخَذَتْهُمُ الرَّجْفَةُ قَالَ رَبِّ لَوْ شِئْتَ أَهْلَكْتَهُم مِّن قَبْلُ وَإِيَّايَ ۖ أَتُهْلِكُنَا بِمَا فَعَلَ السُّفَهَاءُ مِنَّا ۖ إِنْ هِيَ إِلَّا فِتْنَتُكَ تُضِلُّ بِهَا مَن تَشَاءُ وَتَهْدِي مَن تَشَاءُ ۖ أَنتَ وَلِيُّنَا فَاغْفِرْ لَنَا وَارْحَمْنَا ۖ وَأَنتَ خَيْرُ الْغَافِرِينَ

অর্থঃ হে আমার রব! আপনি তাদেরকে ধ্বংস করতে চাইলে প্রতিনিধি হয়ে আসার পূর্বেই তো তাদেরকে এবং আমাকে ধ্বংস করতে পারতেন। আমাদের মধ্যকার কতিপয় নির্বোধ লোকের কার্যের দরুন কি আমাদের সকলকে আপনি ধ্বংস করে দিবেন? আর এ ভূমিকম্প তো আপনার পক্ষ হতে পরীক্ষা মাত্র। এ পরীক্ষা দিয়ে আপনি যাকে ইচ্ছা বিপথগামী করতে পারেন আর যাকে ইচ্ছা সৎপথে অটল রাখতে পারেন। আপনিই আমাদের তত্ত্বাবধায়ক। আমাদের ক্ষমা করুন ও দয়া করুন। আপনিই সর্বোত্তম ক্ষমাকারী। (সূরা-আরাফঃ আয়াত-১৫৫)

প্রকৃতপক্ষে হযরত মূসা (আঃ) যদিও খুব সতর্কতার সাথে বনী ইসরাইল হতে সত্তর ব্যক্তিকে বাছাই করে নিয়েছিলেন। তবুও এমন কতক লোক তাদের দলভুক্ত হয়ে পড়েছিল যারা পূর্বে গো-বৎসের প্রতিমা পূজা করেছিল। গো-বৎসের প্রতিমা পুড়িয়ে ভষ্ম করে দেয়ার পর তারা বাহ্যিকভাবে নেককার সেজেছে বটে কিন্তু তাদের অন্তর হতে গো-বৎসের মর্যাদা ও মহাব্বত দূরীভূত হয়নি। যেহেতু তারা এ প্রতিনিধি দলে ছিল তাই প্রতিনিধি দলের আগমনে ভূকম্পন দেখা দিয়েছিল। হযরত মূসা (আঃ) আল্লাহ পাকের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করলে আল্লাহ পাক এর জবাবে বলেন-

وَرَحْمَتِي وَسِعَتْ كُلَّ شَيْءٍ ۚ فَسَأَكْتُبُهَا لِلَّذِينَ يَتَّقُونَ وَيُؤْتُونَ الزَّكَاةَ وَالَّذِينَ هُم بِآيَاتِنَا يُؤْمِنُونَ

الَّذِينَ يَتَّبِعُونَ الرَّسُولَ النَّبِيَّ الْأُمِّيَّ الَّذِي يَجِدُونَهُ مَكْتُوبًا عِندَهُمْ فِي التَّوْرَاةِ وَالْإِنجِيلِ আমার রহমত সকলকেই ঘিরে আছে। আমি অতি সত্বর এ সব লোকদেরকে আমার রহমতের সনদপত্র লিখে দিব যারা তাকওয়া অবলম্বন করে এবং যাকাত আদায় করে। যারা আমার আয়াতসমূহের প্রতি

বিশ্বাস রাখে। যারা আমার রাসূলে উম্মীর অনুসরণ অনুকরণ করে যার আলোচনা তার তৌরাত ও ইঞ্জিলে লিপিবদ্ধ পায়। (সূরা-আরাফঃ আয়াত-১৫৬-৫৭)

আল্লাহ তায়ালার উল্লেখিত বাণী শুনে হযরত মূসা (আঃ) আরয করলেন, হে আমার রব! আমি তো আপনার সমীপে আমার সম্প্রদায়ের অপরাধ ক্ষমার আবেদন করেছিলেন। অথচ আপনি যে রহমতের কথা বলেছেন- তাতে বুঝা যায় যে, তা আমার সম্প্রদায় ছাড়া অন্য এক সম্প্রদায়ের সাথে সম্পর্কিত। আপনি আমাকে এখন সৃষ্টি না করে পরে সৃষ্টি করলে আমিও এ রহমত প্রাপ্ত উম্মতের দলভুক্ত হতে পারতাম। এমতাবস্থায় প্রতিনিধি দলের ভেতর যাদের অন্তরে গো-বৎসের মহাব্বত বিদ্যমান ছিল তারা মনে মনে লজ্জিত হয়ে তওবা করল। আল্লাহ পাক তখন তাদের অপরাধ ক্ষমা করে দিলেন। ভূ-কম্পন থেমে গেল। হযরত মূসা (আঃ)-কে তাদের অপরাধ মার্জনার কথা জানিয়ে দেয়া হল।

অনন্তর তিনি সত্তর জনের এ প্রতিনিধি দলসহ তুর পর্বতে পৌঁছুলেন। পাহাড়ের উপর একখণ্ড সাদা মেঘের ন্যায় নূর আগমন করে হযরত মূসা (আঃ) -কে ঘেরাও করে ফেলল। আল্লাহ পাকের সাথে তাঁর কথোপকথন শুরু হল। তিনি বলেন, হে আল্লাহ! আপনি তো বনী ইসরাইলের স্বভাব সম্পর্কে সম্পূর্ণ অবগত। তাদের স্বভাবের বক্রতা কারও কাছে অপ্রকাশ্য নয়। আমি তাদের থেকে মাত্র সত্তর ব্যক্তিকে বেছে নিয়ে আপনার দরবারে হাজির হয়েছি। যদি তারা আপনার নূরের পর্দার ভিতর এসে আমার ও আপনার কথাবার্তা শুনাত, তবে কতই না ভাল হত! আর তারা বনী ইসরাইলের কাছে প্রত্যাবর্তন করে আমার সত্যতার সাক্ষ্য দিতে পারত। আল্লাহ পাক হযরত মূসা (আঃ)-এর দোয়া কবুল করলেন। তাদেরকেও নূরের পর্দা দিয়ে পরিবেষ্টন করে নিলেন। তারা আল্লাহ ও হযরত মূসা (আঃ)-এর মধ্যে যে কথোপকথন হয়েছে তা শুনল।

অনন্তর যখন মূসা (আঃ) ও তার সাথে আশা লোকদের উপর থেকে আল্লাহর নূরের পর্দা সরে গেল। হযরত মূসা (আঃ) আর বনী ইসরাইলের প্রতিনিধিদল পরস্পরকে দেখতে পেলেন। পরস্পরের সামনে আসলেন। তখন প্রতিনিধিরা হযরত মূসা (আঃ)-এর সামনে আরও একটি দাবী পেশ করে বলল তারা আল্লাহ তায়ালাকে সরাসরি দেখতে চায়। তাদের দাবী হল আল্লাহ তায়ালা এতক্ষণ পর্দার ভিতর থেকে কথাবার্তা বলেছেন। কিন্তু যে পর্যন্ত তারা আল্লাহ পাককে পর্দাবিহীন অবস্থায় সরাসরি না দেখবে সে পর্যন্ত আল্লাহ তায়ালা কথা বলেছেন বলে বিশ্বাস করতে পারছে না বলে হযরত মূসা (আঃ) কে তারা জানিয়ে দিল। হযরত মূসা (আঃ) তাদেরকে নিয়ে বড়ই বিপাকে পড়লেন। কেননা, আল্লাহ তায়ালাকে সরাসরি দর্শন করবার এ অবস্থার দাবী হল সম্পূর্ণ নির্বুদ্ধিতার পরিচায়ক। আল্লাহ পাক মূসা (আঃ)-কে এর অবাস্তবতা অবহিত করেছেন। তাই হযরত মূসা (আঃ) জানেন যে, কোন মানুষ পার্থিব জগতে থেকে আল্লাহ পাককে দেখতে পারে না। হযরত মূসা (আঃ)-এর ন্যায় শক্তিশালী নবীই যখন আল্লাহ পাকের দর্শনের অভিলাষ করে তাঁর নূরের প্রভাবে বেহুশ হয়ে পড়েছিলেন তখন সাধারণ মানুষের তো কোন কথাই নেই। তিনি তাদেরকে পুন পুন বুঝাতে চেষ্টা করলেন যে, এ নম্বর জগতে থেকে মানুষের পক্ষে আল্লাহ পাকের দর্শন

সম্ভব নয়। এ দাবী হতে বিরত থাকাই তাদের জন্য মঙ্গল। কিন্তু তারা হযরত মূসা (আঃ)-এর কোন কথাই মানতে রাজি নয়। তারা জিদ ধরে বসল।

আল্লাহ তায়ালা তাদের এ অর্থহীন দাবী এ তাদের জিদের পরিপেক্ষিতে শাস্তি প্রদানের সিদ্ধান্ত নিলেন। প্রচণ্ড এক গগনবিধারী ধ্বনির মাধ্যমে তাদের জীবন লীলা সাঙ্গ করে দেয়া হল। সব মরে গেল। তুর পাহাড়ের পাদদেশ মৃতপুরীতে পরিণত হল। হযরত মূসা (আঃ) এতে অত্যন্ত ব্যথিত হলেন। কেননা, তারা বনী ইসরাইলের বিশেষ বিশেষ লোক। তদুপরি তাদেরকে রেখে বনী ইসরাইলের কাছে প্রত্যাবর্তন করে তিনি কি জবাব দিবেন? বনী ইসরাইলরা হল অত্যন্ত বক্র স্বভাবের লোক। তারা তো হযরত মূসা (আঃ)-এর প্রতি অপবাদ দিবে যে, মূসা (আঃ) ধোকা দিয়ে তাদেরকে কোথায় নিয়ে গিয়ে তাদেরকে খুন করেছেন। আর তারা কেবল অপবাদ দিয়েই ক্ষান্ত হবে না। বরং তারা তাকে হত্যা করে প্রতিশোধ নেয়ার জন্যও প্রস্তুত হবে। তাই তিনি আল্লাহ তায়ালার দরবারে নিবেদন করলেন, হে আমার রব! এ সকল লোক নির্বোধ। তারা নিজেদের নির্বুদ্ধিতার কারণে এরূপ হয়েছে। আপনি অনুগ্রহপূর্বক তাদেরকে মাফ করে দিন। যদি তারা মৃত অবস্থায় এখানে পড়ে থাকে আর আমি একা একা বনী ইসরাইলের কাছে ফিরে যাই কী তবে তারা আমার প্রতি অপবাদ দিবে। তাদের কাছে জবাব দেয়ার মত আমার কিছুই থাকবে না। আপনি দয়া করে তাদেরকে মাফ করে পুনরায় জীবিত করে দিন। আল্লাহ তায়ালা মূসা (আঃ)-এর দোয়া কবুল করলেন। পুনরায় সকলকে জীবিত করে দিলেন কোরআনে এ ঘটনাকে উল্লেখ করা হয়েছে-

وَإِذْ قُلْتُمْ يَا مُوسَىٰ لَن نُّؤْمِنَ لَكَ حَتَّىٰ نَرَى اللَّهَ جَهْرَةً فَأَخَذَتْكُمُ الصَّاعِقَةُ وَأَنتُمْ تَنظُرُونَ

ثُمَّ بَعَثْنَاكُم مِّن بَعْدِ مَوْتِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَشْكُرُونَ

অর্থঃ এবং তোমরা তখনকার কথা স্মরণ কর যখন তোমরা বলেছিলে হে মূসা! আমরা আল্লাহ পাকের দর্শন লাভ ছাড়া আপনার প্রতি কখনও ঈমান আনবে না। তখন তোমাদের প্রতি বজ্রপাত হয়েছিল আর তোমরা দেখছিলে যে, তোমাদের প্রতি বজ্রপাত হচ্ছে। অনন্তর তোমাদের মৃত্যুর পর আমি তোমাদেরকে পুনরায় জীবিত করেছিলাম আশা ছিল যে তোমরা শুকরিয়া আদায় করবে। (সূরা বাকারা- আয়াতঃ ৫৫-৫৬)

You may also like...

দুঃখিত, কপি করবেন না।